বাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবী গড়তে দরকার সচেতনতা

94

পরিবেশের সাথে জীবজগতের সম্পর্ক সুনিবিড় ও অবিচ্ছেদ্য। মানুষের কল্যাণ এই পরিবেশের উপরই নির্ভর করে। পরিবেশ বলতে সাধারণভাবে আমাদের পারিপার্শ্বিক অবস্থাকেই বুঝায়। আমরা যেখানে বাস করি তার মাটি, পানি, আলো, বাতাস, গাছ-পালা, পশু-পাখি, কীট-পতঙ্গ, মানুষজনসহ প্রকৃতির সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের এই পরিবেশ। পরিবেশ অনুক‚ল হলে আমাদের বেঁচে থাকাটা হবে সুন্দর ও সুখকর আর প্রতিক‚ল হলে আমাদের ধ্বংস অনিবার্য। মহাবিশ্বে পৃথিবীই একমাত্র গ্রহ যেখানে প্রাণের অস্তিত্ব বিদ্যমান। এই গ্রহেই প্রাণের মূল উপাদান মাটি, পানি, বায়ু ও আলো সমভাবে পাওয়া যায়। মানুষ ও প্রাণীজগতের অস্তিত্ব নির্ভর করে তার চারপাশের প্রাকৃতিক পরিবশের বিশুদ্ধিতার উপর। প্রাকৃতিক পরিবেশের উপর ভিত্তি করে মানুষ বেঁচে থাকে, জীবনীশক্তি পায় ও সভ্যতার বিকাশ ঘটে। এই প্রাকৃতিক পরিবেশ এখন মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের বিপর্যয় বা দুর্যোগ। অবিরাম পরিবেশ দূষণের কারণে জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর বুকে জীবনের অস্তিত্ব রক্ষা করা মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এখন প্রাকৃতিক দুর্যোগে জর্জরিত মূলত এই জলবাযু পরিবর্তনের কারণে। এই প্রেক্ষাপটে প্রকৃতি ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে এবং পৃথিবীকে নিরাপদ ও বাসযোগ্য রাখতে প্রতিবছর ২২ এপ্রিল সারাবিশ্বে আর্থ-ডে বা ধরিত্রী দিবস পালন করা হয়। ১৯৬৯ সালে সানফ্রান্সিস্কোতে ইউনেস্কো সম্মেলনে শান্তিকামী জন ম্যাককনেল পৃথিবী মায়ের সম্মানে একটি দিন উৎসর্গের প্রস্তাব করেন। শান্তির ধারণা থেকে উত্তর গোলার্ধে বসন্তের প্রথম দিন হিসেবে ২১ মার্চ ১৯৭০ সালে প্রথম এই দিনটি উদযাপিত হয়। সে সময় বিশ মিলিয়ন মানুষ পরিবেশ ধ্বংসের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। এ ঘটনার সূত্রপাত ১৯৬৯ সালের সান্তা বারবারায় তেল উপচে পড়া থেকে, যার সঙ্গে ধোঁয়াশা ও দূষিত নদীর মতো ইস্যুগুলোও জুড়ে গিয়েছিল। ১৯৭০ সালে মার্কিন সিনেটর গেলর্ড নেলসন ধরিত্রী দিবসের অবতারণা করেন, যেটা প্রথম সংঘটিত হয় একই বছরের ২২ এপ্রিল। ১৯৯০ সালে ১৪১ দেশ ও জাতির সমন্বয়ে আন্তর্জাতিকভাবে এ দিনটি পালিত হয়। ১৯৭২ সালে মানব পরিবেশ শীর্ষক একটি সম্মেলন স্টকহোমে অনুষ্ঠিত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও-ডি জেনেরিওতে বিশ্ব ধরিত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্যারিসে কপ-২১ নামের একটি সম্মেলনে জলবায়ু চুক্তির ব্যাপারে সম্মত হন বিশ্বনেতারা। ২০১৬ সালে ধরিত্রী দিবসে যুক্তরাষ্ট্র, চীনসহ বিশ্বের ২০০ দেশ গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে আনার লক্ষ্যে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ বছর ধরিত্রী দিবস পালিত হচ্ছে করোনা ভাইরাস অতিমারির মধ্যে। জাতিসংঘ বলছে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন. মানুষের হাতে প্রকৃতির বদল ও বনভূমি হ্রাস, জমির চরিত্র বদল, কৃষি ও পশুপালনের মাত্রাছাড়া বৃদ্ধি এবং বেআইনি বন্যপ্রাণী ব্যবসা বৃদ্ধির ফলে কোভিড-১৯ এর মতো পশু থেকে মানুষে সংক্রামক রোগ বাড়তে পারে।’ ২০২০ সালের ২১ ডিসেম্বর প্রকাশিত ইউএনডিপির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘জীববৈচিত্র্যের ওপর ক্রমাগত আঘাতের ফলে প্রকৃতি বিদ্রোহ করছে। করোনাভাইরাস হয়তো দীর্ঘদিন ধরে পরিবেশ ও প্রকৃতির ওপর অভিঘাতের সাম্প্রতিক বহিঃপ্রকাশ। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে, বহুদিন ধরে বিজ্ঞানীরা সতর্ক করে আসছিল মানুষ, গবাদিপশু এবং বন্যপ্রাণীর মধ্যে অবাধ সংযোগের ফলে নতুন ধরনের রোগ জীবাণুর আবির্ভাব হতে পারে। এই সংযোগ বহুদিন ধরে চলে আসছে এবং প্রকট আকার ধারণ করছে। কোভিড-১৯ আজকের সংযুক্ত পৃথিবীর প্রায় সবদেশে দ্রæত ছড়িয়ে পড়েছে, যেখানে এই ভাইরাসটি পৌঁছেছে সেখানেই মানুষের মধ্যে দ্রæত ছড়িয়ে পড়ছে।
পৃথিবী দিন দিন অনিরাপদ ও বাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। ধীরে ধীরে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলছে পৃথিবী। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। মাটির ক্ষয় বেড়ে গেছে। যার সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়ছে সাব সাহারান আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়। অতিমাত্রায় বৃক্ষ নিধন, অতিরিক্ত চাষ এবং সারের ব্যাপক প্রয়োগে মাটির উর্বরতা নষ্ট হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মৌসুমি ফসলের পরিমাণ কমছে। এশিয়ার ৪৮টি দেশের মধ্যে বর্তমানে ৩৮টি দেশে খরার প্রভাব রয়েছে। গোট এশিয়ার পরিবেশ বদলে যাওয়ার কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হতে পারে ভিয়েতনাম, বাংলাদেশ, লাওস ও চীনের মতো দেশগুলোর। উৎপাদন হ্রাস, দুর্বল পরিকাঠামো, বন্যা, রোগের প্রাদুর্ভাব, পরজীবির আক্রমণে ফসলের ক্ষতি হবে বেশি। খাদ্য উৎপাদন কম হলে খাদ্য সুরক্ষা সম্ভবপর হবে না। ফলে শিশুর অপুষ্টির পরিমাণ বাড়তে পারে। বাতাসে কার্বনের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে এশিয়ার দেশগুলোর ক্ষতি আরো বেশি হবে। পরিবেশ বদলের কারণে ফসলে প্রোটিন, পুষ্টি, ভিটামিন বি-এর মত উপাদান কমছে। বিশ্ব পরিবেশ সমস্যাগুলোর সাথে বাংলাদেশও আঞ্চলিক ও ভৌগলিক দিক থেকে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। পরিবেশগত সমস্যাগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে আলোচিত বিষয়গুলো হলো অধিক জনসংখ্যা ও দারিদ্র্যতা। তাছাড়া বাংলাদেশের পরিবেশগত অপরাপর সমস্যাসমূহ হলো বন উজাড়, পানির গুণগতমান হ্রাস, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, ভূমি ক্ষয়, লবণাক্ততা, অপরিকল্পিত নগরায়ণ, অপরিশোধিত বর্জ্য নির্গমন এবং শিল্পবর্জ্য ইত্যাদি। বাংলাদেশের লক্ষ্য হচ্ছে ২০২১ সালের মধ্যে দূষণমুক্ত বাসযোগ্য একটি সুস্থ, সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ নিশ্চিত করণে পরিবেশ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নে জনগণের অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করা। পৃথিবীকে মানুষের বাসযোগ্য রাখার জন্য আমাদের প্রচুর পরিমাণে গাছ লাগানোর মাধ্যমে তাপমাত্রাকে সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসতে হবে। এতে করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয়, ঝড়, জলোচ্ছ¡াস, ভূমি ক্ষয় এবং কার্বন নিঃসরণ কমবে। জলবায়ু পরিবর্তন মানবজাতির জন্য মারাত্মক বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই বাসযোগ্য নিরাপদ পৃথিবী গড়তে নিজে সচেতন হই ও অন্যকেও সচেতন করি।
লেখক: গবেষক ও প্রাবন্ধিক