বিআরটি প্রকল্পে কেন বারবার ঘটছে দুর্ঘটনা?

32

ফারুক আবদুল্লাহ

আর কতো দুর্ঘটনা কিংবা হতাহতের ঘটনা ঘটলে বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে? যতটুকু জেনেছি, রাজধানী উত্তরায় বিআরটি প্রকল্প এলাকায় গত ১৫ আগস্ট গার্ডার খসে পড়ে পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনার পর এই প্রকল্পের কাজ ঘিরে সুরক্ষাবেষ্টনী দেওয়ার কথা থাকলেও সে ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি।
এ ঘটনার পর র‌্যাব সংবাদ সম্মেলনে প্রকল্পের বেশকিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার তথ্য তুলে ধরেন। র‌্যাব জানায়, বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি কোম্পানি চায়না গ্যাঝুবা গ্রæপ কর্পোরেশনে (সিজিজিসি) ‘সেইফটি ইঞ্জিনিয়ার’ হিসেবে গত বছর নিয়োগ পান জুলফিকার আলী শাহ। বিমানবন্দর সংলগ্ন এলাকা থেকে উত্তরার আজমপুর পর্যন্ত নির্মাণকাজে নিরাপত্তা নিশ্চিতের দায়িত্ব ছিল তার।
মূল নির্মাণকাজের ঠিকাদারি পায় চীনের তিনটি প্রতিষ্ঠান- চায়না গ্যাঝুবা গ্রæপ কর্পোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রæপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। গার্ডার দুর্ঘটনাটি ঘটেছে সিজিজিসির নির্মাণাধীন অংশে। এত বড় প্রকল্পের সেইফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করার মত কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণ তার নেই।
দুর্ঘটনার দিনে ভারী গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তিনি কোনো ধরনের নিরাপত্তা বেষ্টনী বসাননি। গাড়ি চলাচল নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত লোকও নিয়োগ করেননি।
পাঁচ বছরের এ প্রকল্প ১০ বছরেও শেষ না হওয়ায় তা চরম গণভোগান্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই সঙ্গে প্রকল্প ব্যয় বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
প্রকল্পের আকার এখন ৪ হাজার ২৬৮ কোটি টাকায় দাঁড়ালেও র‌্যাবের তথ্য বলছে, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ঝুঁকি নিয়েই খরচ কমানোর চেষ্টা করে গেছে। দুর্ঘটনাস্থলে যে ক্রেইনটি ব্যবহার করা হচ্ছিল, সেটির বয়স অন্তত ২৬ বছর।
যে ক্রেইনটি ৯৬-৯৭ সাল থেকে ব্যবহার করা হচ্ছিল, এটি মেয়াদোত্তীর্ণ। ওই ক্রেইন দিয়ে সর্বোচ্চ ৪৫ থেকে ৫০ টন ওজন ‘কম্ফোর্টেবলি’ তোলা যায়। আর ওই ক্রেইনটি দিয়ে যখন সোজাসুজিভাবে না তুলে তেরছাভাবে তোলা হয়, তখন সেটির ভার বহন সক্ষমতা আরও কমে যায়। সেখানে যে গার্ডারটি ছিল সেটির আনুমানিক ওজন ৬০ থেকে ৭০ টন। যার কারণে যিনি ক্রেইনটি চালাচ্ছিলেন, সেই হেলপার নিয়ন্ত্রণ হারায়। এই গার্ডার তোলার ক্ষেত্রে কাউন্টার লোড ব্যবহার করা উচিৎ ছিল, যেটা হয়নি। আরেকটি ক্রেইন স্ট্যান্ডবাই রাখা উচিৎ ছিল, সেটিও রাখা হয়নি। ঘটনাস্থলের অদূরে দাঁড়িয়ে কাজ তদারকি করছিলেন চীনা কোম্পানি সিজিজিসির চীনা কর্মকর্তারা। এতো সব অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার কারণে চাপা পড়া পিষ্ট হয় এক পরিবারের পাঁচজন সদস্য। আহত অবস্থায় উদ্ধার হন দুজন।
