বিপর্যস্ত পরিবেশ; জলাবদ্ধতার দুর্ভোগ! সমাধান কোথায়?

150

বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে একদিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে, অন্যদিকে মানুষের বিভিন্ন কর্মকান্ড প্রাকৃতিক পরিবেশকে ক্রমাগত বিপর্যস্ত করে তুলছে। সামান্য বৃষ্টি হলেই এর পানি আটকে গিয়ে শহরের গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলোতে জলাবদ্ধতা। বাংলাদেশের জলাবদ্ধতা শুধু ঢাকা, চট্টগ্রামকেন্দ্রিক নয়, বাংলাদেশের প্রায়ই শহর থেকে গ্রাম অবধি জলাবদ্ধতা প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। পানি সাধারণত জলাধার, খাল বিল হয়ে নদীতে মিশে। শহর থেকে এই পানি দ্রæত বের হওয়ার পথ কোথায়? মহাসড়কের গুরুত্বপূর্ণ স্থান, শহরের মধ্যে নদী, খাল দখল করে অনিয়মতান্ত্রিকভাবে মাটি ভরাটের ফলে পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা বন্ধ হয়, জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর চাপ, আর অতি মুনাফা লোভী ভূমি দুর্বৃত্তদের প্রভাবে হারিয়ে গেছে এর অনেকটাই। এর সাথে যুক্ত হয়েছে অপরিকল্পিত ব্যবস্থা আর উন্নয়নের নামে অসামঞ্জস্যপূর্ণ উন্নয়ন কর্মকাÐ। ফলে খাল হয়েছে কালভার্ট, লেক হয়েছে বসতি, গাছ হয়েছে জ্বালানী। প্রকৃতির দোষটা কোথায়? বন্যা, জলাবদ্ধতা তো হবেই। আল্লাহ’র নেয়ামতকে ধ্বংস করার অধিকার কাউকে দেওয়া হয়নি। করলে তার পরিনতি ভুগতে হবে। আজ প্রতি বর্ষায় নগরবাসীর নাকাল অবস্থা। জলজটে শহরের স্বাভাবিক কর্মকান্ড বিপর্যস্ত। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, প্রায় জায়গায় ড্রেন কিংবা খাল ময়লা-আবর্জনায় ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পলিথিন ও আবর্জনা ছুটে ফেলা হয়। আবর্জনা সরিয়ে না ফেলার কারণে পানি নিষ্কাশন বন্ধ থাকায় জলাবদ্ধতায় আটকে যাচ্ছে যানবাহন, ডুবে যাচ্ছে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ঘর-বাড়ি, সেই সাথে পানিবন্দী হয়ে পড়ছে মানুষ। ফলে দুর্ভোগ যেন নিয়তির লিখন হয়ে দাঁড়িয়েছে। জলাবদ্ধতা থেকে প্রতিকার পেতে হলে অবশ্যই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরিকল্পনামাফিক পানি নিষ্কাশনের প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দ্রুত সরিয়ে ফেলতে হবে। যাতে করে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি না হয়। জনস্বার্থে সরকারকে জলাবদ্ধতা দূর করার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। যাতে করে জনগণ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পায়। অন্যদিকে গ্রাম, ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা ও শহর পর্যায়ে একের পর এক জলাভূমি ভরাট করা হচ্ছে। আইন তো আছেই, কিন্তু মানা হচ্ছে কি? ‘প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০’ অনুযায়ী কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ভরাট করা বেআইনি। আবার বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-২০১০ অনুযায়ী জাতীয় অপরিহার্য স্বার্থ ছাড়া কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সরকারি বা আধা সরকারি, এমনকি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের বা ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর বা জলাধার ভরাট করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। রয়েছে পরিবেশ সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন, বিধিমালা ও আদেশ। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ২০১০(সংশোধনীসহ), পরিবেশ আদালত আইন ২০০০, পরিবেশ আদালত আইন ২০১০, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা ১৯৯৭, জাতীয় পরিবেশ নীতি ২০১৮ । অপ্রিয় হলেও সত্য যে, দেশে পরিবেশ আইন থাকলেও সেই আইন দিয়ে পরিবেশ ধ্বংসকারীদের ঠেকানো যাচ্ছে না। পরিবেশ আইন ভঙ্গের জন্য সর্বোচ্চ শাস্তির যে বিধান রয়েছে তাও ক্ষেত্রবিশেষ যথেষ্ট নয়। প্রাকৃতিক পরিবেশের চলমান দুর্দিনে মানবসৃষ্ট পরিবেশ দূষণের জন্য আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। তাছাড়া পরিবেশ আদালত আইনটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হওয়ার ফলে পরিবেশ সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না। আইন অনুসারে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি আদালত গঠনের বিধান থাকলেও তিনটি পরিবেশ আদালত (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) ও ঢাকায় একটি পরিবেশ আপিল আদালত কার্যকর রয়েছে। ফলে বিভিন্ন জেলার পরিবেশ দূষণের মামলা পরিচালনায় বাদী-বিবাদী উভয়েরই সমস্যা হচ্ছে। নতুন কোনো আদালত প্রতিষ্ঠা করা হয়নি বলে শুধু আগের তিনটি আদালত ও একটি আপিল আদালতই এখন কাজ করছে। পাশাপাশি নির্বাহী হাকিমগণ (এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট) ভ্রাম্যমাণ আদালত আইন (মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯) এর অধীনে গঠিত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে পরিবেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের অধীনে কিছু অপরাধ তাৎক্ষণিকভাবে ঘটনাস্থলেই আমলে নিয়ে দন্ডারোপ করেন।
সর্বশেষ কথা হচ্ছে পরিবেশ রক্ষা করতে হলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন করতে হবে। বসবাসের অনুপযোগী পরিবেশকে বাসযোগ্য করে তোলার জন্য মানুষকে প্রকৃতির উপর কল্যাণকর হস্তক্ষেপে এগিয়ে আসতে হবে। অধ্যাপক চেম্বারলিনের মতে,Environment is a surrounding conditions influencing development of growth। যে পৃথিবী মানুষের হস্তক্ষেপের ফলে অনেকের জন্য কল্যাণকর হয়ে উঠে সেই পৃথিবীই আবার কিছু কিছু অকল্যাণকর হস্তক্ষেপের প্রভাবে প্রতিকূল পরিবেশ সৃষ্টির মাধ্যমে বহু মানুষের জন্য দুঃখ, দুর্দশা, কষ্ট, দুর্ভোগ বয়ে নিয়ে আসে। আসুন, আমরা আমাদের বাসযোগ্য পরিবেশ গড়ার জন্য অঙ্গীকার করি। আমাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রয়াস বিরাট শক্তিরূপে অর্জিত হতে পারে।

লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট