বাবা বাতিঘরের অনন্য প্রতীক

34

এমরান চৌধুরী

পৃথিবীতে এমন কোনো সন্তান নেই যে বাবাকে ভালোবাসে না। প্রত্যেক সন্তানের কাছে বাবার মতো আদর্শ মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেই। সন্তানমাত্রই বাবার প্রতি পরম অনুরাগী। বাবা বাসায় বা বাড়িতে না ফেরা অবধি বাবার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে না এমন সন্তান ইহজগতে নেই বললেই চলে। মা বুকে জড়িয়ে রাখেন, বাবা সন্তানকে হাত ধরে আগামীর পথ দেখান। বন্ধুর, অমসৃণ পথ পাড়ি দিয়ে কীভাবে কাক্সিক্ষত গন্তব্যে পৌঁছা যায় তারই পথ প্রদর্শন করেন বাবা। মা-কে যদি আমরা বাড়ি বা ঘর বলি, বাবা সে ঘরের খুঁটি। যে খুঁটির উপর ভর করে একটি সংসার দাঁড়িয়ে থাকে। কোনো কারণে খুঁটি যদি নড়বড়ে হয় কিংবা ভেঙে পড়ে তাহলে ঘরের বা সংসারের কী অবস্থা হতে পারে তা কারো না বোঝার কথা নয়। এভাবে চোখের পলকে কত সংসারে যে আঁধার নেমে আসছে তাদের অন্তহীন মর্মজ্বালার কথা একমাত্র বাবাহীন পরিবারের সদস্যরাই ভালো বুঝবেন।
সন্তানের জন্য অদ্বিতীয় প্রাণ এ মহান পুরুষের সম্মানে প্রতি বছর পালিত হয় বিশ্ব বাবা দিবস। সঙ্গতকারণেই প্রশ্ন উঠতে পারে কেন এই বাবা দিবস? কেন এই মা দিবস? আমরা প্রত্যেকেই তো মা-বাবাকে ভালোবাসি। আসলে কথাটা আংশিক সত্য। ভালোবাসলে দিবস ঘোষণা করে তাগিদ দিতে হবে কেন? বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসা জ্বর মাপার থার্মোমিটারের মতো। শৈশব-কৈশোরে বাবা-মায়ের প্রতি যে আকর্ষণ থাকে বয়স বাড়ার সাথে সাথে তা ক্রমশঃ নিম্নমুখী হয়। আর পুত্র সন্তান যখন বিয়ে করে তখন তা আরও কমে ভালোবাসার পরিবর্তে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। আর সে দূরত্ব মা-বাবাকে আলাদা করে দেওয়া থেকে শুরু করে বৃদ্ধাশ্রম পর্যন্ত গড়াতে পারে। সন্তানদের জন্য মা-বাবার অবদানকে স্মরণ করে দিতে কিংবা বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানের কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে বিশ্ব বাবা দিবস পালন করা হয়।
এ দিবসটি পালনের জন্য জুন মাসের তৃতীয় রবিবার নির্ধারিত থাকলেও পৃথিবীর কিছু দেশ অন্যদিনেও দিবসটি পালন করে। বাংলাদেশসহ পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশ জুন মাসের তৃতীয় রবিবার বাবা দিবস উদযাপন করে। এই হিসেবে গতকাল ছিল আমাদের দেশে বাবা দিবস। বিভিন্ন সংগঠন এবং ব্যক্তিগত উদ্যোগে গতকাল বাবা দিবস পালিত হয়েছে অবিমিশ্র শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায়। আসলে যে কোনো দিবসের মাহাত্ম্য হচ্ছে সচেতনতা তথা মানুষের প্রতি মানুষের দায়বোধ জাগ্রত করা। অনেকে বলতে পারেন আমার বাবা-মা দিব্যি আরামেইতো আছেন। প্রতি মাসে তাঁদের জন্য টাকা পাঠাচ্ছি, তাঁদের সেবাযত্নের জন্য একজন কাজের লোক রেখেছি -আর কী চাই! মনে রাখতে হবে কাজের লোকের শতবার বাবা ডাক আর আপন রক্তের একবার ডাক মা-বাবার অন্তরে বয়ে দিতে পারে অমিয় ঝর্ণাধারা। পৃথিবীতে টাকা দিয়ে সব সুখ কেনা যায় না, যা কেনা যায় সবই কৃত্রিম,আসল সুখ কেনার জন্য কিংবা দেয়ার জন্য প্রয়োজন মুখের দু’একটা সুন্দর বচন। সন্তানের মুখে একবার বাবা ডাক ঐ দিনের জন্য বাবার জন্যে হয় সবচেয়ে বড়োপ্রাপ্তি। অফিসে যাওয়ার আগে কিংবা অফিস থেকে বাসায় ফিরে যে সন্তান বাবা-মায়ের মুখদর্শন