বার আউলিয়ার অন্যতম হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.)

33

আহমেদ মনসুর

এই উপমহাদেশে ইসলাম এসেছে মূলত সুফি সাধকদের মাধ্যমে। বিভিন্ন সময়ে সুফি দরবেশগণ ও তাদের অনুগামী শিষ্যরা ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন এবং ইসলাম প্রচারের জন্য বিভিন্ন শহর ও গ্রামাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন। তাঁদের নৈতিক উৎকর্ষতা আর মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি সহজেই মানুষকে আকর্ষণ করতে পারতো। ইসলামের প্রথম যুগে আরব মুসলমানদের মধ্যে সুফিদের উৎপত্তি ঘটলেও পারস্যেই এর মূল প্রসার ঘটেছিল। এরপর ধীরে ধীরে সুফিরা বিভিন্ন সময়ে ভারতবর্ষে এসে বিভিন্ন তরিকার মাধ্যমে তাঁদের মরমী কার্যাবলী সম্পাদন করেন।
ইসলামী ধর্মতাত্তি¡ক ও ঐতিহাসিকদের মতে- খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দীর প্রথম ভাগে আরব বণিক সম্প্রদায়ের ভারতবর্ষে আগমনের সূত্র ধরে ভারতবাসী ইসলাম সম্পর্কে অবহিত হয়। যদিও আরবের সাথে ভারতবর্ষের এ বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইসলাম প্রতিষ্ঠার আগে থেকেই ছিল। সপ্তম শতাব্দীর শেষভাগে আরব মুসলমানরা প্রথম ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। এরপর তাঁরা এখানে ইসলাম প্রচারে ব্রত হয়ে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েন।
চট্টগ্রাম একটি অতিপ্রাচীন শহর। সমুদ্রবন্দরের কারণে এখানের সাথে অন্যান্য জায়গার যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিলো অনেকটা সহজ। ইতিহাসসূত্রে জানা যায়- এ শহরকে আবাদ করেছেন হযরত বদর আউলিয়া (র.)। সে এক বিশাল ইতিহাস। এখানে লিখে কলেবর বাড়াবো না।
এখানে বিভিন্ন সময়ে আরববিশে^র বিভিন্ন দেশ হতে সুফি-আউলিয়াগণ এসে বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে পড়েন। কেউ বেছে নিয়েছিলেন গহীন অরন্যকে, একাগ্র এবাদত বন্দেগী, মরমী সাধনা সম্পাদনের লক্ষ্যে। এদের বেশিরভাগই ছিলেন অকৃতদার।
আমরা জানি চট্টগ্রামকে বলা হয়ে থাকে বার আউলিয়ার দেশ। দক্ষিণ চট্টগ্রামের চন্দনাইশ উপজেলার কাঞ্চননগর গ্রামে রয়েছে হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.), হযরত তাজ আলী শাহ (র.) ও হযরত আক্কেল আলী শাহ (র.) এই তিন প্রখ্যাত অলির মাজার। ঐতিহাসিকদের মতে এই তিনজন অলি চট্টগ্রামের বার আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম।
জনশ্রæতি আছে আনুমানিক ৯৩ হিজরি মোতাবেক খ্রিষ্ট্রীয় সপ্তম শতাব্দীর দিকে সুদূর ইয়ামেন থেকে চট্টগ্রামে আসেন এই তিনজন প্রখ্যাত অলি। অন্য এক সূত্রে জানা যায় এ তিনজন অলি হযরত শাহ জালাল (র.) এর সফরসঙ্গী ৩৬০ আউলিয়ার মধ্যে অন্যতম ছিলেন। পরবর্তীতে হযরত শাহ জালাল (র.) এর নির্দেশে তাঁরা চট্টগ্রামে চলে আসেন। সে সময়ে ইসলামের জ্ঞান সম্পর্কে এ অঞ্চলের মানুষ অজ্ঞাতই ছিল ধারনা করা যায়। ইসলামের আলো হয়তো মহান এ সাধকদের হাত ধরেই এ অঞ্চলে প্রথম ছড়িয়েছে।
ভালোবাসার মাধ্যমে তাঁরা স্থানীয়দের মধ্যে ইসলামের বাণী পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলেন। সহজিয়া ধারার ইসলামের শান্তি আর মানবিক বাণীতে উজ্জীবিত হয়ে সাধারন মানুষ তাঁদের সান্নিধ্যে গেলে হৃদয়ে স্বর্গীয় শান্তি অনুভব করেন। ইসলামের হুকুম-আহকাম প্রচার আর মানুষ হিসেবে ইসলাম যে অধিকার সংরক্ষণের কথা বলে তা প্রচার করা হলে এ অঞ্চলের মানুষ মনে করেন এতদিনে তারা সত্যিকারের একটি জীবনব্যবস্থার সন্ধান পেলেন আর দলে দলে ইসলামের পতাকা তলে সমবেত হলেন।
কোন যুদ্ধ-বিগ্রহ, আধিপত্য বিস্তার কিংবা কূটকৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে নয়, মহান সুফি সাধক এ তিনজন মহান অলির আধ্যাত্মিকতা, নৈতিকতা আর ভালোবাসার মাধ্যমেই ইসলামের সুশীতল ছায়ায় উজ্জীবিত হয়েছিলেন আমার জন্মগ্রাম কাঞ্চননগরসহ পাশর্^বর্তী অন্যান্য এলাকার পূর্বপুরুষেরা।
ভালোবাসার অমিয় সুধা বিলাতে গিয়ে আর মহান আল্লাহকে পাওয়ার মহান ধ্যানে মগ্ন থাকতে গিয়ে এ তিনজন মহান সাধক ভুলে গিয়েছিলেন সংসারের কথা। তাই তারা বৈবাহিক জীবনে পদার্পণ করেননি। কাজেই এখানে এই তিনজন অলির মাজার থাকলেও উনাদের কোন বংশধর নেই।
অনেক লেখক তাঁদের বিভিন্ন প্রকাশনায় এই অলিদের নিয়ে খন্ডিত আলোচনা প্রকাশ করলেও কোন পূর্ণাঙ্গ জীবনী এ পর্যন্ত রচিত হয়নি। মহান এ সাধকদের এ খন্ডিত আলোচনা তাঁদের ভক্তকূলের তৃষ্ণা মেটাতে পারে না। তাঁদের ব্যাপারে বিভিন্ন জায়গায় গচ্ছিত থাকা তথ্যসমূহ সংগ্রহ করে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী গ্রন্থ রচনা করা এখন সময়ের দাবী বলে বোধ করি। অন্যথা তাঁদের জীবন, কর্ম ও এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচারে তাঁদের ভূমিকা সম্পর্কে সুধী সমাজ বিস্তারিত জানতে পারবে না।
তাঁদের জন্ম, জন্মস্থান, এ অঞ্চলে আগমন ও পরলোকগমনের সুনির্দিষ্ট সন তারিখ উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও ইসলামের খেদমতে তাঁদের অনস্বীকার্য অবদানের কথা সবাই স্বীকার করেন এবং কিংবদন্তীমূলে তথা পুরুষাণুক্রমে মুখে মুখে তাঁদের ধর্ম প্রচারে কৃতিত্ব, আধ্যাত্মিকতা ও অলৌকিক ক্ষমতা সম্পর্কে জেনে আসছেন।
প্রতিবছর মাঘ মাসে মহান এ তিন অলির বার্ষিক ওরশ পালন করা হয়। সুপ্রাচিনকাল থেকেই ওরশে শরিক হতে দূরদূরান্তের মানুষ সমবেত হয়ে থাকেন। প্রতিবছর তাঁদের এ ওরশকে কেন্দ্র করে সুফিবাদী মানুষের এক মহা মিলনমেলা সংগঠিত হয়। ওরশ উপলক্ষে নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালিত হয়, যথা- মাজারে নতুন গিলাফ জড়ানো, মিলাদ মাহফিল, খতমে কোরান, খতমে গাউসিয়া, খতমে বোখারী, ভক্ত প্রেমিকদের মধ্যে তবারক বিতরণ ইত্যাদি।
আবহমান গ্রাম বাংলার সুপ্রাচীন ঐতিহ্য শীতকালীন গ্রাম্যমেলা। হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.) এর বার্ষিক ওরশকে ঘিরে প্রতিবছর এখানে মেলা বসে। গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় নানা জিনিসপাতি, শিশুদের খেলনাপাতি, বাহারি স্বাদের খাবারদাবার আর নাগরদোলা থেকে শুরু করে আরো নানা অনুষঙ্গে পুরো প্রাঙ্গণ মেতে থাকে। এ এলাকার মেয়েরা, যাদের অন্য এলাকায় বিয়ে হয়েছে, তারাও পুরো পরিবার নিয়ে চলে আসে বাপের বাড়িতে। ওরশের আগে পরে কয়েকদিনের এ নাইয়র বাধ্যতামূলক। ওরশ উপলক্ষে নানাবাড়ি এসে বেশি মজা পায় শিশুরা। ঘরে ঘরে এক অন্যরকম আনন্দের আবহ বিরাজ করে। ছোটরা ওরশের অনেক আগে থেকে পয়সা জমায় মেলায় খরচ করবে বলে। বড়রাও বকশিস দেয়। সব মিলিয়ে শিশুমনে অপার আনন্দের কি এক অনুষঙ্গ হয়ে আসে ওরশ, তা লিখে শেষ করার নয়।
প্রখ্যাত এ তিন আউলিয়ার মাজারকে কেন্দ্র করে এখানে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো প্রতিষ্ঠান। যা ধর্মের কল্যাণ ও প্রচারের পাশাপাশি অনেক মানবিক উন্নয়নেও রাখছে অপরিসীম ভূমিকা। হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.) এর স্মৃতিধন্য চন্দনাইশের কাঞ্চননগর গ্রামটি এখন দক্ষিণ চট্টগ্রামের প্রসিদ্ধ ও আলোচিত একটি জনপদের নাম। এই সাধকের নামে এখানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ কমপ্লেক্স। যেখানে রয়েছে- হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.) জামে মসজিদ, হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.) এতিমখানা ও হেফজখানা, হযরত তাজ আলী শাহ (র.) ফোরকানীয়া মাদ্রাসা, হযরত আক্কেল আলী শাহ (র.) এবতেদায়ী নুরানী মাদ্রাসা, দাতব্য চিকিৎসালয় ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
জিয়ারতের উদ্দেশ্যে প্রতিদিন এখানে প্রচুর লোকের সমাগম ঘটে। আধ্যাত্মিক তৃপ্তি লাভের আশায় নজর-নিয়াজ, মানত-সিন্ন্যত নিয়ে দূরদূরান্ত থেকে আশেক ভক্তদের এখানে আসতে দেখা যায়। অধিক ফয়েজ লাভের আশায় জুমার নামাজ আদায় করতেও অনেক দূর থেকে মুসল্লিরা আসেন। মাজার জিয়ারতে আসা মানুষদের সুবিধার জন্য সুপরিসর মাজার কমপ্লেক্স নির্মাণ করা হয়েছে। যার নির্মাণ শৈলী মানুষকে মুগ্ধ করে। মুসল্লিদের সুবিধার জন্য নির্মাণ করা হয়েছে দ্বিতলবিশিষ্ট সুন্দর মসজিদ। এতিমখানা, হেফজখানা, এবতেদায়ী মাদ্রাসার জন্য একটি দ্বিতলবিশিষ্ট ও আরেকটি একতলা ভবন রয়েছে। অযুর জন্য রয়েছে বিশাল পুকুর। ওরশ মাহফিলসহ বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পালনের জন্য রয়েছে বিশাল মাঠ। কেয়ামত পর্যন্ত আধ্যাত্মিক এই মিলনকেন্দ্রের মাধ্যমে মুক্তিপ্রত্যাশী মানুষদের কল্যাণে গঠিত হয়েছে হযরত মোস্তান আলী শাহ (র.) ফাউন্ডেশন।

লেখক: গল্পকার ও প্রাবন্ধিক