এদিকে কাজ চলার সময় গত শুক্রবার বিআরটি প্রকল্প এলাকায় আবারও দুর্ঘটনা ঘটেছে। টঙ্গীর কলেজ গেট এলাকায় নির্মাণাধীন উড়ালসড়কের ওপর থেকে বিশাল আকৃতির একটি রড চলন্ত একটি প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পান পাঁচজন যাত্রী। তবে প্রাইভেট কারটির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ভেঙে গেছে পেছনের দরজার কাচ। একটি রড গাড়িতে ঢুকে গেছে। ভেঙে গেছে পেছনের লাইট।
এসব ঘটনার পর একটি বিষয় স্পষ্ট যে, বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণকাজে যথেষ্ট নিরাপত্তার অভাব আর অবহেলা রয়েছে। যার কারণে বারবার হতাহতের ঘটনা ঘটে চলছে।
এই দুর্ঘটনা নতুন নয়। ২০১৯ থেকে বিভিন্ন সময়ে এখানে দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। তারপরেও নিয়োগ দেওয়া আন্তর্জাতিকমানের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কোন দায়ভার নিতে হয়নি। কোনো জবাবদিহিতার মধ্যেও তারা আসেননি। যে কোনো প্রকল্পে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট থেকে শুরু করে ঝুঁকি এড়ানোর জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণে বিনিয়োগ থাকে, কিন্তু বিআরটির প্রকল্পে ন্যূনতম কোনো স্ট্যান্ডার্ড মানা হয় কি না, সে ব্যাপারে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে।
তাছাড়া কোনো ভারী নির্মাণ সামগ্রী নিয়ন্ত্রণ করার আগে সেখানে অবশ্যই কোনো না কোনো নিরাপত্তা বেষ্টনির ব্যবস্থা থাকতে হয়। ক্রেইন থেকে গার্ডার পড়ে যেতেই পারে, এটা একটা দুর্ঘটনা। কিন্তু এসব দুর্ঘটনায় প্রাণহানি যেন না ঘটে, সেই প্রস্তুতি গ্রহণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এখানে নজরদারির যথেষ্ট অবহেলা ছিল বিধায় এই দুর্ঘটনা ঘটেছে।
শুধু তাই নয়, বিআরটি প্রকল্পে আরও বেশ কয়েকবার এ ধরনের ঘটনা সংগঠিত হয়েছে। ২০২১ সালের ১৪ মার্চ ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় বিআরটি প্রকল্পের একটি গার্ডার লঞ্চার ভেঙে তিন চীনা কর্মীসহ ৬ জন আহত হন।
এরপর দুই মাসের বেশি সময় পড়ে থাকার কারণে দুর্ভোগ পোহাতে হয় ওই পথে চলাচলকারীদের। ওই বছরের ১৮ জুন ক্রেইনটি মেরামত করে সচল করার খবর দেয় প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
একইভাবে গত ১৫ জুলাই গাজীপুরে বিআরটি প্রকল্পের নির্মাণাধীন ফ্লাইওভারের
‘লঞ্চিং গার্ডার’ চাপায় প্রকল্পটির এক নিরাপত্তারক্ষী নিহত হন। ওই ঘটনায় আরও আরেক শ্রমিক ও একজন পথচারী আহত হন। ওইদিন বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জেলার চান্দনা চৌরাস্তার কে চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি ফিলিং স্টেশনের সামনে এ ঘটনা ঘটে। ওইসময় পুলিশ জানায়, লঞ্চিং গার্ডার দিয়ে গার্ডার টেইলার গাড়িতে উঠানো হচ্ছিল। এ সময় গার্ডারটি টেইলার থেকে কাত হয়ে নিরাপত্তাকর্মী জিয়াউর রহমানের উপর পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।

লেখক : সাংবাদিক