বিদ্যালয়ে সিলেবাস প্রণয়ন ও এতদ্বিষয়ক একটি প্রস্তাব

380

শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর অগ্রগতির যাচাইয়ের জন্যে মূল্যায়ন বা পরীক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আর পরীক্ষার পূর্বপ্রস্তুতির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে সিলেবাস। কারণ কোন এক শ্রেণিতে, কোন শিক্ষাবর্ষে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর, বিভিন্ন পরীক্ষায় বা মূল্যায়নের জন্যে, শিক্ষাক্রমের কতটুকু বিষয়বস্তু সংযোজনের প্রয়োজন, তারই বিভাজন অংশ হচ্ছে পাঠ্যসূচী বা সিলেবাস। এখানে শুধু প্রশ্নপত্র বিভাজন নয়; প্রশ্নের রূপরেখা, মানবন্টন সময়সীমা ইত্যাদি কি রকম, কিভাবে কতটুকু হতে পারে এই সম্পর্কে একটি সঠিক সুন্দর ও সুনির্দ্দিষ্ট দিক নির্দেশনা পাওয়া যায়।
আগে দেশব্যাপী প্রশ্ন প্রণয়ন করা হত উপজেলা ভিত্তিক শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে। তারা তাদের ও ছাত্রছাত্রীদের সুবিধার্থে সিলেবাস প্রণয়ন করে বিদ্যালয়ে সরবরাহ করত। এর আগে এনসিটিবি কর্তৃক সিলেবাস প্রদান করা হত। পরবর্তীতে উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তা ও নির্বাচিত শিক্ষক সমন্বয়ে গঠিত কমিটির মাধ্যমে, বিদ্যালয়ে ১ম সাময়িক ২য় সাময়িক ও বার্ষিক পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রনয়ন করে আসছিল। এই সময়েও অধিকাংশ উপজেলা বা থানায় পূর্বের নিয়ম মত সিলেবাস প্রদান প্রথা অব্যাহত থাকে। চলতি বছর সরকারের নীতি নির্ধারণি মহল থেকে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়, স্ব-স্ব বিদ্যালয় কর্তৃক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হবে, যা চলতি বার্ষিক পরীক্ষা থেকে কার্যকর করা হচ্ছে।
ও হো আচ্ছা, এতক্ষণ পর্যন্ত সিলেবাস নিয়ে যে স্তরের কথা বলছিলাম তা হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা স্তরের কথা, যা শুরুতেই বলা উচিত ছিল। যাই হোক, বলা উচিত হবে কিনা জানিনা, উপজেলা পর্যায়ে সিলেবাস প্রণয়নে একটি বড় ধরণের বাণিজ্য হয়ে থাকে, যা নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে কারো দ্বিমত নেই। আর সেটা হতে পারে প্রত্যক্ষভাবে কিংবা পরোক্ষভাবে, হতে পারে প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে। এখানে উল্লেখ্য, যেখানে অর্থ থাকে সেখানে সকলের দৃষ্টি থাকে; এতে করে পারস্পরিক মতানৈক্য হয়। যার ফলে সমস্যা দেখা দেয়, অতঃপর সৃিষ্ট হয় পক্ষ বিপক্ষ গ্রূপ।
উপরে একটি শব্দ ব্যবহার করেছি ‘বাণিজ্য’। এটি প্রায়োগিকক্ষেত্রে ভুল কিনা পুরোপুরি জানিনা। কারণ আমি মূলত বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র ছিলাম।
