বিচিত্র জীবন ও সময়ের সমীকরণ

31

মো. গোলাম দস্তগীর

বৈচিত্র্যপূর্ণ এ ধরণীতে রয়েছে নানা দেশ, নানান জাতি ও সংস্কৃতি। আছে অনেক প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম সৌন্দর্যে ঘেরা চিত্তাকর্ষক পরিবেশ এবং বৈচিত্র্যময় স্থান। এরি মাঝে আন্তঃজালে রয়েছে বিনোদনের মহাসম্মেলন। ঘড়ির কাঁটার মত চলছে জীবন; যাচ্ছে সময়! বিশ্বগ্রামে আজ মানুষজন জীবন নামক সামষ্টিক সময়ের সিংহভাগ ক্ষেপণ করছে অনলাইন ও অফলাইনের বিভিন্ন শাখায়। কি যুবক-বৃদ্ধ আবাল-বনিতা, সকলে যেন চিত্তাকর্ষণে মত্ত থাকা এক ঘুমন্ত পথিক। তবে জাগ্রত বিবেক আজও বিদ্যমান জ্ঞানার্জনে, চিন্তার দর্শন ও ফলিত দর্শনে জীব ও জগতকে নতুন করে দেখার; নতুন কিছু করার। জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার বিকাশে এ পৃথিবী নতুন রঙে সেজেছে। ফলে উন্নত জীবন যাত্রার অগ্রগতিও বেশ ত্বরান্বিত হয়েছে। সময়কে সময় দিলে সময়েই অসামান্য কিছু করার সুযোগ দিবে। পৃথিবীর কোনো শক্তিই সময়ের গতিশীলতাকে রোধ করতে পারে না। সময় কখনো থামতে জানে না, সে আপন গতিতে সদা চলমান। সময় কখনো ক্লান্ত হয় না, তাই তার বিশ্রামেরও প্রয়োজন নেই। এ জন্য গভীর চিন্তাশীল গবেষণাধর্মী সময়ানুরাগী মানুষরাই পৃথিবীতে স্মরণীয় বরণীয় হয়ে থাকে। যেমন, ঐতিহাসিকভাবে পূর্ণিমার চাঁদের ন্যায় উজ্জ্বল এক নক্ষত্র আল রাজি। চিকিৎসাবিজ্ঞানে যার অবদান অবিস্মরণীয়। চিকিৎসাশাস্ত্রে মুসলমান বিজ্ঞানীদের অবদানের কথা বলতে গেলে শুরুতেই তাঁর কথা বলতে হয়। তবে উনি শুধু চিকিৎসকই ছিলেন না, ছিলেন একাধারে গণিতবিদ, রসায়নবিদ ও দার্শনিক এবং তিনি পেডিয়াট্রিকস, অফথ্যালমোলজি, নিউরোসার্জারি ও সংক্রামক রোগসহ চিকিৎসাবিদ্যার অনেক শাখার গোড়াপত্তন করেন।
আল রাজির সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অবদান ছিল, তিনি কমবেশি ২০০ কিতাব রচনা করেন। এর মধ্যে চিকিৎসাশাস্ত্রেই তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ১০০। আল রাজির সবচেয়ে বড় কীর্তি হচ্ছে তিনিই প্রথম রেটিনার স্তর আবিষ্কার করেন ১০ টি। আর বসন্ত ও হাম সম্পর্কে ‘আল জুদারি ওয়াল হাসবাহ’ নামক পুস্তক রচনা করে এতে গুটি বসন্ত ও হাম রোগের লক্ষণের সঠিক বিবরণ ও পার্থক্য লিপিবদ্ধ করেন; যা তাঁর বিরল প্রতিভার স্বাক্ষর বহন করে। ওই পুস্তক ইংরেজি, লাতিন ও ইউরোপীয় অন্য ভাষায় অনুবাদ হয়। তাঁর চিকিৎসাবিষয়ক গ্রন্থের মধ্যে ‘এল হাওয়াই’ সবচেয়ে বেশি উল্লেখযোগ্য। এ গ্রন্থটি ‘লিবার কন্টিনেন্স’ নামে লাতিন ভাষায় অনুবাদিত হয়েছিল। আল রাজির চিকিৎসাবিষয়ক আরেকটি ছোট গ্রন্থ ‘মানসুরি’ বা ‘লবার আলমানসোরিস’। এটি তিনি মানসুর ইবনে ইসহাক নামের জনৈক শাসককে উৎসর্গ করেছিলেন। উক্ত গ্রন্থটিতে ভ্রমণকারীর জন্য চিকিৎসা উপদেশ, বিষাক্ত প্রাণীর দংশনের প্রতিকারসহ অন্যান্য বিষয় আলোচনা করেছেন।