বিদ্যুৎবিহীন সাড়ে ৭ ঘণ্টা

28

মনিরুল ইসলাম মুন্না

জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয় দেখা দেওয়ায় গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামসহ দেশের চার বিভাগ দুপুর ২টা ৪ মিনিট থেকে বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। প্রায় সাড়ে সাত ঘণ্টা পর সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিটের দিকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। যমুনা নদীর এপারের (প‚র্বাঞ্চলের) জেলাগুলোয় বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের এ ঘটনা ঘটেছে। এসময় চট্টগ্রামের পাশাপাশি ঢাকা, সিলেট ও ময়মনসিংহ বিভাগে বিদ্যুৎ ছিল না।
গতকাল রাত দশটায় এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত নগরীর বিস্তীর্ণ এলাকায় বিদ্যুৎ পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়নি। শুধু ‘অগ্রাধিকার’ বিবেচনায় হাসপাতাল, সংবাদপত্রসহ জরুরি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়।
বিদ্যুতের এমন বিপর্যয়ে তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু।
এদিকে দুর্গাপূজা চলাকালীন বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটায় সতর্ক অবস্থানে ছিল চট্টগ্রাম নগর পুলিশ (সিএমপি)। সিএমপি’র অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আ স ম মাহতাব উদ্দিন পূর্বদেশকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সন্ধ্যা ৭টা ২০ মিনিট থেকে ধীরে ধীরে সাবস্টেশনে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। বিষয়টি পূর্বদেশকে নিশ্চিত করেন, পিডিবি দক্ষিণাঞ্চলের প্রধান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম। তিনি বলেন, সঞ্চালন লাইনে কোনো একটা ত্রæটির কারণে এ বিপর্যয় ঘটেছে। তবে কি কারণে বিদ্যুতের এমন বিপর্যয় তা এখনও জানা যায়নি।
জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের ঘটনা খতিয়ে দেখতে বিদ্যুৎ বিভাগকে দুটি তদন্ত কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু। গতকাল বিকেলে প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু জানান, বিদ্যুৎ বিভাগের একটি এবং তৃতীয়পক্ষের অপর একটি কমিটি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণ খুঁজে বের করতে কাজ করবে। এদিকে গতকাল বিদ্যুতের বিপর্যয় চলাকালীন গুজব না ছড়িয়ে জনগণকে ধৈর্য ধরার অনুরোধ করেন তথ্য-যোগাযোগ ও প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক। নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক আইডিতে দেয়া এক পোস্টে সন্ধ্যায় তিনি বলেন, ‘ঢাকার আমিন বাজার গ্রিড পর্যন্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হয়েছে। পাওয়ার গ্রিডে ট্রিপ এক সেকেন্ডে হলেও রিস্টরেশন অনেক লম্বা আর জটিল প্রসেস। রাত ৮ টার মধ্যে ঢাকা শহরের সব এলাকা এবং ৯টার মধ্যে চট্টগ্রামের সব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।
গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ে বিঘ্নিত হয় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে গেলে এমন দৃশ্যের দেখা মেলে। অসুস্থ রোগী ও স্বজনেরা গরমে অতিষ্ঠ হয়ে পড়েছেন। কাউকে কাউকে হাতপাখা ও কাগজ দিয়ে রোগীকে বাতাস করতে দেখা গেছে।
চমেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. শামীম আহসান পূর্বদেশকে বলেন, রোগীদের সেবা দেয়ার জন্য আমাদের ১১৫০ কিলোওয়াটের চারটি জেনারেটর আছে। সেখান থেকে তিনটি দিয়ে জরুরি বিভাগসহ অন্যান্য ওয়ার্ডের কার্যক্রমগুলো চালানো হয়েছে। বাকিটা আইসিউ, সিসিইউর জন্য রিজার্ভ রেখে সেবা দিয়ে যাচ্ছি। এদিকে বিদ্যুৎ না থাকাতে ভোগান্তিতে পড়েছে মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকেরা। সমস্যা দেখা দেয় মোবাইল নেটওয়ার্কে। বেড়ে যায় কলড্রপ। ইন্টারনেটের গতি কমে যায়। একই সাথে দুর্ভোগ দেখা দেয় সিএনজি রিফুয়েলিং স্টেশনে।
সিএনজি গ্যাস নিতে আসা মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, দুপুর তিনটা থেকে লাইনে অপেক্ষা করছি। বিদ্যুৎ না থাকায় মেশিন বন্ধ। সামনেও যেতে পারছি না, পেছনেও যেতে পারছি না। আজকে (মঙ্গলবার) আয়-রোজগার একেবারেই বন্ধ হয়ে গেল।
বিদ্যুৎ না থাকায় বিকেল ৫টার দিকে এক হাজার বিটিএস (মোবাইল টাওয়ার) এর সেবা বিঘিœত হয়েছে। আরও কয়েক হাজার বিটিএস ঝুঁকির মধ্যে ছিল। কারণ বিকল্প উপায়ে বিটিএসগুলো দুই-তিন ঘণ্টা চালু রাখা যায়। এর মধ্যে বিদ্যুৎ না এলে মোবাইল ও ইন্টারনেট সেবায় বড় ধরনের বিপর্যয় দেখা দেয় বলে জানান টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) ভাইস চেয়ারম্যান সুব্রত রায় মৈত্র। এছাড়া হুমকিতে পড়ে ইন্টারনেট সেবা প্রদানও। নেটের ব্যবহার কমে যায়।
বিদ্যুৎ না থাকায় নগরীতে সন্ধ্যার পর থেকে সড়কগুলো হয়ে পড়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন। মাঝেমাঝে চলাচলরত গাড়ির বাতির আলোয় সড়কগুলো কিছুটা আলোকিত হলেও তা সাময়িক। গাড়ি চলে যাওয়ার পর সড়ক আবারও অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যায়।
উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে পোশাক কারখানার। উদ্যোক্তারা জানান, আজ (মঙ্গলবার) অন্যান্য দিনের মতোই পোশাক কারখানাগুলো বিকেল ৫টা পর্যন্ত খোলা ছিল। বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের কারণে দুপুর ২টার পর থেকে জেনারেটর দিয়ে চালানো হয়েছে। এতে খরচ বাড়লেও কমেছে পণ্যের মান।
বিজিএমইএ’র সহ-সভাপতি আকিবুল আলম চৌধুরী বলেন, গত তিনমাস ধরে এমনিতে লোডশেডিং এর কারণে ৩-৪ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না। অর্ডার না থাকায় ফ্যাক্টরিতে খুব একটা কাজ নেই। তাই তেমন কোনো প্রভাব পড়েনি।
ইন্টারনেট সমস্যার কারণে অনলাইন ব্যাংকিং সেবা বিঘ্নিত হয়েছে। দুপুরের পর থেকে ব্যাংকের গ্রাহকরা অনলাইনে কোনো ধরনের লেনদেন করতে পারেননি। কারণ সার্ভারে বিদ্যুৎ সরবরাহ না থাকার কারণে তা বন্ধ হয়ে যায়। ব্যাংকিং আওয়ার শেষে এটিএম বুথগুলোও কাজ করেনি। ফলে টাকা উত্তোলন করতে আসা গ্রাহকরা ভোগান্তিতে পড়েন।
মোমিন রোডে একটি বেসরকারি ব্যাংকের বুথ থেকে টাকা উত্তোলন করতে আসা এক গ্রাহক প‚র্বদেশকে বলেন, বিদ্যুৎ না থাকায় সিকিউরিটি গার্ড বুথের ভেতরেই ঢুকতে দেয়নি। গার্ড বলেছে অন্ধকারে যাওয়া যাবে না। বিদ্যুৎ এলে টাকা ওঠাবেন।
এছাড়া নগরীর বহুতল ভবনের বাসিন্দারাও দুর্ভোগের শিকার হন। তেল ফুরিয়ে যাওয়ায় অনেক ভবনের জেনারেটর বন্ধ হয়ে যায়। এতে গরমে বাসা-বাড়ির শিশু ও বয়োজ্যেষ্ঠদের ভোগান্তি বাড়ে। সাময়িক দুর্ভোগ লাঘবের জন্য আইপিএস, জেনারেটর থাকলেও ঘণ্টাখানেক পর তার মেয়াদও শেষ হয়ে যায়। আইপিএস’র চার্জ শেষ হয়ে যায় আর জেনারেটরের জ্বালানি তেল ফুরিয়ে যায়। ফলে ফিলিং স্টেশনগুলোতেও তেল নেয়ার জন্য দীর্ঘ লাইন তৈরি হয়।
এদিকে সন্ধ্যার সময় বিদ্যুৎ না থাকায় চরম আতঙ্ক দেখা দেয় পূজামন্ডপগুলোতে। কারণ এ সুযোগটাকে কাজে লাগিয়ে দুষ্কৃতিকারীরা কোনো অঘটন ঘটায় কিনা তা নিয়ে শঙ্কায় ছিলেন অনেক পূজার্থী। তবে এসময় নগর পুলিশ সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় ছিল বলে জানা যায়।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) আ স ম মাহতাব উদ্দিন পূর্বদেশকে বলেন, বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় নগরীর কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এছাড়াও প্রত্যেক প‚জামÐপে আমাদের টিম অবস্থান করছে। প‚জামÐপগুলোতে পোশাকধারী ও সাদা পোশাকে পুলিশ কাজ করে যাচ্ছে।