বিনম্র শ্রদ্ধা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নির্মাণে বঙ্গবন্ধুর দর্শন বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে

12

আজ ১৫ আগস্ট। জাতীয় শোক দিবস। ১৯৭৫ সালের এই দিনে ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গমাতা বেগম ফজিলতুন্নেছাসহ সপরিবারে শাহাদাত বরণ করেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সাথে বঙ্গবন্ধুসহ সকল শহীদদের আমরা স্মরণ করছি। মর্মস্পর্শী এ হত্যাকাণ্ডের আজ ৪৭ বছর পূর্ণ হলো। এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কেঁদে ফিরেছে প্রায় তিনযুগ। ঘটনার ৩৪ বছর পর বর্তমান সরকার প্রথম ক্ষমতায় আসার পর গত ২০১০ সালে প্রত্যক্ষ ঘাতকদের কয়েকজনের ফাঁসি হয়েছে। এতে কিছুটা হলেও জাতির গ্লানিমুক্তি ঘটেছে। তবে এখনো মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েকজন ঘাতক বিদেশে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক আসামী আবদুল মাজেদ ২০২০ সালের জুন মাসে গোপনে ভারত থেকে বাংলাদেশে আসার খবর পেয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাৎক্ষণিকভাবে তাকে গ্রেফতার করে দণ্ড কার্যকর করেছে। বাকি আরো যে কয়জন পলাতক আছেন তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া চলছে বলে সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, শিগগির তা প্রত্যক্ষ করা যাবে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, দেশের ইতিহাসে এতবড় একটি হত্যাকাণ্ড কেবল কয়েকজন খুনির কাজ ছিল না, এর নেপথ্যে ছিল দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। সেসব চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র কিন্তু আজো উন্মোচিত হয়নি, শনাক্ত হয়নি হত্যার ষড়যন্ত্রকারীরা, নেপথ্য নায়করা। ঘাতকদের লক্ষ্য ছিল শুধু বঙ্গবন্ধু পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করাই নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের বাংলাদেশকেই ধ্বংস করার। তাই তো ১৫ আগস্টের ধারাবাহিকতায় একই বছরের ৩ নভেম্বর কারা অভ্যন্তরে হত্যা করা হলো বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ রাজনৈতিক সহচর চার জাতীয় নেতাকেও। ’৭১-এর পরাজিত শক্তির প্রতিশোধ গ্রহণের যে প্রক্রিয়া সে সময় অঙ্কুরিত হয়েছিল তারই একটি ভয়ঙ্কর পরিণতি ঘটে ১৫ আগস্ট। স্বাধীন বাংলার স্থপতি ও জাতির পিতাকে হত্যার পর ক্ষমতা দখলকারী স্বৈরচার শাসক খুনিদের যাতে বিচার না হয় সেজন্য ইনডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি করে। স্বঘোষিত খুনিরা পরবর্তী সময়ে নির্বিঘেœ পালিয়ে থাকার সুযোগ পায়। এদের কেউ কেউ বিদেশে মিশনে চাকরি পেয়ে পুরস্কৃত হয়। ’৯৬-এ আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক দায়মুক্তি অধ্যাদেশ বাতিলের আগ পর্যন্ত ২১ বছর স্বঘোষিত খুনিরা বিচারের আওতা থেকে মুক্ত থাকার সুযোগ পেয়েছিল। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ই প্রথম এর বিচার কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৮-এ দায়রা জজ আদালতের দেয়া ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ডের রায় পরবর্তী সময়ে হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চে পুনর্মূল্যায়িত হয় এবং ১২ জনের মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয়। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে আপিল বিভাগে একজন বিচারকের অভাবে দীর্ঘ ৫ বছর ঝুলে থাকে মামলাটির আপিল শুনানি। পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর হাইকোর্টে আপিল বিভাগে একজন বিচারক নিয়োগের ফলে মামলাটির শুনানির পথ উন্মুক্ত হয় এবং পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে মামলাটির কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয় এবং এর চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয়। আগেই বলা হয়েছে, জাতির জনককে সপরিবারে হত্যা শুধু কিছু বিপথগামী সেনাসদস্যের কাজ নয়, এর নেপথ্যে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের কিছু তথ্য উঠে এসেছে দেশি-বিদেশি গবেষক সাংবাদিকদের লেখায়। দাবি উঠেছে একটি কমিশন গঠন করে এ ব্যাপারে পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করার এবং চক্রান্তকারীদেরও বিচারাধীন করার। গতকাল আইনমন্ত্রী এ বিষয়ে আশাবাদ জাগিয়েছেন। সরকার এ লক্ষ্যে এগিয়ে যাচ্ছে, কমিশন গঠনের প্রক্রিয়া প্রায় শেষের পথে।
১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড শুধু ব্যক্তি মুজিব ও তাঁর পরিবারকে হত্যার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এ নৃশংসতার পর ঘাতক সমর্থিত অবৈধ সরকার সংবিধান ছেঁটে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ধারায় ফিরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছে। সে ষড়যন্ত্র, সে অপচেষ্টা এখনো অব্যাহত রয়েছে। একই লক্ষ্য ও চক্রান্তেরর পথ ধরে গত ১৭ বছরে ঘটে গেছে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনার উপর ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলাসহ আরো কিছু হামলা-হত্যাকাণ্ড। কাজেই জাতীয় নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশকে সুরক্ষার জন্যই দরকার মুজিব হত্যা ষড়যন্ত্রের উন্মোচন ও তার মূলোৎপাটন। এছাড়া আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা, বঙ্গবন্ধু নেই; কিন্তু তাঁর আদর্শ আছে, তাঁর স্বপ্ন-প্রত্যাশা আছে, আছে তাঁর প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তাঁর আদর্শ তাঁর জীবন ও কর্মের মধ্যেই বিধৃত হয়ে আছে। তাঁর স্বপ্নের কথা, প্রত্যাশার কথাও কারো অজানা নেই। কী ধরনের দেশ ও সমাজ তিনি কামনা করতেন, তাঁর আত্মজীবনী পড়লে তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। তিনি স্বাধীন দেশ এবং শান্তি ও সহাবস্থানমূলক সমাজের প্রত্যাশা করতেন। এ প্রত্যাশা পূরণের জন্যই তিনি জীবনব্যাপী রাজনৈতিক লড়াই-সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। তিনিই আমাদের উপহার দিয়ে গেছেন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ। তিনি দেশকে সোনার বাংলায় পরিণত করার কাজ শুরু করেছিলেন, যা শেষ করে যেতে পারেননি। ঘাতকচক্র সে সুযোগ তাঁকে দেয়নি। সোনার বাংলা গড়তে সর্বাগ্রে প্রয়োজন ছিল জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। জাতীয় ঐক্য ও সংহতি নির্মাণে বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু সারাজীবন বঞ্চিত, নিপীড়িত, অধিকারহারা ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য রাজনীতি করে গেছেন। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও স্বপ্ন-প্রত্যাশা বাস্তবায়ন করতে হলে একনিষ্ঠভাবে তাঁর সেই দর্শন ও আদর্শ অনুসরণ করতে হবে। দৃঢ়তার সঙ্গে সেই স্বপ্ন-প্রত্যাশা হৃদয়ে লালন করতে হবে এবং কর্মের মাধ্যমে তার বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে।