বিচার যেন হারিয়ে না যায় রাজনীতির চাপে

20

কলঙ্কিত অতীতের ধারাবাহিকতায় এবার শারদীয় দুর্গোৎসবের মধ্যেই কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ কিংবা নোয়াখালী থেকে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পুরোনো কৌশলেই সাম্প্রদায়িকতার বিষ ছড়িয়ে দেয়া হলো। অতঃপর ঘটনা নিয়ে রাষ্ট্রের বিবদমান রাজনৈতিক পক্ষগুলোর মধ্যে চলছে পাল্টাপাল্টি দোষারোপ। এই কীর্তিকলাপও মোটেও নতুন কিছু নয়। পাল্টাপাল্টি দোষারোপের এ চোরাবালিতে সংঘটিত অপরাধের বিচার যাতে হারিয়ে না যায়- এবার অন্তত এইটুকু দেখতে চায় দেশের আপামর সাধারণ মানুষ।
সভ্য রাষ্ট্র ও সুস্থ সমাজে যে কোনও ধরনের অপরাধমূলক ঘটনা থামাতে হলে প্রয়োজন আইনের যথার্থ প্রয়োগ। কিন্তু পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, দেশের স্বাধীনতাপরবর্তী বিগত ৫০ বছরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিনষ্ট করা কিংবা সহিংসতার ঘটনাগুলো সংঘটিত হওয়ার পর তা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও রাজনীতি হয়, কিন্তু বিচার হয় না। এই বিচারহীনতার সংস্কৃতিকেই এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে প্রধান অন্তরায় বলে জনমনে এখন অনেকটাই প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। ১৯৯০ সাল থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত দেশে সাম্প্রদায়িক হামলা ও নির্যাতনের ঘটনায় মামলা করারও তেমন একটা সুযোগ ছিল না। বিচারপতি শাহাবুদ্দিন কমিশন তদন্ত করে কিছু ঘটনার উল্লেখ করেছিল ঠিকই, তবে সেসব ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলাগুলোর এখনও কোনও সুরাহা হয়নি। এর পেছনে থাকে রাজনৈতিক কারণ। রাষ্ট্র বা সরকার এ ঘটনার দৃষ্টান্তমূলক নিষ্পত্তির কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেয় না।
এবারের শারদীয়ার আগেও যে কয়টি বড় ধরনের সাম্প্রদায়িক হামলা বা সহিংসতার ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কিংবা গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সেসব পরিকল্পনার কথা জানলেও নিরাপত্তার যথাযথ পদক্ষেপ নেয়ার উদাহরণ দেখা যায় না। বিগত ২০১২ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর রামুর বৌদ্ধ পল্লীতে হামলার ঘটনা ঘটে। নয় বছর পার হতে চললেও এ ঘটনার কোনও বিচার এখনও হয়নি। এই ঘটনায় মোট ১৯টি মামলা হয়েছিল। একটি মামলার চার্জশিট হলেও সাক্ষীর অভাবে বিচার থমকে আছে। ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তারা সবাই জামিনে মুক্ত হয়ে এলাকায় রয়েছেন। আর যে উত্তম বড়ুয়ার নামে ফেসবুক পোস্টের অজুহাত তুলে রামু, উখিয়া এবং টেকনাফে তান্ডব চালানো হয়েছিল, তিনি জামিন পেলেও এখন নিখোঁজ রয়েছেন। যদিও তদন্তে তার ফেসবুক পোস্টের কোনও প্রমাণই মেলেনি। ঠিক তেমনি ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু বসতিতে হামলার তদন্ত প্রায় পাঁচ বছরেও শেষ হয়নি। ওই সময় যাদের আটক করা হয়েছিল, তারাও জামিনে মুক্ত রয়েছেন। অন্যদিকে লেখাপড়া না জানা যে রসরাজের ফেসবুক পোস্টের ধর্মীয় অবমাননার কথা তুলে হামলা হয়েছিল, তাকেই উল্টো দীর্ঘদিন জেলে থাকতে হয়েছে। এখন জামিন পেলেও আতঙ্কে তার দিন কাটছে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করতে কিংবা সহিংসতা সংঘটিত করতে দুর্বৃত্তরা বরাবরই পুরোনো অপকৌশলেরই আশ্রয় নিয়েছে। বাড়িঘরে হামলা, ভিটেবাড়ি জবরদখল, মন্দিরে হামলা ও ভাঙচুর, নারীদের তুলে নিয়ে জোরপূর্বক বিয়ের ঘটনা চলে আসছে বহু বছর ধরেই। আক্রমণকারীরা প্রভাবশালী হওয়ায় অনেক সময় নির্যাতিতরা থানা-পুলিশে যেতেও ভয় পায়। অধিকন্তু, হামলার পর অতীতের সরকারের মন্ত্রীরা গণমাধ্যমের খবরকে ‘অতিরঞ্জিত’ বলে দায় এড়ানোর চেষ্টা করেছেন। তবে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ আমলে হুবহু তেমনটি হয়নি। এ সরকার রামু ও নাসিরনগরে পুড়ে যাওয়া ঘরবাড়ি ও মন্দির নির্মাণ করে দিয়েছে। কিন্তু অত্যন্ত বেদনার দিক হলো, কোনও ঘটনায়ই অপরাধীদের শাস্তির আওতায় আনা যায়নি বা আনা হয়নি। রামুর ঘটনায় এখন নাকি সাক্ষীই পাওয়া যাচ্ছে না। আর নাসিরনগরে নির্যাতিতদের ‘গিনিপিগ’ বানানো হয়েছে। আবার বিএনপির আমলে সংঘটিত সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ সরকার বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিশন করেছিল। তারা বহু বছর আগে প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে। ব্যস, ওই পর্যন্তই। তদন্ত প্রতিবেদনে অভিযুক্তদের কাউকেই সরকার ওই ঘটনার জন্য আইনের আওতায় আনার গরজবোধ করেনি। যেখানে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত, সেখানে শ্রেণি-সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলে অন্যায়ের প্রতিকার পায়। কিন্তু যেখানে আইনের শাসন নড়বড়ে এবং বাছাইকৃত, সেখানে অপেক্ষাকৃত সমাজের দুর্বল শ্রেণির ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথাটি সকাল-বিকেল মুখে আওড়ালেই হয় না, অপরাধীদের শাস্তি নিশ্চিতের মাধ্যমে সেটি কাজেও প্রমাণ করতে হবে। দু-একটি স্থানে ক্ষতিগ্রস্তদের বাড়িঘর বা ধর্মীয় স্থাপনা পুননির্মাণ করলেও তারা নিরাপদবোধ করবে না, যতক্ষণ না অপরাধের বিচার হয়।
এবারের শারদীয়ার প্রাক্কালে কুমিল্লা শহরের একটি পূজামন্ডপে অপ্রত্যাশিত ও ন্যাক্কাজনক ঘটনার পর গত ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন, ‘এমন শাস্তি হবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ সাহস না পায়।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘যে ঘটনা ঘটেছে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং সার্বক্ষণিকই আমরা যোগাযোগ রাখছিলাম এবং এ ব্যাপারে যথাযথ পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। যেখানে যেখানে যারাই এ ধরনের কোনও ঘটনা ঘটাবে সঙ্গে সঙ্গে তাদের খুঁজে বের করা হবে। আমরা সেটা করতে পারব। যথাযথ শাস্তি তাদের দিতে হবে। মানে এমন শাস্তি, যেন ভবিষ্যতে আর কেউ সাহস না পায়- সেটাই আমরা চাই।’ তাই আমরাও প্রধানমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন উচ্চারণে আস্থা রেখেই ‘অসুরদের’ আর ‘সাহস না পাওয়া’ দেখতে চাই।