তবে ‘বিজ্ঞান’ বিষয়ের ছাত্র হিসাবে ‘বাণিজ্য’ বিষয় সম্পর্কে ক্ষুদ্র জ্ঞানে যত টুকু বুঝি তা সংজ্ঞায়িত করলে এই রকম, ক্রয় বিক্রয়ের সাথে লাভ ক্ষতির সম্পর্ক থাকলে বাণিজ্য বলে বা বাণিজ্য বলা যেতে পারে। এখানে দেখা যায়, কোন একটি উপজেলায় ১ম শ্রেণি থেকে ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত কমপক্ষে প্রায় ২৫ হাজার ছাত্রছাত্রী থাকতে পারে। যদি প্রতিটি সিলেবাসের মূল্য ১০ টাকা নির্ধারণ করা হয়, তাহলে অংকের হিসাবে দাঁড়ায় আড়াই লক্ষ টাকা। আর ছাপানো ও অন্যান্য খরচ বাবদ প্রতিটি সিলেবাস ৩ টাকা করে হলে মোট খরচ পঁচাত্তর হাজার টাকা। তাহলে (প্রাপ্ত আড়াই লক্ষ টাকা)-(ব্যয় পঁচাত্তর হাজার টাকা) = এক লক্ষ পঁচাত্তর হাজার টাকা আয় হয়ে থাকে। উপজেলা আয়তনে বড় বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বেশী হলে স্বাভাবিকভাবে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও বেশী হবে।
আর এতে করে টাকার পরিমান আরো বেশী হবে। সেই হিসাবে পুরো দেশে কোটি কোটি টাকা সিলেবাস খাতে দেয়া নেয়া হয়ে থাকে। আর এই টাকা শিক্ষক কল্যাণে, সমিতির প্রয়োজনে, অফিসের উপকরণে বা অন্য যে কোন খাতে ব্যয় করা হোক না কেন, এই টাকা কিন্তু অধিকাংশ দরিদ্র শিক্ষার্থীর টাকা। যেখানে সরকার প্রাথমিক শিক্ষাকে সার্বজনীন বাধ্যতামূলক ও অবৈতনিক হিসাবে ঘোষণা করেছে, সেখানে ৩ টাকার পাঠ্যক্রম বা সিলেবাস ১০ টাকা কেন হবে? সিলেবাস শিক্ষাক্ষেত্রে অপ্রয়োজনীয় উপকরণ নয়। এটির বহুমুুখী প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। সিলেবাস শিক্ষাক্ষেত্রে শেখানো এবং শিখন কার্যক্রম উভয়ক্ষেত্র পরিচালনায় সমান গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হিসাবে বিবেচিত। তাই এটির প্রয়োজনীয়তা যেমন রয়েছে, তেমনি ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের গুরুত্বও রয়েছে। অর্থাৎ ৩ টাকার সিলেবাস ৩ টাকার হওয়া বাঞ্চনীয়। এই পর্যন্ত যা বলা হলো তা পুরানো কথাবার্তা, কারণ এখন থেকে নতুনভাবে পরীক্ষার প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করবে নিজ নিজ বিদ্যালয় কর্তৃক।
সেই হিসাবে যদি সিলেবাস তৈরী করতে হয়, তাহলে স্কুল ভিত্তিক সিলেবাস তৈরী করতেই হবে। কারণ যারা প্রশ্ন প্রণয়ন করবে তারাই জানে কোথায় থেকে, কতটুকু, কিভাবে, মূল্যায়নের জন্যে বিষয়বস্তু নির্ধারণ বা সিলেবাসে অন্তর্ভূক্ত করতে হবে।
এখন কথা হচ্ছে, যেহেতু স্ব-স্ব প্রাথমিক বিদ্যালয় কর্তৃক প্রশ্নপত্র প্রণয়ন করতে হচ্ছে, তাই সিলেবাস যদি প্রণয়ন করতে হয়, তাহলে অবশ্যই স্ব-স্ব বিদ্যালয়কে সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্ব দিতে হবে। শুধু সিলেবাস নয়, সরকার কর্তৃক ঘোষিত নীতিমালা ঠিক রেখে পরীক্ষার রুটিনও নির্দ্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে নিজ নিজ বিদ্যালয়কে করতে দিতে হবে। কারণ বিদ্যালয় কেন্দ্রিক পরীক্ষা নিতে হলে এটাই হচ্ছে যৌক্তিক নিয়ম এবং যা উচিতও বটে।
লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক।