‘বিদ্রোহে’ আওয়ামী লীগের হাতছাড়া ২৬ ইউনিয়ন

39

রাহুল দাশ নয়ন

চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়েছে আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহী দমনে সরকার দলীয় সংগঠনটি নিজেরাই নিজেদের প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এ পর্যন্ত পাঁচধাপে চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় ১৪০টি ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচন। এর ২৬ টিই হাতছাড়া হয়েছে আওয়ামী লীগের। দলীয় হাইকমান্ডের কড়া নির্দেশনার পরেও অধিকাংশ ইউনিয়নেই বিদ্রোহী প্রার্থী ছিল। দলীয় প্রার্থীদের প্রতি তৃণমূলে আনুগত্য প্রকাশ পায়নি। উল্টো প্রার্থীদের বিরোধিতা করেছেন প্রভাবশালী নেতারা। শুধু তাই নয়, নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে হাটহাজারী ও বোয়ালখালীতে বিএনপি সমর্থিত দুই স্বতন্ত্র প্রার্থী জয়ী হয়েছে।
দলের ‘সুসময়ে’ ইউপি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে তৃণমূলে শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ায় দলের শীর্ষ পর্যায়ে জোরালোভাবে আলোচনা হয়েছে। সাংগঠনিক সভাগুলোতে এ বিষয়গুলো নিয়ে দায়িত্বশীল নেতারা বারবার কথাও বলেছেন। যে কারণে বিদ্রোহীরা জয়ী হওয়ার পেছনের কারণ উদ্ঘাটনের জন্য দলের দায়িত্বশীল নেতাদের নির্দেশনা দেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ নির্দেশনা পেয়ে বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীল নেতারা বিদ্রোহীদের জয়ের পাঁচটি কারণ অনুসন্ধানে নেমেছে।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পাদকমন্ডলীর এক নেতা বলেন, আওয়ামী লীগ ত্যাগ ও যোগ্যতাকে বিবেচনা করে তৃণমূলের সুপারিশের ভিত্তিতে গ্রহণযোগ্য প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। এরপরেও বিভিন্ন এলাকায় দলীয় প্রার্থীর পরাজয় দলের জন্য অশনী সংকেত। বিদ্রোহীরা জয়ের পেছনে অনেকেরই হাত আছে। বহু ইউপিতে দলীয় প্রার্থীকে পরাজিত করতে কাজ করেছে দলের দায়িত্বশীল নেতারাই। বিদ্রোহীদের জয়ের পেছনে সুষ্পষ্ট কিছু কারণ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রীর কাছে দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সেখানে যারাই দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করেছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশও থাকবে’।
চট্টগ্রামে গত ২০ সেপ্টেম্বর প্রথম ধাপে স›দ্বীপে ১২টি ইউনিয়নে নির্বাচন হয়। সেখানে দুইটিতে দলীয় নৌকা প্রতীকের প্রার্থীকে পরাজিত করে আমানউল্লাহ ইউনিয়নে আনারস প্রতীকে সাইফুল ইসলাম ও আজিমপুরে মো. রকি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।
দ্বিতীয় ধাপে ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৩৭ ইউনিয়নের মধ্যে ফটিকছড়িতে পাঁচটিতে বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এরা হলেন বাগানবাজার ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহাদাত হোসেন সাজু, নারায়ণহাট ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবু জাফর মাহমুদ, হারুয়ালছড়ি ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী ও বর্তমান চেয়ারম্যান ইকবাল হোসেন চৌধুরী, পাইন্দং ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী একেএম সরোয়ার হোসেন স্বপন এবং জাফতনগর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী জিয়া উদ্দিন জিয়া।
তৃতীয় ধাপে গত ২৮ নভেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে ৪০টি ইউপির মধ্যে আটটিতে দলীয় প্রার্থী পরাজিত হন। এরমধ্যে হাটহাজারীতে ছয়টি ও রাঙ্গুনিয়ায় দুইজন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। হাটহাজারী ২নং ধলই ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. আবুল মনসুর, ৫নং নাঙ্গলমোড়া ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী হারুনুর রশিদ, ৬নং ছিপাতলী ইউপিতে বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী নুরুল আহসান লাভু, ১৪নং শিকারপুর ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল খালেক, ১৫নং বুড়িশ্চর ইউপিতে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. জাহেদ হোসেন, লালানগরে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী রফিকুল ইসলাম তালুকদার, বেতাগী ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী শফিউল আলম নির্বাচিত হয়েছেন।
চতুর্থ ধাপে গত ২৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত ২৭ ইউপি নির্বাচনে ছয়জন বিদ্রোহী প্রার্থী জয়ী হয়েছেন। পটিয়ার হাইদগাঁও ইউনিয়নে বদরুদ্দিন মো. জসিম, কুসুমপুরা ইউনিয়নে জাকারিয়া ডালিম, কোলাগাঁও ইউনিয়নে মাহাবুবুল হক, জঙ্গলখাইন ইউনিয়নে মোহাম্মদ সাহাদাত হোসেন সবুজ নৌকার প্রার্থীকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছে। কর্ণফুলীর শিকলবাহায় আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম, লোহাগাড়ার চরম্বায় বিদ্রোহী প্রার্থী মৌলভী হেলাল উদ্দিন জয়ী হয়েছেন।
পঞ্চম ধাপে গত ৫ জানুয়ারি ২৪ ইউপিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পাঁচজন জয়ী হয়েছেন। আনোয়ারায় রায়পুর ইউনিয়নে আমিন শরীফ, বোয়ালখালী আহলা করলডেঙ্গায় বিএনপি নেতা স্বতন্ত্র প্রার্থী মোহাম্মদ হামিদুল হক, চন্দনাইশে কাঞ্চনগর ইউনিয়নে স্বতন্ত্র প্রার্থী আবদুল শুক্কুর, বরমা ইউনিয়নে খোরশেদ আলম টিটু, বরকল ইউনিয়নে আব্দুর রহিম জয়ী হয়েছেন।
সূত্র জানায়, পাঁচটি বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে বিদ্রোহীদের জয়ের কারণ অনুসন্ধান করছে আওয়ামী লীগ। এগুলো হলো- যিনি বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে বিজয়ী হয়েছেন তার এলাকায় ভূমিকা কি। তিনি আওয়ামী লীগের ত্যাগী, পরীক্ষিত নেতা কিনা। কত দিন ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছেন। ঐ বিদ্রোহী প্রার্থী কোন প্রেক্ষিতে এবং বাস্তবতায় বিদ্রোহী প্রার্থী হলেন। বিদ্রোহী প্রার্থী হওয়ার ফলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের মধ্যে কি রকম প্রতিক্রিয়া হয়েছে। বিদ্রোহী প্রার্থী কেনো বিজয়ী হলেন। আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী কেন পরাজিত হলেন সে ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান। বিদ্রোহী প্রার্থীর সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ের আওয়ামী লীগ এবং মন্ত্রী, এমপিদের সম্পর্ক কি এবং মন্ত্রী, এমপিদের ভূমিকা কতোটুকু ছিল। বিদ্রোহী প্রার্থীদের প্রতিদ্ব›িদ্বতার ফলে স্থানীয় পর্যায়ে জনগণের প্রতিক্রিয়া কি হয়েছে। জনগণ কেন বিদ্রোহী প্রার্থীকে ভোট দিল সে ব্যাপারে তথ্যানুসন্ধান করছে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল নেতারা।
জানা যায়, বিদ্রোহী প্রার্থীদের বিদ্রোহী হওয়ার পেছনে মূল কারণ হচ্ছে এলাকার রাজনৈতিক বিরোধ। এছাড়াও স্থানীয় পর্যায় থেকে যে ব্যক্তিদের নামগুলো কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে তারা জনপ্রিয় নয়। এমপি-মন্ত্রীরা তাদের পছন্দের ব্যক্তিদেরকে প্রার্থী করার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করেছে এবং সঠিক তথ্য কেন্দ্রের কাছে দেয়নি। অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়েছেন বর্তমান চেয়ারম্যানরা। এদের বেশিরভাগই গত পাঁচ বছরে তাদের জনপ্রিয়তা হারিয়েছেন। যার ফলে আওয়ামী লীগে যারা সত্যিকারের ত্যাগী, পরীক্ষিত তারা এটি মেনে নিতে না পেরে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক জায়গায় আওয়ামী লীগের দলীয় পদে আছে এমন ব্যক্তিরাই বিদ্রোহী প্রার্থীর পক্ষে কাজ করেছে। ফলে পরাজিত হয়েছে নৌকার দলীয় প্রার্থী।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ বিদ্রোহীদের দমন করতে নানা প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছে। কিন্তু কোথাও এর সফলতা মিলেনি। কোথাও কারণ দর্শানোর নোটিশ, কোথাও বহিষ্কার করা হয়েছে। এসবের পরেও বিদ্রোহীদের দমাতে পারেনি দলটি। বিদ্রোহীদের এমন জয় আওয়ামী লীগের তৃণমূলকে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে কাজ করতে উৎসাহিত করবে বলেই মনে করছেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা।
তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা বলেন, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ থেকে শুরু করে উপজেলা আওয়ামী লীগকে উপেক্ষা করে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের তালিকা তৈরি, তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে বিরোধ, দল থেকে বহিষ্কৃত ও বিতর্কিত নেতা-কর্মীদের নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের যোগসাজশের কারণেই দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নেয় তৃণমূলের নেতা-কর্মীরা। এভাবে বিদ্রোহীরা জয় পাওয়ায় আগামিতে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ‘ইউনিয়ন ও উপজেলার সুপারিশ নিয়ে আমরা কেন্দ্রে নাম পাঠিয়ে দিই। মনোনয়ন ঘোষণার পর অনেকেই বিদ্রোহী প্রার্থী হচ্ছেন। আমরা তাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছি। কিন্তু স্থানীয়ভাবে যারাই বিদ্রোহীদের পক্ষ নিয়েছে তাদের তালিকা করা হচ্ছে। কেন্দ্র বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েই সাংগঠনিক কার্যক্রমে নেমেছে’।