আল রাজি চিকিৎসা ও দর্শন ছাড়াও জ্যোতির্বিদ্যা, জ্যামিতি, খনিজবিদ্যা, ব্যাকরণ সহ প্রভৃতি বিষয়ে অনেক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
তেমনি আরেকজন নক্ষত্র হলেন আবু নসর আল ফারাবি। তিনি তার অমর কীর্তির জন্য বিশ্ববাসীর হৃদয়ে অমর হয়ে আছেন। অজানাকে জানার এবং অজেয়কে জয় করার প্রবল আকাঙ্খা ছিল তার হৃদয়ে। তাই তিনি জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় কাটিয়েছেন পুরো জীবন। জ্ঞানের সন্ধানে ছুটে চলেছেন দেশ হতে দেশান্তরে। এক সময় মুসলিমদের জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা কোনো দিকে কম ছিল না। সে সময়ে সারা বিশ্বের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ছিল মুসলিমদের কাছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য এবং সভ্যতায় মুসলমানরা ছিল উন্নত ও শ্রেষ্ঠ। তবুও নাক উচুঁ স্বভাবের ইউরোপীয় পÐিতরা বিশ্ববিখ্যাত মুসলিম বিজ্ঞানী ও দার্শনিকদের নাম সেভাবে উপস্থাপন করেনি। তারপরও আল ফারাবি ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য। তিনি দর্শন ছাড়াও যুক্তিবিদ্যা ও সংগীতের ন্যায় জ্ঞানের বিস্তর শাখায় অবদান রাখেন। তিনি একজন খ্যাতনামা দার্শনিক ও বহুভাষাবিদ পÐিত। উনি প্রায় ৭০টি ভাষা জানতেন। আর সেজন্য আরবরা তাকে ‘হাকিম সিনা’ বলতো। বলা বাহুল্য যে এ মহীতে যাদের নামই স্বর্ণাক্ষরে খোদিত আছে সকলই পৃথিবীর নান্দনিক বৈচিত্রে গা এলিয়ে জীবনাতিবাহিত করেননি। সময়ের সুষম ব্যবহার ও জ্ঞানার্জনে গভীর আত্মনিয়োগ করেছেন এবং জগতবাসীর জন্য রেখে গেছেন অনেক কিছুই। যার ফলে তারা আজ দেশ বিদেশে খ্যাতির উচ্চ আসনে সমাসীন। বিজ্ঞানের যুবরাজ খ্যাত এমনি আরেক বিস্ময়ের নাম আবুল আলী ইবনে সিনা। যিনি মাত্র ১০ বছর বয়সে কুরআনের হিফজ শেষ করেন! যার সময় ও জ্ঞানানুরাগের কথা শুনলে চমকে যেতে পারে যে কেউ! আরো চমকে উঠবেন জানলে, বোখারার আমিরকে সুস্থ করে তোলার বিনিময়ে কী চেয়েছিলেন তিনি। ঘটনাটি তাহলে বলা যাক। উনার বয়স যখন মাত্র ১৮; তখন হঠাৎ একবার আমিরের গুরুতর ব্যাধি হলো। অভিজ্ঞ ডাক্তার-হেকিম সবার চিকিৎসা-ই ব্যর্থ হলো। ইবনে সিনা তখন বললেন, আমি একটু চেষ্টা করে দেখি? পরে অনুমতি পেয়ে তার চিকিৎসায় যখন আমির সুস্থ হয়ে উঠলে, তিনি তাকে পুরস্কৃত করতে চাইলেন। এমন সময় পুরস্কার হিসেবে ইবনে সিনা