বিপদে বিদেশে চিকিৎসা প্রত্যাশী বাংলাদেশি রোগীরা

32

অনেকদিন ধরে ভারতের চেন্নাইয়ের ক্যান্সারের চিকিৎসা করাচ্ছেন বাংলাদেশের ঢাকার লেকসিটির বাসিন্দা নূরুল ইসলাম মিয়া। তিনমাস আগে সর্বশেষ তিনি ডাক্তার দেখিয়ে আসেন। সেই সময় তাকে মুখে খাওয়ার কেমোথেরাপির ওষুধ দেয়া হয় এবং তিনমাস পরে আবার যেতে বলা হয়। তিনি ছয়মাসের ওষুধ কিনে নিয়ে এসেছিলেন।
এপ্রিল মাসের ১৩ তারিখে তার আবার চিকিৎসকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে তিনি যেতে পারছেন না। যেটুকু ওষুধ এনেছিলেন, তাও শেষ হয়ে গেছে। কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে এবং কবে যেতে পারবেন, তাও জানেন না।
তিনি বলছেন, ওরাল কেমোথেরাপি দেয়ার পর একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছিলাম। কিছু সাইড অ্যাফেক্ট দেখা দিয়েছে। ফুসফুসে একটু সংক্রমণ হয়েছে। দ্রুত আমার চিকিৎসকের কাছে যাওয়া দরকার।
‘এই মাসেই যাওয়ার কথাও ছিল। কিন্তু এই লকডাউনের মধ্যে তো যেতেও পারছি ন। কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষাও করা দরকার, কিন্তু সময় মতো যেতে পারলাম না। এখন অপেক্ষা করছি পরিস্থিতি একটু স্বাভাবিক হওয়ার।’
ঢাকার আরেকজন বাসিন্দা সানজিদা আক্তারের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ভারতের চেন্নাই যাওয়ার কথা ছিল মার্চ মাসের ১৫ তারিখে। তার মায়ের আলসারের সমস্যা রয়েছে।
নিজের সন্তান, স্বামীর চিকিৎসকের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছিল। বড় বোনের ফলোআপ করানোর কথা। সবাই ভিসাও হয়েছিল। কিন্তু লকডাউনের কারণে তারা কেউ আর যেতে পারেননি। তিনি বলছেন, বাংলাদেশে মাকে ডাক্তার দেখিয়েছি। তাতে খুব বেশি উপকার হয়নি। তাই এবার ভারতে দেখানোর কথা ভাবছিলাম।
‘বড় বোনের হৃদরোগের সমস্যা আছে, ফলোআপ করাতে যাওয়ার কথা। কিন্তু কোনটাই হলো ন। বাংলাদেশেও ডাক্তাররা তেমন বসছেন না। এখন যে কি করবো তাই বুঝতে পারছি না। সবমিলিয়ে একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে গেছি।’
তাদের মতো এমন ভোগান্তিতে পড়েছে বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষ, যারা উন্নত চিকিৎসার জন্য ভারত, ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে যাতায়াত করেন। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যাওয়া রোগীদের বেশিরভাগই ভারতে চিকিৎসা নিয়ে থাকেন।
ঢাকায় ভারতীয় হাই কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে ১৫ লাখ বাংলাদেশিকে ভারতের ভিসা দেয়া হয়েছে।
এদের বড় একটি অংশ চিকিৎসার জন্য দেশটিতে ভ্রমণ করেছেন।
অনেকে যেমন চিকিৎসা ভিসায় সেদেশে গেছেন, কেউ কেউ আবার পর্যটক ভিসায় ভারতে গিয়ে চিকিৎসা সুবিধা নিয়েছেন।
কিন্তু ভারত ও বাংলাদেশে লকডাউন শুরু হওয়ার পর এই চিকিৎসা প্রত্যাশী সবাই সংকটের মধ্যে পড়ে গেছেন।
তাদের অনেকের আগে নেয়া চিকিৎসার ফলোআপে যাবার কথা রয়েছে, অনেকের আবার নানা অপারেশনের জন্য হাসপাতালের অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেয়া হয়েছে। কিন্তু লকডাউনের কারণে সবাই আটকে পড়েছেন।
এর বাইরে আরও অনেকে চিকিৎসার জন্য ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরেও যান।
মার্চ মাসে থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের একটি হাসপাতালে হাঁটুর অপারেশন করানোর কথা ছিল ঢাকার বাসিন্দা মনসুর আহমেদের। কিন্তু লকডাউনের কারণে তিনি যেতে পারছেন না। আবার এরকম জটিল অপারেশন ঢাকায় করানোর সাহসও করছেন না।
‘অপারেশনটা একটু জটিল। তাই খরচ বেশি হলেও ব্যাংককে করানোর কথা ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন তো সব আটকে গেছে। সমস্যা হলো, বাংলাদেশে যে করাবো, তেমন সাহসও পাচ্ছি ন। এখন অপেক্ষা করছি, কবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়।’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশেও ভালো মানের চিকিৎসা হয়, তাই গুরুতর বা জটিল রোগ নিয়ে অপেক্ষা না করে চিকিৎসা করিয়ে নেয়া ভালো।
তিনি অপেক্ষা করতে পারলেও ফরিদপুরের ইকবাল হোসেনের সেই সময় নেই। তার বাবার হার্টের বাল্বের অপারেশন করানোর জন্য ভারতের একটি হাসপাতালে সব কিছু চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিল। ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে তাদের যাবার কথা ছিল।
লকডাউন শুরু হওয়ার পর তারা অপেক্ষায় ছিলেন, সেটা তুলে নেয়া হলেই চলে যাবেন। কিন্তু কয়েক দফায় লকডাউন বেড়ে যাওয়ায় এখন তারা বাংলাদেশেই অপারেশন করার জন্য যোগাযোগ শুরু করেছেন।
‘ভারতে তো যেতে পারলাম না। এখন দেশে অপারেশন করাবো, কিন্তু এখানেও বেশিরভাগ হাসপাতালে এখন চিকিৎসা সুবিধা সীমিত। আর অপেক্ষা না করে এখন দেশেই অপারেশন করতে হবে। কিন্তু এতো ঝামেলার মধ্যে ঠিক ভরসাও পাচ্ছি না,’ তিনি বলছেন।
যশোর থেকে শিবা কুন্ডূ নামের একজন গৃহিণী জানিয়েছেন, এখন ভারতে যেতে না পারায় তার চিকিৎসা বন্ধ রাখতে হবে।
‘আমি অসুস্থ। প্রতি তিন-চার মাস পর পর ডাক্তার দেখাতে যেতে হয়। কিন্তু এবার করোনা ভাইরাসের কারণে যেতে পারছি না। এখানে ডাক্তার দেখে ঔষধ দেয় আবার চেকআপ করে। এখনতো ডাক্তার না দেখালে ঔষধ খাওয়া বন্ধ রাখতে হবে। কারণ আগের ঔষধ তো শেষ। ফলে সমস্যা খুব।’
বরগুনার বাসিন্দা জয়দেব সরকার বলছেন, ‘আমার মায়ের মেরুদন্ডের সমস্যা রয়েছে, এ কারণে কোমরের নীচ থেকে অবশ হয়ে পড়ছে। চার মাস আগে যখন ভারতের ভেলোরে গিয়েছিলাম, তারা অপারেশন করাতে বলেছে। কিন্তু টাকা পয়সার সমস্যার কারণে দেশে ফিরে এসে টাকার জোগাড় করেছি। এর মধ্যেই তো যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল।’
‘আমার মা এখন দিনে দিনে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারছি না।’
ভারতে এক মাসের বেশি সময় ধরে চলছে লকডাউন।
কিন্তু বাংলাদেশে অনেক হাসপাতাল, চিকিৎসক থাকার পরে কেন তারা বাংলাদেশে চিকিৎসা না নিয়ে ভারতের ওপর এতোটা নির্ভর করছেন?
জয়দেব সরকার বলছেন, বরগুনা থেকে ঢাকা গিয়ে হোটেলে থেকে ভালো হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে যে খরচ হয়, তার চেয়ে কম খরচে কলকাতায় চিকিৎসা করানো সম্ভব। সেখানকার চিকিৎসা ব্যবস্থা তুলনামূলক ভালো বলে তিনি মনে করেন।
‘চেনাজানা অনেকেই ভারতে ভালো চিকিৎসা পেয়েছেন, সুস্থ হয়েছেন। সেটা দেখে আমরাও যাচ্ছি,’ তিনি বলছেন।
ভারতের চেন্নাই, কলকাতা, হায়দ্রাবাদ, ব্যাঙ্গালোরের বিভিন্ন হাসপাতালের প্রতিনিধি হিসাবে কাজ করে উপশম নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
তাদের ঢাকা অফিসের ব্যবস্থাপক জহির আহমেদ বলছেন, প্রতি মাসে আমাদের মাধ্যমে ৫০/৬০ জন রোগী ভারতে চিকিৎসার জন্য যেতেন। কিন্তু লকডাউন শুরু হওয়ার পর সেটা তো একেবারেই বন্ধ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশ সোসাইটি অফ মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা মেডিকেল কলেজের মেডিসিন বিভাগের অধ্যাপক মোঃ বিল্লাল আলম বলছেন, ‘এই লকডাউনের সময়েও কারো উচিত হবে না গুরুতর কোন সমস্যা নিয়ে অপেক্ষা করা। বরং তাদের উচিত হবে বাংলাদেশের চিকিৎসকদের পরামর্শ গ্রহণ করা।’‘বাংলাদেশে অনেক ভালো ভালো চিকিৎসক রয়েছেন, সব ধরনের অপারেশন হয়। জরুরি প্রয়োজনে রোগীরা অস্ত্রোপচারও করাতে পারেন।’ খবর বিবিসি বাংলার