বাবার প্রেরণায় যুদ্ধে যান মধুমিতা ও আলো একের পর এক লাশ দাফন করেন ‘লেদু ফুফু’

22

এম আনোয়ার হোসেন, মিরসরাই

এবারের কথা মুক্তিযুদ্ধে তিন সাহসী নারীর। দুই জন মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। আর লেদু আক্তার গ্রামে গ্রামে শুধু হানাদার পাক বাহিনীর বর্বরতায় নিহত শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দাফনে যুক্ত ছিলেন। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বীরদের পাশাপাশি বীরাঙ্গনারাও অংশ নেন। এর মধ্যে মিরসরাইয়ে যুদ্ধে অংশ নেন দুই কিশোরী।
মিরসরাইয়ে প্রায় ২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন, তাদের মধ্যে কিশোরী দুই বোনও দেশ মাতৃকাকে স্বাধীনতার স্বাদ পাইয়ে দিতে সাড়া দেন। তারা হলেন- মধুমিতা বৈদ্য ও আলো রাণী বৈদ্য। ২০১৭ সালের ৫ মে আলো রাণী বৈদ্য পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন। বর্তমানে মিরসরাই উপজেলার একমাত্র নারী মুক্তিযোদ্ধা মধুমিতা বৈদ্য ৩ নম্বর জোরারগঞ্জ ইউনিয়নের ১ নং ওয়ার্ডের গোপীনাথপুর গ্রামে ১৯৫৬ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা ক্ষিতিষ চন্দ্র বৈদ্য ছিলেন ব্রিটিশ সরকারের সৈনিক। তার মায়ের নাম মালতী রানী বৈদ্য। স্বামী বাদল চন্দ্র দে। মধুমিতা বৈদ্যের মুক্তিযোদ্ধা সনদ নম্বর ০২০৩০৪০১৯০।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ নিয়ে মধুমিতা বলেন, ‘তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্রী। বয়স মাত্র ১৫ বছর। পড়তাম মিরসরাইয়ের আবুল কাশেম বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে। আমার বাবা আমাকে খুবই ভালোবাসতেন। আর আমি অনেক ভালোবাসি আমার দেশকে। এ দুইয়ের সম্মিলনেই আমার যুদ্ধে যাওয়া। মূলত বাবাই আমাকে অনুপ্রেরণা যোগান মুক্তিযুদ্ধে কাজ করতে। তিনি চেয়েছিলেন, আমি যেন অন্তত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দিয়ে যাই। যুদ্ধের শুরুতেই ফেনীর ছাগলনাইয়ার সীমান্ত পেরিয়ে পাড়ি দিই ভারতের শ্রীনগর ক্যাম্পে। সেখানে ১ নম্বর সেক্টরে মেজর হায়দারের সহযোগিতায় বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতালের দেশরক্ষা বিভাগে যোগ দিই। সেখানে আমাদের সঙ্গে ছিলেন কবি সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে টুলু ও লুলু। আমাদের ক্যাম্পের ক্যাপ্টেন ছিলেন বেগম সিতারা। এই ক্যাম্পে আমি শত শত যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাকে সেবা দিয়েছি। তাদের মতো মহান বীরদের সেবা দিতে পেরে আমি খুব গর্ববোধ করি। প্রথম যার সেবা করেছি তিনি ছিলেন আমাদের মিরসরাইয়ের অধিবাসী, তার নাম শেখ আলম। এরপর আমি যখন মেডিকেল ওয়ার্ডে চলে যাই, তখনও আমাদের মিরসরাইয়ের নিজামপুর কলেজ এলাকার জ্ঞান বিকাশ বড়–য়াকে সেবা দেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তিনি ছিলেন আমার সুপরিচিত। সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিতে গিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হয়েছিলেন। কয়েক বছর আগে তিনি মারা গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন স্মৃতি রোমন্থন করে মধুমিতা বৈদ্য বলেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সেবা দিতে গিয়ে আমাদের তেমন কোন অসুবিধায় পড়তে হয়নি। তবে প্রথমদিকে একবার মৃত্যুর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। প্রশিক্ষণ শেষে ক্যাম্পে যাওয়ার পথে আমাদের গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়েছিল। আমরা সৌভাগ্যক্রমে সেদিন রক্ষা পেয়েছিলাম। দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর আমরা বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরি। দেশের অবস্থা তখন খুবই নাজুক। সাজানো-গোছানো দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বাংলার পথ-প্রান্তর তখনও রক্তে রাঙানো। সবুজ মাঠে লেগে আছে লাল রক্ত। আমি বসে থাকিনি। দেশ রক্ষার পর এবার শুরু হলো দেশ গড়ার কাজ। প্রথমদিকে নরওয়ে এবং শেষে সুইজারল্যান্ডের টিমের সঙ্গে আমি যুক্ত হই। তাদের সঙ্গে একত্রিত হয়ে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রুষা দিই। নানাভাবে সহায়তা করি। আমার বাবা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের সৈনিক। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তিনি চলে আসেন গ্রামে। আগে থেকেই আমরা এলাকার মানুষদের মাঝে নানান সচেতনতামূলক কর্মকান্ড চালাই। বাবাই সব সময় আমাকে সাহস যুগিয়েছেন।
মুক্তিযুদ্ধে মিরসরাইয়ে আর এক সাহসী নারী ছিলেন লেদু আক্তার। মুক্তিযুদ্ধে তিনি তার কাজের জন্য ‘লেদু ফুফ’ হিসাবে এলাকায় পরিচিত হয়ে উঠেন। ১৯৭১ এর ২০ এপ্রিল মিরসরাই উপজেলার ১৩ নং মায়ানী ইউনিয়নের সৈদালী গ্রামে পাকিস্তানীদের বর্বর গণহত্যায় শহীদ হন ২২ জন। তখন লাশগুলো দাফন করার মত কেউ ছিল না। পুরো এলাকা হয়ে পড়ে পুরুষশূন্য। এ অবস্থায় লাশগুলো ‘দাফনে’ এগিয়ে আসেন এক নারী। স্থানীয়রা তাকে চিনতেন, ডাকতেন ‘লেদু ফুফু’ নামে। সাহসী এই নারীর স্মৃতিচারণ করেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক (ডিএমডি) ও সৈদালীর সন্তান আ আ ম শাহজাহান, ‘যুদ্ধের সময় আমি ৬ষ্ঠ কিংবা ৭ম শ্রেণীর ছাত্র ছিলাম। ২০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী সৈদালী গ্রামে গণহত্যা ও আগুন জ্বালিয়ে ছারখার করে দেয়। এসময় এক পরিবারের ৫ জনসহ ২২ জন শহীদ হন। এসব লাশ দাফনের জন্য কোন পুরুষ ছিল না। তখন আমরা দেখেছি লেদু ফুফু সবার আগে এগিয়ে এসে লাশ দাফনের মূল কাজটি করেন।’
২০ এপ্রিলের স্মৃতি ধরে রাখা সাবেক এই ব্যাংকার বলেন, ‘দাফন বলতে কবরের মত খুঁড়ে তাতে মাটি চাপা দেওয়া! গ্রামের আরো কয়েকজন মহিলাকে সাথে নিয়ে পৃথক পৃথক স্থানে গর্তের মতো খুঁড়ে লাশ দাফন করেন লেদু ফুফু। তিনি অন্য মহিলাদের চেয়ে একটু ব্যতিক্রম ছিলেন। অনেক সাহসী, একেবারে কর্মঠ ছিলেন। সবাই যখন প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছিলেন, তখনই তিনি কঠিন কাজটি করেন।’
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় লেদু ফুফুর বয়স ছিল ৩৫-৪০ বছর। যুদ্ধের আগে স্বামীর সাথে ছাড়াছাড়ি হলে সৈদালীর নিজ গ্রামে চলে আসেন তিনি। তার এক ছেলে থাকলেও যুদ্ধের আগে মারা যায়।
সৈদালী নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ বলেন, ‘গ্রামে কোন বাড়িতে রান্নার বিশেষ আয়োজন হলে লেদু ফুফুর ডাক পড়তো। সৈদালী গ্রামের সব বাড়িতে তার অবাধ যাতায়াত ছিল। সবাই খুব সম্মান করতেন। ২০১৭ সালের ১৮ এপ্রিল বার্ধক্যজনিত কারণে লেদু ফুফু মারা গেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘লেদু ফুফুর দূর সম্পর্কের আত্মীয় হন বড়তাকিয়া বাজারের ব্যবসায়ী নুর মোহাম্মদ। তার বাড়িতেই জীবনের শেষ সময়টুকু পার করেন লেদু ফুফু। বর্তমানে লেদু ফুফুর কোন ওয়ারিশ নেই।’