বিজয়ের মাসে আমাদের প্রত্যাশা

13

এমরান চৌধুরী

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিন নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক ও এস ফোর্সের ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন মেজর কে.এম. শফিউল্লাহ। তাঁর অধীনে যুদ্ধ করেন এক অকুতোভয় যুবক। দেশের প্রতি, মাতৃভূমির প্রতি, সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর প্রতি টান কতটা অতল হলে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে নিজেকে সমর্পণ করতে পারে একজন যুবক তা প্রত্যক্ষদর্শী ছাড়া সবার কাছে বিস্ময়ের বিষয় হয়ে থাকবে চিরদিন। ঘটনাটা ঘটেছিল ১৯৭১ সালের ২১ জুন। সেদিন সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চারটি ব্যাটেলিয়ান মুক্তিবাহিনীর ওপর এক সঙ্গে আক্রমণ চালায়। ‘আশ্চর্যের বিষয় সেদিন দুলু তার কোম্পানীর একটি মাত্র মেশিনগানের সাহায্যে পুরো এক ব্যাটেলিয়ন পাকিস্তানি বাহিনীকে থামিয়ে রেখেছিল। সে তার এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আক্রমণ চালাতে দেয়নি। অনবরত সে তার মেশিনগান দিয়ে গুলি চালানো অব্যাহত রেখেছিল। শত্রæ পক্ষের গুলি এসে তার পেটে লেগেছিল এবং গুলির আঘাতে তার এক পা ভেঙ্গে গিয়েছিল। আমি ওখানে গিয়ে দেখলাম যদি দুলু ওমনিভাবে অনবরত গুলি চালানো অব্যাহত না রাখত তবে তার পুরো কোম্পানীকেই পাকিস্তানি বাহিনী ঘিরে ফেলত। শুধুমাত্র তার একক প্রচেষ্টাতেই- আমার কোম্পানীটি ওখান থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিল। আমি দেখলাম শত্রুর গুলির আঘাতে দুলু মিঞার পেট চিরে রক্ত পড়ছে। এমনি অবস্হায়ও সে এক হাতে ফায়ার করছে এবং অপর হাত দিয়ে পেট চিপে রেখেছে। আমাকে দেখেই সে কেঁদে উঠল এবং বলল : স্যার আপনি যে আমাকে যুদ্ধ করার জন্য সুযোগ দিয়েছিলেন এজন্য আমি আপনার কাছে ঋণী। এই যে আমার গায়ের কাপড়টি আছে এটি অন্ততঃ শেখ মুজিবকে দেখাবেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তোমরা রক্ত দেওয়ার জন্য তৈয়ার হয়ে যাও।’ আমি রক্ত দিয়েছি, আমি মৃত্যুর পথে। (মেজর কে.এম. শফিউল্লাহ’র স্মৃতিচারণ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, আসাদ চৌধুরী, বাংলা একাডেমি, নভেম্বর ২০১৫, পৃষ্ঠা ৬১-৬২)
এই দুলা মিঞা নামে ছেলেটি যুদ্ধের জন্য প্রশিক্ষণ নিয়েছিল মাত্র দুই সপ্তাহ। মাত্র দুই সপ্তাহের প্রশিক্ষণে সে মোকাবেলা করেছে একটি শক্তিশালী বাহিনীর সঙ্গে। এসবই সম্ভব হয়েছে ছেলেটির বুকভরা দেশপ্রেমের সৌরভে। এমনি নিঃস্বার্থভাবে আত্মদান করেছে আমাদের অগণিত মুক্তিযোদ্ধা, অগণিত দুলামিঞা। তাঁদের সীমাহীন ত্যাগ ও আত্মদানের ফসল ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয দিবস। আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি তা কিন্তু হঠাৎ করে অর্জিত হয়নি। এর জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে বহুকাল। বছর নয়, যুগ নয়, প্রায় অর্ধ শতক। তার জন্য সহ্য করতে হয়েছে অনেক অত্যাচার। মোকাবেলা করতে হয়েছে অনেক ষড়যন্ত্রের। আর তাই এ বিজয় দিনের হাসির পেছনের দুঃখ কষ্ট আর ত্যাগের খবরটুকু আমাদের জানা দরকার। আমাদের নিজেদের প্রয়োজনে, শেকড় চেনার জন্য আমাদের অবশ্যই জানতে হবে কীভাবে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। কিভাবে ছিনিয়ে আনলাম টুকটুকে লাল সূর্যের দিন ১৬ ডিসেম্বর।
১৯৪৭ সালের কথা। দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পাক ভারত উপমহাদেশ ভেঙে দুটো স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। যার একটি আজকের ভারত, অন্যটি পাকিস্তান। পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে ১৪ আগস্ট। আর ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়া হয় ১৫ আগস্ট। দ্বি-জাতিতত্তে¡র ভিত্তিতে পূর্ব বাংলা পাকিস্তানের সাথে অঙ্গীভূত হয় যার নতুন নাম রাখা হয় পূর্ব পাকিস্তান। এ পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার মানুষ পাকিস্তানের সাথে একীভূত হলেও দুটো অংশের মধ্যে শুধু ধর্মের মিল ছাড়া আর কোনো বিষয়ে মিল ছিল না। মিল ছিল না ভাষায়, মিল ছিল না সংস্কৃতি ও সভ্যতায়। সর্বোপরি পূর্ববাংলার লোকসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের অন্য পাঁচটি প্রদেশের লোকসংখ্যার সমষ্টির চেয়েও বেশি। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের কথা যেখানে প্রাধান্য পাওয়ার কথা সেখানে স্বাধীকার অর্জনের ৮ মাসের মাথায় বাংলার মানুষকে উর্দুভাষী বানাবার অপপ্রয়াস শুরু হয়। ১৯৪৮ সালের ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান), ২৪ মার্চ কার্জন হলে পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর জেনারেল মুহম্মদ আলী জিন্নাহ গুটিকয়েক মানুষের ভাষা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেন। এ অপপ্রয়াসের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ ও তীব্র নিন্দা জানান বাংলার ছাত্রজনতা। ১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিম উদ্দীনও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। তাঁর এ ঘোষণার পর পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ও অসন্তোষ দেখা দেয়। ছাত্ররা ‘সর্বদলীয় ছাত্রসংগ্রাম’ পরিষদ গঠন করে ২১ ফেব্রæয়ারি ভাষা দিবস ও অন্যান্য কর্মসূচি ঘোষণা দেন। ঐ সময় পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন নুরুল আমিন। তিনি ২১ ফেব্রæয়ারির দিন ১৪৪ ধারা জারি করেন।
