বিদ্রোহীদের কাছে নৌকার পরাজয়ে বিব্রত আ.লীগ

33

রাহুল দাশ নয়ন

আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায়। দলের এক শ্রেণীর নেতারা নৌকায় চড়ে চেয়ারে বসতে মরিয়া। বিএনপি নির্বাচনে না থাকায় সেই প্রচেষ্টা দ্বিগুণ বেড়েছে তৃণমূলে। কিন্তু কেউ কাউকে ছাড় দিতে নারাজ। তফসিল ঘোষিত বেশিরভাগ ইউনিয়নেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা দাপট দেখিয়ে চলছেন। নির্বাচনে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করে বিজয়ীও হয়েছেন অনেকে। এতে আওয়ামী লীগের দলীয় ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হলেও তা নিয়ে যেন কারোও মাথাব্যথা নেই। উল্টো কোথাও কোথাও নৌকার এমপিদের সবুজ সংকেতেও পরাজিত হয়েছেন চেয়ারম্যান পদের নৌকার প্রার্থীরা। নৌকার এমন পরাজয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছেন আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের কাছে দলীয় প্রার্থীদের এমন পরাজয় ভাবিয়ে তুলেছে হাইকমান্ডকে। আগামীকাল অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া দলীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় এ বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হতে পারে। এমনকি দেশের অনেক জায়গায় ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রতীক তুলে দিতে আওয়ামী লীগের দপ্তরে আবেদনও জমা পড়েছে। বিতর্কিত ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়ার কারণেই তৃণমূলে এমন দাবি উঠেছে। যদিও বিতর্কিতদের নাম পাঠানোর সাথে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কথাও বলছে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সিংড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে বলেন, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ত্যাগী কর্মীদের নাম বাদ দিয়ে অপকর্মকারীদের নাম কেন্দ্রে পাঠালে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যারা দলের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে কাজ করছেন এবং বিদ্রোহী প্রার্থীদের উস্কানি দিচ্ছেন তাদের তালিকা তৈরি হচ্ছে। সময় হলেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়া হবে।
দলীয় প্রতীক নিয়ে টানাটানির এমন সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে ‘মনোনয়ন বাণিজ্য’। তৃণমূলের নেতারা মনোনয়ন বাণিজ্য করেই বিতর্কিত লোকদের মনোনয়ন পাইয়ে দিতে কারসাজি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। যে কারণে কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করেই ইউপি নির্বাচনে বিদ্রোহীরা প্রার্থী হচ্ছেন। তৃণমূলের নেতাকর্মীরা এতে দ্বিধাবিভক্তি হয়ে পড়েছেন। এমনকি আওয়ামী লীগের ঐক্যের প্রতীক নৌকার বিরুদ্ধেও অবস্থান নিতে দ্বিধাবোধ করছেন না তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। এতে দলীয় শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়েছে। যা আগামীতে দলের সাংগঠনিক কাঠামোয় বড় ধরনের প্রভাব পড়বে বলেই মনে করা হচ্ছে। যদিও বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করা নেতাদের আগামীর রাজনীতির পথরুদ্ধ করার কথাই বলছেন দায়িত্বশীল নেতারা।
চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মফিজুর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় যাতে কোন বিদ্রোহী প্রার্থী না থাকে সেজন্য কাজ করছি। আশা করি কোন বিদ্রোহী প্রার্থী চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় থাকবে না। আমরা অতীতেও যারা বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করেছে তাদেরকে বহিষ্কার করেছি। এবারোও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ নির্বাচন করলে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিব। তাদের আগামীর রাজনীতির দুয়ারই এক প্রকার বন্ধ হয়ে যাবে।
চন্দনাইশ আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহেদুল ইসলাম চৌধুরী জাহাঙ্গীর ও সাধারণ সম্পাদক আবু আহমদ ঝুনু পূর্বদেশকে বলেন, দলীয় প্রতীক রাখা না রাখার বিষয়টি কেন্দ্রের এখতিয়ার। আমরা নৌকার পক্ষেই। নৌকা আমাদের স্বাধীনতার প্রতীক। নির্বাচনে নৌকা থাকলেই আওয়ামী লীগের শক্তি বাড়ে। চন্দনাইশে যারাই প্রার্থী হতে চাইবে সবার নাম পাঠানো হবে। কেন্দ্রই সিদ্ধান্ত নিবে কে যোগ্য প্রার্থী। এখনো পর্যন্ত বিদ্রোহী প্রার্থী দেখা যাচ্ছে না।
বৃহত্তর চট্টগ্রামে দুই ধাপে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে ৩২ জন বিদ্রোহী প্রার্থী আওয়ামী লীগের দলীয় প্রার্থীদের পরাজিত করে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। কোন কোন জায়গায় আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থীদের দ্বৈরথে চেয়ারম্যান হয়েছেন বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থীও। আবার দলীয় মনোনয়ন পেলেও পরাজিত হয়ে জামানত হারিয়েছেন কোন কোন প্রার্থী। এমন অবস্থাতেও নৌকার পক্ষেই আস্থা রাখতে চান আওয়ামী লীগ নেতারা।
কক্সবাজারের রামু উপজেলায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া ১১টি ইউপির মধ্যে সাতটিতেই পরাজিত হয়েছেন নৌকার প্রার্থীরা। চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া ১২টি ইউনিয়নের মধ্যে পাঁচটিতেই বিদ্রোহী প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। কক্সবাজার সদরে একটি, কাপ্তাইয়ে একটি, উখিয়ায় একটি, মাটিরাঙ্গায় দুটি, বরকলে তিনটি, বিলাইছড়িতে একটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। এছাড়াও স্থগিত থাকা হলদিয়া পালং ইউপিতেও স্বতন্ত্র প্রার্থী এগিয়ে আছেন। প্রথম ধাপে অনুষ্ঠিত হওয়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের ১১টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীরা পরাজিত হন। সেখানে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের পাশাপাশি বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত প্রার্থীরাও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন।
ভোটাররা জানায়, অযোগ্য প্রার্থী বাছাই, নেতাদের মধ্যে বিরোধ, পছন্দের প্রার্থীর পক্ষ নিতে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর বিরোধিতা করা ও বিদ্রোহী দমানোয় দায়িত্বশীল নেতাদের ব্যর্থতার কারণেই বেশিরভাগ প্রার্থী পরাজিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। এমন অবস্থার মধ্যেও তৃতীয় ধাপে অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ও হাটহাজারীর ইউপি নির্বাচনে প্রায় ২০ জন বিদ্রোহী প্রার্থী মাঠে আছেন। যারা রীতিমত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে নির্বাচনী মাঠে সরব আছেন।
চট্টগ্রাম উত্তর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ আতাউর রহমান পূর্বদেশকে বলেন, ফটিকছড়িতে দলীয় প্রার্থীদের পরাজয়ে পেছনে নেতাদের সমন্বয়হীনতাই দায়ী। এ দায় আমাদেরও। আমরাই সেখানে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারি নাই।
হাটহাজারী আওয়ামী লীগের সভাপতি এডভোকেট মোহাম্মদ আলী পূর্বদেশকে বলেন, বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে কেন্দ্রকে জানিয়েছি। কেন্দ্র ব্যবস্থা না নিলে আমাদের করার কিছু থাকে না।