বায়ুদূষণ রোধে বিশ্বব্যাংকের আহবান এখনই জরুরি পদক্ষেপ নিতে হবে

10

বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে আবারও উঠে এসেছে বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার বায়ু দূষণের ভয়াবহ চিত্র। বিগত প্রায় দেড় যুগ ধরে দেশের এ মেগা সিটির ভয়াবহ বায়ু ও শব্দ দূষণের খবর পত্রিকার শিরোনাম হচ্ছে। বসবাস উপযোগিতা হারিয়েছে ঢাকা- এমন শিরোনামও হয়েছে, টেলিভিমনগুলো টকশোতে তোলপাড় করেছে বিশেষজ্ঞরা, সরকারি পর্যায়ে সেমিনার-আলোচনাও কম হয়নি, কিন্তু কিছুতেই বায়ু দূষণ কমেনি, বরং সময় যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে বায়ু দূষণ। এতে জনজীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠছে। নানা রোগব্যাধীতে আক্রান্ত হচ্ছে নগরবাসী। এ অবস্থার অবসান হওয়া জরুরি। গত মঙ্গলবার ঢাকায় বিশ্ব উন্নয়ন ঋণদাতা ‘পরিচ্ছন্ন বায়ুর জন্য প্রচেষ্টা: দক্ষিণ এশিয়ায় বায়ু দূষণ এবং জনস্বাস্থ্য’ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। প্রকাশিত প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলো নিয়মিতভাবে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, কিছু অংশে সূ² কণা পদার্থ যেমন : ঝুল ও ছোট ধুলোর ঘনত্ব (পিএম ২.৫) অঞ্চলের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এবং দরিদ্র অঞ্চলগুলো ডবিøউএইচও মান (৫এমজি/এম৩)থেকে ২০ গুণ বেশি। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, এ ভয়াবহ বায়ু দূষণে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতি বছর আনুমানিক ২০ লাখ মানুষের অকাল মৃত্যু হয় এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক খরচ বহন করে। এই ধরনের চরম বায়ু দূষণের সংস্পর্শে শিশুদের মধ্যে স্টান্টিং এবং হ্রাসকৃত মানসিক বিকাশ থেকে শুরু করে শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ এবং দীর্ঘস্থায়ী এবং দুর্বল রোগের প্রভাব বৃদ্ধি করে। বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি একদিকে স্বাস্থ্যসেবার খরচ বাড়ায়, অপরদিকে একটি দেশের উৎপাদন ক্ষমতা কমায় এবং কর্মদিবস নষ্ট করে। বাংলাদেশ ও ভুটানের জন্য বিশ্বব্যাংকের কান্ট্রি ডিরেক্টর আবদৌলায়ে শেখ বলেছেন, ‘বায়ু দূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি গুরুতর হুমকি সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ওপর এর বড় নেতিবাচক প্রভাব রয়েছে।’ অবশ্যই আবদৌলায়ে শেখ ‘অঙ্গীকার, সঠিক পদক্ষেপ এবং নীতির মাধ্যমে বায়ু দূষণ মোকাবিলা করা সম্ভব’ উল্লেখ করে প্রতিবেদনে বলেন, ‘বাংলাদেশ এরই মধ্যে বায়ু দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালার অনুমোদনসহ বায়ুর মান ব্যবস্থাপনার উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে শক্তিশালী জাতীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি, বায়ু দূষণরোধে আন্তসীমান্ত সমাধানের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। তাদের দাবি বিশ্লেষণমূলক কাজ এবং নতুন বিনিয়োগের মাধ্যমে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশকে বায়ু দূষণ কমাতে সাহায্য করছে।’ আশার কথা বায়ু দূষণের আন্তসীমান্ত প্রকৃতিকে স্বীকৃতি দিয়ে চারটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল এবং পাকিস্তান প্রথমবারের মতো ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমি এবং হিমালয়ের পাদদেশে বায়ুর গুণমান উন্নত করতে কাঠমান্ডু রোডম্যাপ তৈরি করতে একত্রিত হয়েছে। তারা যদি সমন্বিত পন্থা অবলম্বন করে, তবেই বায়ু দূষণের উদ্বেগজনক মাত্রা কমাতে পারে। একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে দেশগুলো আরও ভাল, দ্রæত এবং সহজে ফলাফল পেতে পারে। বায়ুর মান উন্নত করতে আমাদের সরকার যে নীতি গ্রহণ করেছে তা জেলা পর্যায়ে বিস্তৃতি করার পাশাপাশি, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সমন্বিত আন্তসীমান্ত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এক্ষেত্রে বিশ্বব্যাংক বলেছে, তারা এক্ষেত্রে আর্থিক সহযোগিতা করবে। তবে তার আগে স্বচ্ছতার বিষযটি স্মরণ করিয়ে দিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখেনা যে, অপরিকল্পিত নগরায়ণের ফলে ধুলাবালি মিশ্রিত বাতাসের কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে। অন্যদিকে শিশুদের স্বাস্থ্যঝুঁকি ও নিরাপত্তাহীনতা দিনদিন বেড়েই চলছে। এই সমস্যা পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব না হলেও, আমাদের কিছু সচেতনতা ও কার্যকর পদক্ষেপ তা অনেক কমিয়ে আনতে পারে। দূষিত বায়ুর কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ নানা রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হচ্ছে। বায়ু দূষণের জন্য শ্বাসকষ্ট ছাড়াও পেটের সমস্যা, ফুসফুসজনিত সমস্যা, চামড়ার সমস্যা, হাঁপানি বা এলার্জিজনিত সমস্যা, চোখ ও নাকের সমস্যা, যে কোনো সংক্রমণ, গর্ভকালীন সমস্যা এমনকি ক্যান্সারও হতে পারে। তবে শিশুদের ক্ষেত্রে এ দূষণ খুব মারাত্মক প্রভাব ফেলে যা তাদেরকে সারা জীবন ধরে বয়ে বেড়াতে হয়। ঢাকা ও চট্টগ্রামে শিল্পকারখানার ধোঁয়া ও বর্জ্যছাড়াও দূষণের অন্যতম কারণ ইটভাটা। আমরা মনে করি, ইটভাটা থেকে সৃষ্ট দূষণ বন্ধে মালিকদেরকে জ্বালানি সাশ্রয়ী আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে ও শুষ্ক মৌসুমে ধুলার দূষণ প্রতিরোধে সিটি কর্পোরেশনকে সঠিকভাবে রাস্তা পরিষ্কার এবং যথাযথ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি ধুলা ছড়িয়ে পড়া বন্ধে নিয়মিত রাস্তায় পানি ছিটানোর ব্যবস্থা করতে হবে। রাস্তা-ঘাট ও ভবন নির্মাণের সময় নির্মাণকারীদের নির্মাণের এলাকা ঢেকে রাখতে হবে এবং পানি ছিটানোর পাশাপাশি দূষণসংক্রান্ত নিয়মাবলি মেনে চলার প্রতিশ্রুতি নিশ্চিত করতে হবে। যত্রতত্র সিটি কর্পোরেশনের সংগৃহীত বর্জ্য পোড়ানো বন্ধ করতে হবে, শিল্পকারখানর বায়ু দূষণ কমাতে ইটিপি ব্যবহারে বাধ্য করতে হবে, যানবাহন ও নৌযান থেকে দূষণ এবং কালো ধোঁয়া নির্গমন রোধ করার জন্য কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে, সেবাদানকারী সংস্থাগুলোর খোঁড়াখুঁড়ি কাজের সমন্বয় সাধন করা ও বায়ু দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে অবহিত করতে ব্যাপক জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে।