‘বাবুলের নির্দেশেই’ মিতুকে হত্যা

42

নিজস্ব প্রতিবেদক

সাবেক পুলিশ সুপার (এসপি) বাবুল আক্তারের নির্দেশেই তার স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতুকে হত্যা করা হয়েছিল। এই হত্যাকান্ডের নেতৃত্বে ছিলেন কামরুল শিকদার ওরফে মুছা। গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এ কথা বলেন আলোচিত এই হত্যা মামলার অন্যতম আসামি এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা।
পাঁচ বছর আগে নগরীতে ওই হত্যাকান্ড ঘটে। এর কিছুদিন আগে থেকে চট্টগ্রামে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন বাবুল আক্তার। সে সময় কামরুল শিকদার বাবুল আক্তারের তথ্যদাতা (সোর্স) হিসেবে কাজ করতেন। কামরুল শিকদারই বাবুলের সঙ্গে তাকে পরিচয় করিয়ে দেন বলে এহতেশামুল হক ওরফে ভোলা জানিয়েছেন।
এহতেশামকে গতকাল ভোরে বেনাপোল থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে বিকেলে চট্টগ্রামের আদালতে হাজির করা হলে জবানবন্দি দেন তিনি। চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট শফি উদ্দিন তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন।
আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে এহতেশাম বলেন, বাবুল আক্তার ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে সহকারী পুলিশ সুপার হিসেবে কর্মরত থাকাকালে তার সোর্স ছিলেন কামরুল শিকদার ওরফে মুছা। কামরুলের সঙ্গে আগে থেকে পরিচয় ছিল এহতেশামের। এহতেশামের বিরুদ্ধে পুলিশের খাতায় মামলা রয়েছে ২০টি। কামরুল এহতেশামকে বাবুলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। এর পর থেকে বাবুলকে বিভিন্ন তথ্য দিতেন এহতেশাম। নগরের ডবলমুরিং থানা এলাকায় গুলি করতে যাওয়া এক ব্যক্তির তথ্য বাবুলকে দেন এহতেশাম। ওই ঘটনার আসামি ধরে বাবুল বেশ সুনাম কুড়িয়েছিলেন। পরে বাবুলের নির্দেশে কামরুলকে এহতেশাম তার বালুর ব্যবসায় ব্যবস্থাপক হিসেবে নিয়োগ দেন।
জবানবন্দিতে আরও বলা হয়, ২০১৬ সালের মে মাসের দিকে কামরুল এহতেশামকে বলেন, স্যার (বাবুল) পারিবারিক সমস্যায় আছেন। তার স্ত্রীকে খুন করতে হবে। এ জন্য এহতেশাম যাতে অস্ত্র সংগ্রহ করে দেন। তখন এহতেশাম পারিবারিক বিষয়ে না জড়াতে কামরুলকে অনুরোধ করেন। কামরুল বিষয়টি বাবুলকে জানিয়ে দেন। পরে বাবুল এহতেশামকে ডেকে পাঠান। বিষয়টি তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে জানালে ঝামেলা হবে বলে হুমকি দেন। এরপর বিষয়টি কাউকে বলেননি এহতেশাম।
জবানবন্দিতে এহতেশাম বলেছেন, হত্যাকান্ডে ব্যবহারের জন্য অস্ত্র সংগ্রহ করে দেন তিনি। কামরুলও শুরুতে রাজি ছিলেন না। তাকে এ কাজ না করলে ‘ক্রসফায়ারের’ হুমকি দিয়েছিলেন বাবুল। যার কারণে কামরুল রাজি হন।
২০১৬ সালের ৫ জুন ছেলেকে স্কুলবাসে তুলে দিতে গিয়ে নগরীর জিইসি মোড় এলাকায় খুন হন মাহমুদা খানম। তখন তার স্বামী বাবুল আক্তার বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে গত ১২ মে এ মামলায় চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় পিবিআই। ওই দিন মাহমুদার বাবা মোশাররফ হোসেন বাদী হয়ে বাবুলসহ আটজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় হত্যা মামলা করেন। ওই দিনই বাবুল আক্তারকে এই মামলায় গ্রেপ্তার দেখায় পুলিশ। পিবিআই মামলাটির তদন্ত করছে।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রামের পরিদর্শক সন্তোষ কুমার চাকমা শনিবার রাতে বলেন, জবানবন্দি দেওয়ার পর আসামি এহতেশামকে কারাগারে পাঠিয়ে দিয়েছেন আদালত। হত্যাকান্ডে নেতৃত্বদাতা হিসেবে যার নাম এসেছে, সেই কামরুলকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
বাবুল আক্তার বর্তমানে ফেনী কারাগারে বন্দী। তিনি স্ত্রী মাহমুদা হত্যায় জড়িত নন বলে দাবি করেছেন তার আইনজীবী শেখ ইফতেখার সাইমুল চৌধুরী। এই আইনজীবী শনিবার বলেন, ঘটনার পরপরই এহতেশামকে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। কেন তখন তার জবানবন্দি নেওয়া হয়নি? এখন সব সাজানো নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে। বাবুল মামলার বাদী, সেই মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে নতুন মামলায় তাকে আসামি করেছে পিবিআই। বাবুলের মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে তাদের দেওয়া নারাজি আবেদনের ওপর আগামী সপ্তাহে আদালতে শুনানি হবে।
মাহমুদা হত্যাকান্ডের পর ২০১৬ সালের ২৭ জুন অস্ত্রসহ গ্রেপ্তার হন এহতেশামুল হক। ২০১৯ সালের ১৯ ডিসেম্বর জামিনে মুক্তি পান তিনি। এদিকে মাহমুদার বাবার করা মামলায় গত ১৫ সেপ্টেম্বর উচ্চ আদালত থেকে চার সপ্তাহের অন্তর্বর্তী জামিন পান এহতেশামুল হক। পরে উচ্চ আদালতের নির্দেশে আত্মসমর্পণ করার জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে সময়ের আবেদন করেন তিনি। ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ শেখ আশফাকুর রহমানের আদালতে আবেদনটি করা হয়। আদালত সময়ের আবেদন নামঞ্জুর করে তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
মামলাটির তদন্তকারী সংস্থা পিবিআই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ জুলাই আদালত এহতেশামুলসহ তিন আসামির দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেন। অন্য দুজন হলেন, কামরুল শিকদার ওরফে মুছা ও মো. কালু। এদিকে বাবুলের করা মামলায় পিবিআই চ‚ড়ান্ত প্রতিবেদন দেয় গত বছরের মে মাসে। এর বিরুদ্ধে বাবুলের আইনজীবী নারাজি আবেদন করেন। ২৭ অক্টোবর নারাজি আবেদনের ওপর শুনানির দিন ধার্য রয়েছে।