জানালেন, তার চাওয়া হচ্ছে প্রাসাদের ভেতরে যে বিশাল গ্রন্থাগারটি আছে, সেখানে প্রবেশাধিকার ও অধ্যয়নের সুযোগ। আমির অনুমতি দিলেন। পরবর্তী দিনগুলোতে ইবনে সিনা উদয়াস্ত হয়ে অধ্যয়ন শুরু করেন। অবশ্য কিছুদিন পর আগুনে সে গ্রন্থাগারটি পুরোপুরি ভস্মীভূত হয়ে যায়। কৈশোরে একবার এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স পড়তে গিয়ে প্রথমেই ধাক্কা খান তিনি। কিছুই বুঝতে পারছেন না। বোঝার জন্যে শুরু করলেন দর্শন পড়া। তাও কঠিন। দেড় বছর টানা দর্শন নিয়ে পড়ে থাকেন। কথায় আছে, এসময় পড়তে পড়তে ইবনে সিনা যখন কিছুই বুঝতে পারতেন না বলে মনে হতো তখন সোজা বই রেখে উঠে দাঁড়াতেন। অজু করে চলে যেতেন মসজিদে। এরপর প্রার্থনায় নিমগ্ন থাকতেন যতক্ষণ না সমাধান পেতেন বা বুঝতে পারতেন বলে মনে হতো। একাধিক্রমে চল্লিশ বার উনি এরিস্টটলের মেটা ফিজিক্স অধ্যয়ন করেন। পড়তে পড়তে বাক্য এমনকি শব্দগুলোও পর্যন্ত তার মুখস্ত হয়ে ছিল। কিন্তু দুর্বোধ্যতা কমেনি তবুও। শেষ পর্যন্ত একদিন ঘটনাচক্রে তিনি ক্রয় করেন আল ফারাবীর একটি বই। তিন দিরহাম দামের এই বইটিতে দার্শনিক আল ফারাবী এরিস্টটলের মেটাফিজিক্সের উপর তার একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণী মন্তব্য তুলে ধরেছিলেন। আর সেটা পড়তেই ইবনে সিনার কাছে পুরো দর্শনটি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে যায়। কৃতজ্ঞতায় তিনি এতটাই আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন যে সাথে সাথে ছুটে যান মসজিদে গ্রষ্টার কাছে আর শুকরিয়া জানাতে। আবার শুকরিয়া স্বরূপ দরিদ্রদের মাঝে দানও করেছিলেন তিনি। তিনিই সে মনীষী যাকে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক বলা হয়। তাই বুঝাই যাচ্ছে খ্যাতিগুলো এমনি এমনি আসেনি বরং এর পিছনে সময়ের সঠিক ব্যবহার ও জ্ঞানার্জনের ভালোবাসাই মুখ্য।
সমসাময়িকভাবে এমন জ্ঞান সমুদ্রে বিচরণকারী এবং সময়নিষ্ঠ ফুলের সন্ধান পাওয়া দুষ্কর হলেও সুভাষ পেয়েছি একজনের মাঝে। আমার দেখা তিনিই একমাত্র ব্যক্তি যিনি বইয়ের সাথে আঠার মত লেপ্টে থাকে সর্বক্ষণ। বই ও তার মাঝে কি যে প্রেমালাপ হয় তা ঠিক জানিনা। তবে এ ফুলের নির্যাসে জাতি কিছু পাবে সে প্রত্যাশি। শীঘ্রই শক্ত হাতে কলম ধরে অব্যক্ত সে প্রেম কাহিনী প্রকাশ করবে বলে আশাবাদি। আয়নার আড়ালে লুকিয়ে থাকা সে মহান মানুষটি হলেন চট্টগ্রাম মহানগরের ঐতিহ্যবাহী শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপিঠ সরকারি সিটি কলেজের ইসলামের ইতিহাস সংস্কৃতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক তানভীর মুহাম্মদ চৌধুরী। সবচেয়ে অবাক করা বিষয় এই যে, মানুষটির আজও নেই কোনো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক ও টুইটার আইডি! বিশ্বগ্রামে যেকালে মানুষগণ জীবন নামক সামষ্টিক সময় ব্যয় করছেন নানাদিকে এবং উপভোগ করছেন বৈচিত্র্যময় জীবন। সেকালে তিনি পড়ে আছেন, মৌলিক সকল কাজ, পাঠদান ও জ্ঞানগৃহে বইয়ের সাথে আড্ডাবাজিতে নিমজ্জিত হয়ে। বইয়ের সাথে কথা বলা এ যেন তার অমৃত সুধা পানের চেয়েও মধুময়। সুন্নাহ সম্মত জীবন যাপন ও গুছানো এমন একটি মানুষ এ কালে পাওয়া সত্যিই বিরল! তাই জ্ঞানার্জনে,চিন্তা ও গবেষণায় সময়ের মূল্যায়ন অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। প্রসঙ্গত আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যারা অনুসন্ধানপ্রিয় অথবা যারা কৃতজ্ঞতাপ্রিয়, তাদের জন্য তিনি রাত্রি ও দিবস সৃষ্টি করেছেন পরিবর্তনশীলরূপে।’ (সূরাতুল ফুরকান-৬২) আবার জ্ঞানের মূল্যায়নে বলেছেন, ‘জ্ঞানীদের থেকে জেনে নাও যদি তোমরা না জানো।’ (সূরাতুন নাহল-৪৩) এরূপে অসংখ্য হাদিসেও সময়ের মূল্য এবং জীবনের গুরুত্ব প্রদানের তাগিদ রয়েছে। একটি হাদিসে নবীজি (সা.) বলেন, ‘পাঁচটি বিষয়কে পাঁচটি বিষয়ের আগমনের আগে গনীমত মনে করো। বার্ধক্যের আগে যৌবনকে, অসুস্থতার আগে সুস্থতাকে, দরিদ্রতার আগে সচ্ছলতাকে, কর্মব্যস্থতার আগে অবসরকে এবং মৃত্যুর আগে জীবনকে।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা : ৩৫৪৬০)। হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.) বলতেন, ‘সময়ের চক্র যদিও বিস্ময়কর, কিন্তু মানুষের আলসেমি আরও বিস্ময়কর! মানুষের উচিত নিজ জীবনের সেই দিনটির জন্য দুঃখ প্রকাশ করা যা এমনভাবে অতীত হয়েছে যে, তাতে কোনো নেক কাজ করা হয়নি! বিশিষ্ট তাবেয়ি হযরত হাসান আল বসরি (রহ.) বলেন, আমি এমন লোকদের (সাহাবাদের) সংগ্রবে থেকেছি, যারা স্বীয় জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে সোনা-রূপার চেয়েও বেশি মূল্যবান মনে করতেন। কিন্তু আফসোস বর্তমানে আমাদের মধ্যে কোনো সময়ানুবর্তিতা নেই! অথচ সময় ও জ্ঞানানুরাগী মানুষরাই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ সন্তান। কথায়ও আছে ‘সময় ও নদীর গ্রোত কারো জন্য অপেক্ষা করেনা।’ দুটোই তাদের গতিপথে চলমান। তাই সময়ের যথার্থ মূল্যায়নে নিজের জন্য এবং দেশ, জাতি ও বিশ্ববাসীর জন্য কিছু করে যাওয়াই হবে জ্ঞানীর কাজ । তাইতো স্কাউট প্রতিষ্ঠাতা ভিপি বলেছিলেন ‘তোমরা পৃথিবীকে যেমন পেয়েছো তারচেয়েও সুন্দর রেখে এসো।’
লেখক : শিক্ষার্থী, সরকারি সিটি কলেজ-চট্টগ্রাম