বিক্ষুব্ধ ছাত্র সমাজ ১৪৪ ধারা ভেঙে মিছিল বের করলে ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশ তাতে গুলি চালায়। এতে রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেক নাম না জানা ছাত্র জনতা শহীদ হন। এ ঘটনার পর মানুষের মনে স্বাধীকার স্পৃহা জেগে ওঠে। তারা বুঝে ফেলে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও পূর্ব বাংলার মানুষের প্রকৃত স্বাধীনতা পেতে আরও অনেক দূর হাঁটতে হবে। এর পর পাড়ভাঙার মতো ঘটতে থাকে একের পর এক ঘটনা। প্রত্যেক ঘটনাই বাঙালির স্বাধীকার অর্জনের পথকে এক এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। ১৯৫৪ সালে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট ধস নামানো বিজয় অর্জন করে। আর পাকিস্তানের লেজুড় দল মুসলিম লীগ লাভ করে মাত্র নয়টি আসন। যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষকপ্রজা পার্টির শের ই বাংলা এ কে ফজলুল হক এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালির মুক্তির সনদ ছয়দফা ঘোষণা করলে পূর্ব বাংলার মানুষের উপর নেমে আসে দমননীতি। এ দমননীতির ফলে সারা বাংলা হয়ে ওঠে উত্তাল। বাংলার মানুষের জনপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে সাজানো হয় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এ মিথ্যা মামলার প্রতিবাদে সারা বাংলাদেশ অগ্নিময় হয়ে ওঠে। এ আন্দোলন উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থান নামে খ্যাত। এ আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সরকার বাধ্য হয়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে নেয় এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে জেল থেকে সসম্মানে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। কারামুক্তির পর ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রæয়ারি বাংলার আপামর জনতা তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী ১৬৭ আসন পেয়ে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। নিয়ম অনুযায়ী একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকে সরকার গঠনের আহবান জানানোর কথা থাকলেও পাকিস্তান সরকার তা না করে তালবাহানা শুরু করে। সময় গড়াতে থাকে দ্রæত। নানা ঘটনা প্রবাহের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। তাতে তিনি বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণের উদ্যত আহবান জানিয়ে বজ্রকন্ঠে বলেন, ‘সাতকোটি মানুষকে দাবায়া রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এভাবে এক উত্তাল সময়ের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান সরকার ২৫ মার্চ মধ্যরাতে সেনাবাহিনী লেলিয়ে দেয় ঘুমন্ত মানুষের উপর। অন্যদিকে ২৫ মার্চ মধ্যরাতে, ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে শুরু হওয়া পাকিস্তানি হায়েনাদের বর্বরতার অবসান ঘটে ১৬ ডিসেম্বর ধলপহরে। পৃথিবীর মানচিত্রে সংযোজিত হয় আরেকটি দেশ-বাংলাদেশ। সব্যচাষী লেখক, কবি সৈয়দ শামসুল হক এ নতুন সূর্যোদয়কে অভিবাদন জানিয়ে লিখেছেন, ‘তোমাকে অভিবাদন, বাংলাদেশ। তুমি ফিরে এসেছ তোমার লাল সূর্য আঁকা পতাকার ভেতর। যার আলোয় এখন রঞ্জিত হয়ে উঠেছে সাহসী বদ্বীপ।’
এ সাহসী বদ্বীপের বুকে বিজয় পতাকা উড়েছে এক সাগর রক্তের বিনিময়ে। সীমাহীন ত্যাগ, নিরন্তর উদ্বেগ আর অনিশ্চয়তা শেষে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আসে বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের বিজয়। এ বিজয় তাই আনন্দ বেদনার এক মহাকাব্যের নাম।
আজকের শিশু আগামীদিনের ভবিষ্যৎ। এ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মাঝে লুকিয়ে আছে সোনার বাংলা গড়ার সোনার মানুষ। সৎ চরিত্রবান, মার্জিত, সুশিক্ষিত, কর্মঠ, দায়িত্বশীল মান্ষু মাত্রই সোনার মানুষ। ছোটদের মাঝে যদি এসব গুণাবলীর সমন্বয় ঘটে তাহলে কষ্টার্জিত বিজয় তথা স্বাধীনতা যেমন সংহত হবে তেমনি সোনার বাংলার স্বপ্নপূরণে আমরা এগিয়ে যাব অনেক দূর। এবারের বিজয়ের মাসে এ হোক সবার প্রত্যাশা।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক