বিজয়ের হাসি

113

ডিসেম্বর মাস এলেই বাংলাদেশের সমীরণে বিজয়ের হাওয়া লাগে। বাঙালিমাত্র বিজয়ের সাধ হৃদয়ে অনুভূত হয়। তার ওপর পাকা ধানের উৎসবের সোনালী ঋতু হেমন্তের বিদায়ের পর বাংলার প্রকৃতিতে যোগ হয়েছে শীত। শীতের তীব্রতা ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। রকমারি সমীরণের শহরের অলিগলি ভাপা পিঠার সুমিষ্ট ঘ্রাণে মুখরিত।
স্কুল থেকে এইমাত্র বাসায় ফিরেছে সায়ীদ ও সায়েম। গা থেকে ইউনিফর্ম ছাড়িয়ে ঝটপট খবরের কাগজের ওপর ঝুঁকে পড়ে দুই ভাই। এ যেন পত্রিকা পাঠের এক অনবদ্য প্রতিযোগিতা। সায়ীদ নবম শ্রেণিতে পড়ছে। আর সায়েম দশম শ্রেণিতে।
সায়ীদ খেলাধূলার সংবাদ পড়তে মজা পায়। তাই প্রথমে খেলার খবরের পাতায় চোখ রাখে সে। অন্যদিকে সায়েমের পছন্দ দেশ-বিদেশের চলমান খবর। দু’জনের পছন্দ দুই বিভাগে হওয়ায় কোন সমস্যা বাঁধে না। ওরা নতুন কোন বিষয়ের সন্ধান পেলে তার উৎস জানার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।
সায়েম হঠাৎ বলে উঠলো,
-এই সায়ীদ দেখ, এখানে একটি দারুণ খবর লিখেছে।
সায়ীদ খুব উৎসাহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– কি লিখেছে?
– একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবনী নিয়ে দারুণ
প্রতিবেদন।
– ব্যতিক্রম কিছু?
– হ্যাঁ, সেরকমই। জাতির এই বীর সন্তান নাকি এখনও যেখানে যান সেখানের চারপাশ পানি ঢেলে ভিজিয়ে দেন।
সায়ীদ চোখ কপালে তুলে বলল,
– কি বলিস? বড় অদ্ভূত তো। উনার বাড়ি কোথায়?
– নোয়াখালীর হাতিয়া উপজেলায়।
– সামনে তো শীতকালীন অবকাশ যাপনের ছুটি পাবো। চল, আমরা সেই মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি গিয়ে এর কারণ জেনে আসি।
– বাবা কী যেতে অনুমতি দিবেন?
– বাবাকে ম্যানেজ করার দায়িত্ব আমার ওপর ছেড়ে দে।
– ঠিক আছে।
এদিকে অফিস থেকে বাসায় ফিরেন তাদের বাবা, গিয়াস উদ্দিন। একটি বেসরকারি বীমা কোম্পানিতে কাজ করেন। আয়-রোজগার মোটামুটি ভাল। ছেলেদের পড়াশুনার পাশাপাশি অনুসন্ধানী তৎপরতা তার ভাল লাগে।
বাবাকে দেখামাত্র দু’জনে দাঁড়িয়ে যায়। বাবা ওদের কাছাকাছি এসে বললেন,
– আমার খুদে গোয়েন্দারা, এমন গভীর মনোযোগ দিয়ে কি পড়ছিলে? আবার নতুন কোন বিষয় পেয়েছ নাকি?
সায়ীদ বাবার সামনে এসে মাথা নিচু করে অপরাধীর মতো হাত দুটো এক করে বলল,
– বাবা, আমরা একটি অনুসন্ধানী কাজ পেয়েছি। তোমার কাছ থেকে মুক্তিযুদ্ধের অনেক গল্পই তো শুনেছি। এবার ভিন্ন একটি বিষয় পেলাম। একজন মুক্তিযোদ্ধা নাকি স্বাধীনতা যুদ্ধ থেকে শুরু করে এখনও এদিকওদিক পানি ঢালেন। কিন্তু কেন? আমরা এর রহস্য জানতে চাই। তার জন্য আমাদের হাতিয়া যেতে হবে।
– হাতিয়া যাবে। সেতো ভাল কথা। সেখানে তোমাদের মেঝোফুপুর বাড়ি আছে। কিন্তু এখন তো তোমাদের স্কুল খোলা। কিভাবে যাবে?
পাশ থেকে সায়েম বলে ওঠলো,
– বাবা, সামনে আমাদের শীতকালীন অবকাশ যাপন উপলক্ষে ছুটি আছে। তখন গেলে কেমন হয়?
– হ্যাঁ, তাহলে তো কোন সমস্যা নেই। আমি সব ব্যবস্থা করছি। এখন যাও, রেডি হয়ে নাও। খেতে হবে।
-জ্বী বাবা। বলে দু’জনে ওয়াশরুমের দিকে চলে গেলো।
বৃহস্পতিবার। স্কুল টানা আঠারো দিনের শীতকালীন অবকাশ যাপনের ছুটি দিয়েছে। বাসায় এসে খাওয়া-দাওয়া সেরে ওরা বাবার জন্য অপেক্ষা করছে। অল্প কিছুক্ষণের মধ্য ওদের বাবা বাসায় ফিরলেন। তারপর ওদের কাছে ডেকে বললেন,
– এই নাও তোমাদের শীপের টিকিট। আগামীকাল তোমরা শীপে করে হাতিয়া যাবে। আমি তোমার ফুপার সাথে কথা বলে রেখেছি। উনি ঘাটে এসে তোমাদের জন্য অপেক্ষা করবেন।
টিকিট হাতে পেয়ে সায়ীদ ও সায়েমের সে কী আনন্দ!
পরদিন দুই ভাই সদর ঘাট হয়ে হাতিয়া পৌঁছলো। তারপর ফুপার সাথে ফুপার বাড়ি এসে বেশ আদরে আদরে একদিন কাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির দিকে রওনা দিলো। মুক্তিযোদ্ধার বাড়ির সম্মুখে পৌঁছতেই একজন বৃদ্ধলোক ওদের চোখে পড়ে। লোকটি জগভর্তি পানি চারিদিকে ছিটাচ্ছেন। পানি শেষ হলে পাশের পুকুর থেকে নিয়ে আবার পানি ছিটাতে লাগলেন। লোকটার পাশে আরো কয়েকজন দাঁড়িয়ে আছে। সায়ীদ আস্তে করে ফুপার কানে কানে জিজ্ঞেস করলো,
– আঙ্কেল, উনি কী সেই মুক্তিযোদ্ধা?
ফুপা সায়ীদের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– হ্যাঁ, উনিই দেশের বীর সন্তান।
বেশ কিছু সময় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মুক্তিযোদ্ধাকে কাছ থেকে দেখার পর পাশে দাঁড়িয়ে থাকাদের কাছে এলো। তারপর আঙ্কেল বললেন,
১৯৭১ এর পর থেকে উনি এভাবেই দিন অতিবাহিত করছেন। কারো সাথে কোন কথা বলেন না। তোমাদের কোনকিছু জানতে চাইলে উনার বড়ছেলে, স্বাধীনকে জিজ্ঞেস করতে পারো।
সায়েম নিজেদের পরিচয় ও এখানে আসার কারণ জানিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
– আচ্ছা, উনি এভাবে পানি ছিটাচ্ছেন কেন? এর পিছনের কাহিনী আমরা জানতে চাই।
স্বাধীন আর্দ্রকন্ঠে বলল,
– সেদিন ছিল রবিবার, ১৯৭১। শুনেছি, বাবা ছিলেন আমাদের এলাকার মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার। সেসময় আমাদের বাড়ির পাশের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি বাহিনী ক্যাম্প গড়েছিল। ওরা একেকদিন একেক বাড়িতে হানা দিচ্ছিল। ওদের ভয়ে অনেকে গ্রাম ছেড়ে পালিয়েও ছিল। বাড়িতে আমার মা ছাড়া আরেকজন ছিলেন আমার ছোটচাচা। তার বয়সও ছিল খুব কম। বাবার খুব প্রিয় ছিলেন আমার ছোটচাচা।
বাবা খুব পেরেশানি হয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে বাড়ি এসে মাকে বললেন,
‘কেউ ঘরের বাইরে বের হয়ো না। যেকোন মুহূর্তে মিলিটারিরা হানা দিতে পারে। আমরা ওদের ক্যাম্প চূড়ান্তভাবে উড়িয়ে দেবার প্রস্তুতি নিচ্ছি। নামাজ পড়ে দোয়া করো। যেন বিজয়ের হাসি নিয়ে তোমাদের কাছে ফিরতে পারি।’
এই কথা বলে বাবা ফের উনার সাথের মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে চলে গেলেন।
বাড়ি থেকে বাবার চলে যাবার মিনিট দশেকের মধ্যে আমাদের বাড়িতে একটি গাড়ি ঢুকে পড়ে। গাড়িতে নাকি আট/দশজন পাকিস্তানি আর্মি ছিল। তারা প্রথমে আমাদের ঘরে ঢুকে বাবাকে খোঁজ করে। বাবাকে না পেয়ে ঘরের বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাংচুর করে। তার আগে আমার মা ছোটচাচাকে সাথে নিয়ে স্টোররুমের দিকে লুকাচ্ছিলেন। পিছন থেকে ছোটচাচা মায়ের হাত ছেড়ে আমাদের প্রধান দরজার পিছনে গিয়ে লুকিয়ে যান। এরপর ছোটচাচা মিলিটারিদের হাতে ধরা পড়লে তারা নির্মমভাবে তাকে হত্যা করে চলে যায়। বাড়িতে মিলিটারিরা প্রবেশ করেছে শুনে বাবা ছুটে আসেন। এসেই দেখতে পান আমার ছোটচাচার রক্তমাখা নিথর দেহের পাশে বসে মা অঝরে কাঁদছেন। বাবা নাকি অনেকক্ষণ ধরে চাচার দিকে তাকিয়ে থাকার পর ঘরে গিয়ে এক জগ পানি নিয়ে আসেন। এরপর রক্তে ভেজা মাটিতে পানি ছিটাতে থাকেন। সেই থেকে অনেক চেষ্টা করেও বাবাকে পানি ছিটানো থেকে ফেরানো গেলো না। মায়ের কাছে শুনেছি, ঐ ঘটনার পর থেকে বাবা নাকি কারো সাথে কথা বলতেন না। একটুও হাসতেন না। শেষবার ১৯৭১ এর বিজয় দিবসে নাকি একটু হেসেছিলেন।
এই কথা বলে স্বাধীন কাঁদতে শুরু করে।