বিনয় ও নম্রতা

527

বিনয় ও নম্রতা মানুষের উত্তম চরিত্রের ভূষণ ও অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। বিনয় মানুষকে উচ্চাসনে সমাসীন ও গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। বিনয়ী ব্যক্তিকে আল্লাহ যেমন ভালোবাসেন, তেমনি মানুষও ভালোবাসে। যে আল্লাহর উদ্দেশ্যে বিনয়ী হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বাড়িয়ে দেন। যে যতবেশি বিনয়ী ও নম্র হয় সে ততবেশ উন্নতি লাভ করে। এ পৃথিবীতে যারা আজীবন স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে মানুষের হৃদয়ের মণিকোঠায় আসন লাভ করে আছেন তাঁদের প্রত্যেকেই বিনয়ী ও নম্র ছিলেন। সর্বকালের সেরা মানব রসুলে পাক হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছিলেন বিনয় ও নম্রতার মূর্তপ্রতীক এবং পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ বিনয়ী ও নম্র মানুষ। বিনয় ও নম্রতা দ্বারাই তিনি মানুষকে আপন করে নিয়েছেন। তাইতো মহান আল্লাহ সাক্ষ্য দিয়েছেন এভাবে ‘আর নিশ্চয়ই আপনি সুমহান চরিত্রের অধিকারী’ (কালাম ৬৮/৪)।
কোমলতা ও নম্রতা আল্লাহর বিশেষ গুণ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ তা‘আলা কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা বা অন্য কোন আচরণের প্রতি ততটা অনুগ্রহ করেন না’।[মুসলিম হা/২৫৯৩; মিশকাত হা/৫০৬৮।]
বিনয়-নম্রতার ফযীলত ও উপকারিতা: বিনয় ও নম্রতার উপকারিতা সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘যাকে নম্রতার কিছু অংশ প্রদান করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণের অংশ প্রদান করা হয়েছে। আর যাকে সেই নম্রতা থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তাকে দুনিয়া ও আখেরাতের বিরাট কল্যাণ হ’তে বঞ্চিত করা হয়েছে’।[ তিরমিযী হা/২০১৩; মিশকাত হা/৫০৭৬; ছহীহাহ হা/৫১৯।]
তিনি আরো এরশাদ করেন, আল্লাহর নৈকট্য লাভকারী প্রত্যেক বিনয়ী ও নম্র লোকের জন্য জাহান্নাম হারাম ’।[তিরমিযী হা/২৪৮৮; ছহীহাহ হা/৯৩৮।]
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেন,‘নিশ্চয়ই আল্লাহ যখন কোন গৃহবাসীকে ভালবাসেন, তখন তাদের মাঝে নম্রতা প্রবেশ করান’।[ছহীহুল জামে‘ হা/৩০৩, ১৭০৩; সিলসিলা ছহীহা ২/৫২৩।]
তিনি আরো এরশাদ করেন, ‘যে বান্দা আল্লাহর জন্য বিনীত হয়, আল্লাহ তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে দেন’।[মুসলিম হা/২৫৮৮।] অন্য বর্ণনায় এসেছে, তিনি আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু তাআ’লা আনহাকে বলেছেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হ’তে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে’। [মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৬৮।]
আল্লাহ কর্তৃক বিনয়ীদের প্রশংসা: মহান আল্লাহ বিনয়ী ও নম্র স্বভাবের মানুষদের প্রশংসায় বলেন,‘দয়াময় আল্লাহর বান্দা তো তারাই, যারা পৃথিবীতে নম্রভাবে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যখন অজ্ঞ ব্যক্তিরা সম্বোধন করে তখন তারা বলে ‘সালাম’। আর যারা রাত্রি অতিবাহিত করে পালনকর্তার উদ্দেশ্যে সিজদাবনত থেকে ও দÐায়মান হয়ে এবং যারা বলে, হে আমার প্রতিপালক! আমাদের থেকে জাহান্নামের শাস্তি বিদূরিত কর, নিশ্চয়ই এর শাস্তি নিশ্চিত বিনাশ। নিশ্চয়ই তা অবস্থান ও আবাসস্থল হিসাবে অত্যন্ত নিকৃষ্ট’ (ফুরক্বান ২৫/৬৩-৬৬)। অন্য আয়াতে আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘এটা আখিরাতের নিবাস যা আমি নির্ধারণ করি তাদের জন্য যারা পৃথিবীতে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করতে ও বিপর্যয় সৃষ্টি করতে চায় না। মুত্তাক্বীদের জন্য রয়েছে শুভ পরিণাম’ (ক্বাছাছ ২৮/৮৩)।
পক্ষান্তরে উদ্ধত, অহংকারী, দাম্ভিকদের সম্পর্কে আল্লাহ রাববুল আলামীন কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, ‘অহংকার বশে তুমি মানুষকে তুচ্ছজ্ঞান করো না এবং পৃথিবীতে উদ্ধতভাবে পদচারণা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন দাম্ভিক অহংকারীকে পছন্দ করেন না’ (লোক্বমান ৩১/১৮)। অন্যত্র আল্লাহ তা‘আলা বলেন,‘পৃথিবীতে দম্ভভরে বিচরণ করো না। নিশ্চয়ই তুমি পদভারে ভূপৃষ্ঠকে কখনই বিদীর্ণ করতে পারবে না এবং উচ্চতায় তুমি কখনও পর্বত সম হ’তে পারবে না’ (বনী ইসরাঈল ১৭/৩৭)।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কর্তৃক বিনয়ীদের প্রশংসা: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘মুমিন ব্যক্তি নম্র ও ভদ্র হয়। পক্ষান্তরে পাপী মানুষ ধূর্ত ও চরিত্রহীন হয়’।[তিরমিযী হা/১৯৬৪; মিশকাত হা/৫০৮৫।] অন্যত্র এরশাদ করেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে জান্নাতী লোকের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল সরলতার দরুন দুর্বল, যাদেরকে লোকেরা হীন, তুচ্ছ ও দুর্বল মনে করে। তারা কোন বিষয়ে কসম করলে আল্লাহ তা সত্যে পরিণত করেন। তিনি আরো এরশাদ করেন, আমি কি তোমাদেরকে জাহান্নামীদের সংবাদ দিব না? আর তারা হ’ল প্রত্যেক অনর্থক কথা নিয়ে ঝগড়াকারী, বদমেজাজী ও অহংকারী’।[মুসলিম, মিশকাত হা/৫১০৬।]
ঔদ্ধত্যপরায়ণ, অহংকারীদের কঠিন পরিণতি সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘ক্বিয়ামতের দিন অহংকারীদেরকে পিপীলিকার ন্যায় জড়ো করা হবে। অবশ্য আকৃতি-অবয়ব হবে মানুষের। অপমান তাদেরকে চতুর্দিক হ’তে বেষ্টন করে রাখবে। ‘বুলাস’ নামক জাহান্নামের দিকে হাঁকিয়ে নেয়া হবে। অগ্নিশিখা তাদের উপর ছেয়ে যাবে। আর তাদেরকে পান করানো হবে জাহান্নামীদের দেহনিঃসৃত ‘ত্বীনাতুল খাবাল’ নামক কদর্য পুঁজ-রক্ত’।[ তিরমিযী, মিশকাত হা/৫১১২।]
এই দুনিয়াতে সর্বপ্রথম যে নাফরমানী প্রকাশ পেয়েছে তার মূলে ছিল অহংকার। আল্লাহ যখন হযরত আদমকে সৃষ্টি করে তাঁর সম্মানার্থে ইবলিসকে সিজদা করার আদেশ করেন তখন সে অহংকারের বশবর্তী হয়ে বলে উঠল, আমি তো তার চেয়ে উত্তম, আমি কেন তাকে সিজদা করবো?
মন্দকে প্রতিহত করতে হয় বিনয় ও নম্রতা দ্বারা: মন্দকে মন্দ দ্বারা, শত্রুকে শত্রুতা দ্বারা প্রতিহত না করে বরং বিনয়-নম্রতা ও উৎকৃষ্ট ব্যবহার দ্বারা মন্দকে প্রতিহত করে মানুষের হৃদয় জয় করতে হয়। মহান আল্লাহ এমনটাই নির্দেশ দিয়েছেন, ‘ভাল ও মন্দ সমান হ’তে পারে না। মন্দ প্রতিহত কর উৎকৃষ্ট দ্বারা। ফলে তোমার সাথে যার শত্রুতা আছে, সে হয়ে যাবে অন্তরঙ্গ বন্ধুর মত’ (হা-মীম সাজদাহ ৪১/৩৪)। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেন, ‘তোমরা নম্র হও, কঠোর হয়ো না। শান্তি দান কর, বিদ্বেষ সৃষ্টি করো না’।[বুখারী হা/৬১২৫।] অন্যত্র তিনি বলেন, ‘ক্ষমাশীলতা অবলম্বন কর, সৎ কাজের আদেশ দাও এবং মূর্খদের এড়িয়ে চল’ (আ‘রাফ ৭/১৯৯)।
পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য পাপাচারী ছিল ফেরাউন, যে নিজেকে সবচেয়ে বড় প্রভু বলে দাবি করেছিল। আল্লাহ তা‘আলা হযরত মূসা আলাইহিস সালামকে সে পাপিষ্ট ফেরাউনের নিকট কোমল ভাষায় দ্বীনের দাওয়াত পৌঁছাতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আল্লাহ তা‘আলা বলেন ‘তোমরা উভয়ে ফেরাউনের কাছে যাও, সে খুব উদ্ধত হয়ে গেছে। অতঃপর তোমরা তার সাথে নম্র ভাষায় কথা বল, হয়ত বা সে উপদেশ গ্রহণ করবে অথবা ভীত হবে’ (ত্বা-হা ২০/৪৩-৪৪)।
বিনয় আর নম্রতা মানুষকে প্রকৃত মানুষ বানায়, বিনয়ের গুরুত্বপূর্ণ পথ অবলম্বন করা ছাড়া মানুষ তার অভিষ্ট লক্ষে পৌঁছতে সক্ষম হয়না। বিনয় জীবনের এমন এক অনুষঙ্গ যে, যদি কেউ তা অবলম্বন না করে তাহলে তার জীবনমরুতে অহংকার বালু তপ্ত হয়ে উঠে। সুতরাং যেকোন মূল্যে হোক জীবনের খালি মাঠে বিনয়ের সবুজবৃক্ষ রোপণ করতে হবে। অন্যথায় অহংকারের বিষে মানুষ ফিরআউন হয়ে যায়, প্রতারিত হয়, জীবনের বহু সুফল থেকে বঞ্চিত হয়। কেননা দিনের বিপরীতে যেমন রাত তদ্রæপ বিনয়ের বিপরীতে হল অহংকার। সুতরাং যখন জীবনে বিনয়ের আলো না আসবে তখন অহংকারের অন্ধকার জীবনে ছেয়ে যাবে। অন্তরে নিজের বড়ত্ব সৃষ্টি হবে। অন্তরে বড়ত্ব সৃষ্টি হওয়া এমন এক মরণব্যাধি যা অভ্যন্তরীণ সমস্ত রোগের মূল।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, ইসলামিক স্টাডিজ, সাদার্ন
বিশ্ববিদ্যালয়, খতীব, মুসাফিরখানা জামে মসজিদ