বাড়ছে সামাজিক অপরাধ এখনই লাগাম টানতে হবে

21

 

ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে সামাজিক অপরাধ। ধর্ষণসহ শিশু ও নারীর প্রতি সহিংসতা কোনোভাবেই রোধ করা যাচ্ছে না। পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটছে একের পর এক পাশবিক খুনের ঘটনা। কিশোর গ্যাংয়ের দৌরাত্ম্যও যেন লাগামহীন। দীর্ঘ দেড় বছর প্রায় দেশ যেখানে করোনার ছোবলে স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল, সেই সময় পারিবারিক সহিংসতা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গিয়েছিল, যা এখনও চলমান। এরফলে সমাজে একধরনের হতাশা ও উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। পুলিশের সূত্রগুলো বলছে, বৈশ্বিক এই মহামারিতে নির্দিষ্ট কিছু অপরাধ বেড়ে গিয়েছিল, যা আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী কিছুটা অনুমান করেছিলেন। সূত্র জানায় কেন্দ্রীয়ভাবে সেদিকে নজর রাখার পরামর্শও দেয়া হয়েছিল পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটকে। তবে নজরদারির মধ্যেও খুন, নারী ও শিশু ধর্ষণ এবং বিকৃত যৌনাচারের ঘটনা কমেনি। এ নিয়ে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৯ সালের মার্চ-অক্টোবরে সব ধরনের অপরাধে দেশে মোট মামলা হয় ১ লাখ ৫৫ হাজার ৬৩২টি, কিন্তু ২০২০ সালের একই সময়ে মোট মামলা হয় ১ লাখ ১৯ হাজার ৪০৪টি। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবোধের অভাবে সামাজিক ও পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হয়ে পড়ছে। সহনশীলতার মাত্রা কমে যাচ্ছে, সামাজিক অস্থিরতার কারণে বাড়ছে হতাশা ও বিষণ্নতা। ফলে সমাজে বেড়ে চলেছে অপরাধও। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক খন্দকার ফারজানা রহমান বলেন, ‘ঐতিহাসিকভাবে মহামারি, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো পরিস্থিতিতে অপরাধের চিত্র বদলায়। বিশেষত, যাঁরা অর্থনৈতিক ঝুঁকি ও মানসিক অশান্তিতে আছেন, তাঁদের একটি অংশ অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। একটি অংশ অপরাধের শিকার হন।’ চাঞ্চল্যকর কোনো খুনের ঘটনা ঘটলে, কোন শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী বা কোন নারী ধর্ষণের শিকার হলে, কোন শিশুকে দড়িতে বেঁধে নির্মম নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করলে, গুরুত্বপূর্ণ কেউ অপহৃত হলে অথবা অন্য কোনো বড় অপরাধ হলে গণমাধ্যমে সমালোচনা হয়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি নিয়ে উদ্বেগ জানানো হয়। সরকারও কিছুটা নড়েচড়ে বসে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও কিছুটা তৎপর হয়ে উঠেন। কিন্তু দৌড় আর বেশিদূর নয়; সে পর্যন্তই। কিছুদিন পর গণমাধ্যমের মনোযোগ অন্যদিকে সরে গেলেই সব হারিয়ে যায়। কোনো কোনো ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত রিপোর্টও আলোর মুখ দেখে না। ফলে অপরাধী পার পেয়ে যায়, সময় সুযোগে আড়াল থেকে ফিরে আসে। মাঝেমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়লেও জামিন পেয়ে যায়। আবারও অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। কিংবা গণমাধ্যমে বেশি আলোচনা হলে বিদেশে পালিয়ে যায়। ফলে অপরাধ চক্রের ধারাবাহিকতায় কোনো ছেদ পড়ে না। অপরাধ কেন হয়, অপরাধের মাত্রা কেন বাড়ে, অপরাধী কেন বেপরোয়া হয়, সেই নিয়ে কোন গবেষণা বা এ জাতীয় প্রশ্নে তেমন কোনো সময় দেয়া হয় না।
অপরাধ বিষয়ক বিশেষজ্ঞদের মতে, শুধু আইন করে বা আইনের প্রয়োগ গঠিয়ে অপরাধ বিরোদ করা সম্ভব নয়। এর জন্য দরকার আত্মশুদ্ধি ও নৈতিক শিক্ষা। এখন আর মানুষের মাঝে আত্মশুদ্ধির বিষয় নেই। জীবনযাত্রা ক্রমেই জটিল হয়ে পড়ছে। শহরে অসচ্ছল মানুষজন একসাথে গাদাগাদি করে ছোট জায়গায় থাকছে। ফলে মানুষের মন পরিশুদ্ধ হওয়ার উপায়ও নেই। চিত্তবিনোদনের সুযোগও তেমন নেই। এর ফলে মানুষের রুচি, স্বভাব ও জীবনযাত্রায় বিকৃতি বাড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ পরিস্থিতি সামাল দিতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার প্রয়োজন। কারণ সমস্যাটি এক দিনে তৈরি হয়নি। সমাজের প্রতিটি অংশ নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করায় অপরাধ বেড়েছে। করোনার কারণে মানুষ দীর্ঘদিন ধরে গন্ডিবদ্ধ জায়গায় আবদ্ধ ছিল। এ অবস্থায় অনেকের মধ্যেই মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। তাই অপরাধ রোধে আইনি নিয়ন্ত্রণের চেয়ে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে জোর দেয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। পারিবারিক সম্পর্ক ও আত্মীয়তার বন্ধন দৃঢ় করতে হবে। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে বোঝাপড়া বাড়াতে হবে। একজনের বিপদে আরেকজনকে এগিয়ে আসতে হবে। সহযোগিতা ও সহমর্মিতার মানসিকতা তৈরি করতে হবে। সর্বোপরি সচেতনতা ও আইনের বাস্তব প্রয়োগসহ অপরাধিদের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় অপ্রতিরোধ্য লাগাম টানা সম্ভব হবে না।