স্বদেশ দত্ত
এক
লিখতে বসে আমি মাঝে মাঝে ধ্যানস্থ ঋষি হয়ে যাই। ভাবছি পরিবেশ নিয়ে। একই সাথে সেই ভাবনাকে ছন্দে বাঁধার চেষ্টা চলছে। একটি লিমেরিক ধরা দিয়েছে।
পাহাড় তখন কাঁদছে ভীষণ
গাছ গাছালি কাটছে যখন
যাচ্ছে পাখি উড়ে
বিষন্ন তার সুরে
শীত-গ্রীষ্মের চক্রে লাগে ভাঙন।
এমন সময় কারেন্ট চলে গেলো। এলো মেলো হয়ে গেলো ভাবনা। টেনে নিলাম হাত পাখা। হাত পাখায় কাজ হচ্ছে না। বিড় বিড় করে বললাম – ফাগুন মাস, অথচ এখনই এতো গরম! নাজানি, গরমে কী হবে ?
কারেন্ট চলে এসেছে। খেয়াল করে দেখলাম চারপাশটা বন্ধ। মনে মনে হেসে উঠলাম – বদ্ধ ঘরে শীতও কী ? ফাগুনও কী ? গরম তো লাগবেই।
দক্ষিণের জানালাটা খুলে দিলাম। আকাশে তারার সমাহার। আমাকে হাত ছানি দিয়ে ডাকছে। আমি লেখা রেখে বের হলাম।
দুই
উঠে এলাম ছাদে। মাদুর পেতে খোলা আকাশের নিচে চিৎ হয়ে শুয়েছি। তাল গাছের মাথা ছুঁয়ে শুক্লপক্ষের আধখানা চাঁদ ফিক ফিকিয়ে হাসছে। চাঁদের আলোয় বাবুই পাখির বাসা বেশ ভালোই দেখা যাচ্ছে। সোনালী রং। ঝির ঝিরে বাতাসে দোল খাচ্ছে। আমি সেই নীড়ের দিকে তাকিয়ে আছি।
তালগাছ আর বাবুই পাখি, আমাকে নিয়ে গেল অতীতে। ছোট বেলায় বাবুই পাখি আর চড়–ই পাখির মধ্যে পার্থক্য করতে পারতাম না। সেই পাখি নিয়ে আমার কাঁচা হাতের লেখা।
মোদের বাড়ির পাশে আছে একটি তালগাছ
সেই গাছে বাস করে চড়ুই পাখির ঝাঁক
ফুরুৎ করে উড়ে চলে চড়ুই পাখির ঝাঁক
সকাল-সাঁঝে শুনতে যে পাই চড়ুই পাখির ডাক।
আমার প্রথম কবিতা। বাবা মুগ্ধ হয়ে পড়ছে। বাবা আমাকে আদর করে ডাকতো ‘চড়ুই পাখির ঝাঁক’।
তিন
চাঁদ চলেছে বাঁশ বাগানের মাথায়। একটি উল্কা উড়ে গেল। সাথে সাথে হাসি পেল। আমি উল্কা পাতকে বলতাম, তারাখসা। বাবা হাসতো। বাবার বড় গুণ, বাবা হাসতে পারতো। সুখ দুঃখ সবই হাসির চাদরে ঢেকে রাখা।
বাবা বলতো – বড় পথ ছোট পথকে বড় করে দেয়। মনকে কখনও ছোট করবিনা। আকাশের দিকে তাকা, মন বড় হয়ে যাবে।
বাবা আমাকে আকাশ দেখা শিখিয়েছে। উত্তর আকাশে ধ্রুব তারা। তার পাশে সপ্তর্ষিমন্ডল।
বাবাকে বড় বেশি মুগ্ধ করতো কালপুরুষ। বাবা বলতো-আদম সুরত আসে ফাগুনের ডাকে। দাঁড়িয়ে থাকেশিকারীর বেশে, তীর-ধনুকহাতে।
আমি এখন তীর-ধনুক হাতে দাঁড়িয়ে থাকা আদম সুরতকে খুঁজছি।
চার
ঝির ঝিরে বাতাস ঘুমের আবহ সৃষ্টি করেছে। চোখে ঘুমঘুম ভাব। চলে গেলাম ঘুমের দেশে। ধরা দিয়েছে স্বপ্ন।
বাবা আমার শিয়রের পাশে বসেছে। মাথায় হাত রেখে বলে Ñ ওরে আমার চড়–ই পাখির ঝাঁক, কী করিস ? ঠান্ডা লাগবে তো।
-আমি বলি – আদম সুরত খুঁজি।
-আদম সুরত কীভাবে খুঁজতে হয় মনে নেই ?
আছে। কোমর বন্ধের তিন তারা-ঊষা, অনিরুদ্ধ, চিত্রলেখা।
বাবা হেসে বলে – তোর মনে আছে ? তুই আকাশের দিকে তাকিয়ে, তারা গুনার খেলায় মেতেউঠতি। এক-দুই-তিন করে গুনতে গুনতে চলে যেতিঘুমেররাজ্যে। আমি তোকে কোলেকরেঘরেনিতাম।
বাবা প্রসঙ্গ পাল্টিয়েছে – তোর লিমেরিক লেখা কেমন চলছে ?
তুমি কেমনেজানলে ?
কেন ? তুই আমার খবর রাখিস না বলে ভেবেছিস আমিও রাখিনা ? আমি তোর সব খবর রাখি।
একটা লজ্জা লজ্জা ভাব চলে এসেছে।
বাবা হেসে বলে – শরম পেলি ? তোর শরম একটু বেশি! ছোট বেলায় সহপাঠি মেয়েদের সাথে শরমে কথাই বলতে পারতি না।
আমি কিছু বলছিনা। বাবা আবার লিমেরিকে চলে এসেছে।
হেসে বলল – এবার একটি লিমেরিক শোনা।
কোন ভনিতানাকরেবলতেলাগলাম –
আলোর বিক্ষেপনবুঝিনা, নীলাকাশ চিনি।
যেখানে আকাশ গঙ্গা রূপ ছড়ায় লাল-নীল-বেগুনী।
ঐ যে ফাগুন আসে,
আদম সুরত হাসে,
চিৎ হয়ে আকাশের তারা গুনি।
পাঁচ
ঘুম ভেঙে গেল। উঠে স্থির হয়ে বসেছি। তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে। মাথার মধ্যে স্মৃতিময় ছন্দ খেলা করছে।
রাতের বেলা ভূতের ভয়ে,
মায়ের আঁচল ধরা।
বাবার সাথে মুখে মুখে,
গদ্যে পদ্যে পড়া।।
দূর আকাশের ক্যাসিওপিয়া,
বাবার সাথে দেখা।
এখন আমি আকাশ দেখি,
বাবা ছাড়া একা।।
বাবাকে খুব করে মনে পড়ছে। চোখের কোনায় দু’এক ফোঁটা অশ্রু বিন্দু। আমি সেই অশ্রুবিন্দু মুছে দাঁড়িয়েছি।