করেন তাঁর চেয়ে আদর্শবান সন্তান আর কেউ হতে পারে না। কারণ আমাদের যাপিত জীবনে আমরা এতটাই ব্যস্ত যে অনেক পরিবারে বয়োবৃদ্ধ মা-বাবার চেহারা দেখাও হয়ে ওঠে না। তাঁদের যতই অন্যলোক দিয়ে সেবাযত্ন করা হোক না কেন আপনার নিজের হাতে এক গ্লাস পানি যদি বাবা-মাকে দিতে পারেন দেখবেন কী স্বর্গীয় হাসি তাঁদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি বস্তু বাবার বাড়ানো হাত। যে হাত অনেক গুণের আধার, আশ্রয়, প্রশ্রয়, স্নেহ, ভালোবাসা, নির্দেশনা ও বাতিঘরের অনন্য প্রতীক। সর্বোপরি বাবার হাত নিরলস শ্রমের হাতিয়ার। যে হাতিয়ারের সুবাদে আমরা বেড়ে উঠি আলো-বাতাসে।
মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা এই বিশ্বজগত সৃষ্টির পর প্রথম যে মানুষ সৃজন করেছেন তিনি ছিলেন একজন পুরুষ। আর এ মহান পুরুষটির নাম হযরত আদম (আ),যাকে আমরা বাবা আদম বলে জানি। সবচেয়ে বড় কথা এ আদম (আ) মানবজাতির আদি পিতা। এভাবে মুসলমান জাতির পিতা হিসেবে হযরত ইবরাহিম (আ) এর নাম এবং আদর্শ পিতা হিসেবে হযরত লোকমান (আ) এর নাম গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের সাথে মুসলিম জাহানে সর্বত্র উচ্চারিত হয়। সন্তানদের উদ্দেশ্যে হযরত লোকমান (আ) এর প্রদত্ত উপদেশ আল্লাহ পাক এতই পছন্দ করেন যে, তাঁর নামে একটা সূরা নাযিল করেন। এ থেকে আমরা সহজে বুঝতে পারি পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাসের সাথে পিতা বা বাবার কী অপরিসীম অবদান।
সৃষ্টির আদি থেকে শুরু করে সন্তানের প্রতি বাবার যে ভালোবাসা তাতে এতটুকু চিট ধরেনি। বাবা তাঁর নিরন্তর শ্রম-ঘাম-মেধা আর অন্তরের নির্যাস দিয়ে সন্তানের শুধু মঙ্গল কামনাই করেন না,সন্তানের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করতে এতটুকু দ্বিধা করেন না। কবি গোলাম মোস্তফা তাঁর ‘জীবন বিনিময়’ কবিতায়’ পিতৃস্নেহের কাছে কীভাবে মৃত্যুও পরাজিত হয় তার এক অমর অতুল গাথা রচনা করেছেন। বাদশাহ বাবর নিজের জীবনের বিনিময়ে প্রিয় পুত্র হুমায়ূনের জীবন ভিক্ষা চেয়েছিলেন পরম করুণাময় আল্লাহ রাব্বুল আলামিন এর কাছে। আল্লাহপাক বাদশাহ বাবরের আর্জি মন্জুর করে হুমায়ূনের জীবন ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। সন্তানের জন্য বাদশাহ বাবরের এ আত্মত্যাগ সন্তান বাৎসল্যের অনুপম দৃষ্টান্ত। বাবা বটবৃক্ষের ছায়ার মতো সন্তানের মাথার ওপর ছাতা হিসেবে মঙ্গল কামনা করেন।সন্তানের যে কোনো বিপদে আপদে বাবা ছায়া সঙ্গী হয়ে থাকেন অষ্টপহর। শৈশবে যে বাবার হাত ধরে আমাদের পথচলা শুরু হয়, সে পথের দিশারী এক সময় আমাদের জীবনের আদর্শ হয়ে ওঠে। সে আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধায় অবনত হয়ে বিশ্বের প্রত্যেক দেশ পালন করে বিশ্ব বাবা দিবস। বাবাকে ভালোবাসার জন্য, শ্রদ্ধা জানানোর জন্য, সম্মানের জন্য কোনো নির্দিষ্ট দিনের প্রয়োজন হয় না। তবু একটি নির্দিষ্ট দিন বাবার সাথে সন্তানের একান্তে কাটুক, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সিক্ত হোক বাবারা, এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে প্রতি বছর পালন করা হয় বিশ্ব বাবা দিবস।
ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর মতে বাবা শব্দটি এসেছে বপপ থেকে। তাঁর মতে বাবা শব্দটি সংস্কৃত পিতা থেকে আসেনি। প্রাকৃত ভাষা বপপ থেকে এসেছে বাপ। আবার বাপ থেকে বপু। আবার রূপটি এসেছে ঠিক এভাবে বপপ> বাপু> বাবু>বাবা। বাবাকে যে নামে যে ভাষায় ডাকা হোক না কেন বাবার ভালোবাসা কোনো অংশে কমে যায় না। আমাদের দেশে বাবাকে বাবা, আব্বা, আব্বুজি, বাপি, আব্বু এসব নামে ডাকা হয়। ভাষার বৈচিত্র্যের কারণে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাবাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে ডাকা হয়। ভাষা না বুঝলেও বোঝা যায় এটি বাবার প্রতিশব্দ। হিন্দি ভাষায় বাবাকে পিতাজি, ইন্দোনেশিয়ান ভাষায় আইয়্যাহ, হাঙ্গেরিয়ান ভাষায় পাপা, জার্মানি ভাষায় ফ্যাটা, জাপানি ভাষায় ওতোসা, হিব্রু ভাষায় আব্বাহ আর ই্যরেজি ভাষায় ফাদার ড্যড, ড্যাডি নামে ডাকা হয়।
পৃথিবীর নানা দেশে নানান ভাবে বাবা দিবস পালন করা হয়। ব্যক্তি বিশেষেও বাবা দিবস পালনে পার্থক্য দেখা যায়। তবে বাবা দিবসের মূল বিষয় হচ্ছে উপহার। এদিন ছেলেমেয়েরা বাবার সবচেয়ে পছন্দের জিনিস বাবাকে উপহার দেয়। এ পছন্দের জিনিস হতে পারে নানা ধরনের জামা, বিশেষ কোনো খাবার- যা বাবার খুব পছন্দ। এমনও হতে পারে বাবাকে নিয়ে কোনো দর্শনীয় স্থানে বেড়ানো। কোনো কোনো দেশে ছেলেমেয়েরা বাবাকে কার্ড ও ফুলের তোড়া উপহার দেয়। আবার কেউ কেউ কেক কেটে সাড়ম্বরে বার্থ ডে এর মতো বাবা দিবস পালন করে। তবে সবকিছু নির্ভর করে স্থান কাল পাত্রের উপর। যে পরিবারে নুন আনতে পান্তা ফুরায় সেখানে বাবা দিবসের কোনো আহবান পৌঁছানোর কথা নয়। আবার যে পরিবারে বাবা বয়োবৃদ্ধ সেখানকার বাবা দিবস আর সচ্ছল, মাঝবয়সী বাবার বাবা দিবস কখনো এক হবার কথা নয়। সবচেয়ে বড়কথা শহুরে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত পরিবারে বাবা দিবস যে আড়ম্বরে পালিত হয় বিত্তবান পরিবারে বিত্ত থাকলেও চিত্তের অভাবে তা পালন করা হয় খুব কমই। তাই বাবা দিবস শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর কাছে সর্বাধিক গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
পৃথিবীর মানুষ যে যেভাবে বাবা দিবস পালন করুক না কেন বাবা দিবস পালনের লক্ষ্য ও সুর কিন্তু অভিন্ন। আর সে অভিন্ন সুর হচ্ছে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা, ভক্তি ও ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ করা। জন্মদাতা হিসেবে, পরিবারের প্রধানকর্তা হিসেবে এবং শাসক ও প্রশাসক হিসেবে বাবা যে নিরলস শ্রম দিয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করেছেন সন্তানের কাছে সে বার্তা পৌঁছে দেওয়া- বাবার প্রতি সন্তানের দায়িত্ব ও কর্তব্যের স্মরণ করিয়ে দেয়া। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে পিতামাতার সেবাযতœ ও সন্তুষ্টির ব্যাপারে সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে। আমাদের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) বলেছেন, পিতার সন্তুষ্টিতেই আল্লাহর সন্তুষ্টি, পিতার অসন্তুষ্টিতেই আল্লাহর অসন্তুষ্টি। সুতরাং আমাদের সবার উচিত বাবার প্রতি আমাদের যথাযথ ভক্তি ও শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা। আর তাতেই আমরা পেতে পারি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলার সর্বোত্তম নেয়ামত।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক