বাপ্পী লাহিড়ী থেকে ‘গোল্ডম্যান’

48

বিনোদন ডেস্ক

ভারত ও বাংলাদেশে তুমুল জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী। গত মঙ্গলবার মধ্যরাতে মুম্বাইয়ের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬৯ বছর। তার মৃত্যুতে ইতি ঘটেছে বাংলা ও হিন্দি সিনেমার গানের অবিস্মরণীয় এক অধ্যায়ের। সত্তরের দশকের গোড়ার দিকেই সিনেমার গানে আত্মপ্রকাশ করেন বাপ্পী লাহিড়ী। তিনি একাধারে গানের সুর, সংগীতের পাশাপাশি গাইতেনও। অসংখ্য দর্শকপ্রিয় সিনেমার গান করেছেন তিনি। ভারতীয় সিনেমার গানে সিনথেসাইজড ডিস্কো ঘরানা জনপ্রিয় হয়েছে তার হাত ধরেই। ১৯৫২ সালে ভারতের জলপাইগুড়িতে জন্ম তার। বাবা-মায়ের দেওয়া নাম ছিল অলোকেশ লাহিড়ী। কিন্তু সেই নামে তিনি তেমন পরিচিতি পাননি। শখ করে বাপ্পি ডাক নাম রেখেছিলেন তার এক আত্মীয়। ব্যস সেটিই যেন এক পর্যায়ে সংগীতের ব্র্যান্ড নেম হয়ে গেলো। বাপ্পি লাহিড়ী। কে জানতো একদিন ওই নামেই গোটা বিশ্ব কাঁপাবেন বলিউডের এই সংগীতশিল্পী।
বাপ্পিজির সঙ্গে লন্ডনের রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি চিরকাল মনে পড়বে : রুনা লায়লা

ভারতীয় সঙ্গীতাকাশ থেকে একে একে ঝরে যাচ্ছে নক্ষত্রগুলো। গত ৬ ফেব্রুয়ারি চলে গেলেন সুরের সরস্বতী দেবী খ্যাত লতা মঙ্গেশকর। তার প্রয়াণের শোক সামলে না উঠতেই গত ১৫ ফেব্রুয়ারি না ফেরার দেশে পাড়ি জমান কিংবদন্তি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। একইদিন রাতে চলে গেলেন আরেক নন্দিত সংগীতশিল্পী বাপ্পী লাহিড়ী। মৃত্যুর এ মিছিল সহ্য করা যে কারোর জন্যই কঠিন। তবে তাদের সঙ্গে যাদের স্মৃতি মিশে আছে, তারা রীতিমতো স্তব্ধ, নির্বাক। সেই স্তব্ধতার মাঝেই শোকবার্তা দিলেন রুনা লায়লা। উপমহাদেশের কিংবদন্তি এই গায়িকার সঙ্গে সদ্য প্রয়াত তিন শিল্পীর চমৎকার সম্পর্ক ছিল। সর্বশেষ বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যুর খবর শুনে হতবাক হয়ে গেছেন রুনা লায়লা। ফেসবুকে তিনি লিখেছেন, “অসামান্য প্রতিভাবান সুরকার ও গায়ক বাপ্পী লাহিড়ীর মৃত্যুর খবর শুনে মর্মাহত এবং দুঃখিত। তার সঙ্গে বেশ কয়েকটি চলচ্চিত্রের গান ও মিউজিক অ্যালবামে কাজ করার সৌভাগ্য হয়েছে আমার। যার মধ্যে একটি ছিল সুপার হিট অ্যালবাম ‘সুপারুনা’।
আমরা বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় অসংখ্য কনসার্ট করেছি।” বাপ্পী লাহিড়ির সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের কথা জানিয়ে ‘এসবের উর্ধে তিনি একজন বন্ধু ছিলেন। হাস্যরসাত্মক, মজাদার ও প্রিয়। তাকে বিদায় জানানো খুব কঠিন, কেননা তার আরও অনেক কিছু জয় করা বাকি ছিল।’ রুনা লায়লা আরও লিখেছেন, ‘কয়েকদিনের ব্যবধানে লতা দিদি ও সন্ধ্যা দিদির পর এবার বাপ্পিজিকে চিরবিদায় জানাতে হলো। তাদের হারানোর শোক প্রকাশের ভাষা নেই আমার। কান্নাও যথেষ্ট নয়। আমি পুরোপুরি স্তব্ধ ও বিষাদগ্রস্ত।’ তিনি আরো বলেন, ১৯৮২ সালে এই পপ অ্যালবামটির রেকর্ডিং হয় লন্ডনের অ্যাবি রোড স্টুডিওতে। একসময়ের বিখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের সদস্যরা সেখানেই তাদের গান রেকর্ড করতেন। বাপ্পিজির সঙ্গে সেই স্টুডিওতে রেকর্ডিংয়ের স্মৃতি চিরকাল মনে পড়বে। ‘সুপারুনা’ অ্যালবামটি প্রকাশের দিনেই এর ১ লাখ কপি বিক্রি হয়েছিল। এজন্য প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান ইএমআই মিউজিক আমাকে উপহার হিসেবে গোল্ডেন ডিস্ক অ্যাওয়ার্ড দিয়েছিল।”
লতা মঙ্গেশকরের কোলে ছোট্ট বাপ্পি-
নেটমাধ্যমে বরাবরই বেশ সক্রিয় ছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। গত ৬ ফেব্রæয়ারি লতা মঙ্গেশকরের প্রয়াণে শোকস্তব্ধ হয়ে তিনি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করেন লতা মঙ্গেশকরের সঙ্গে তার ছোটবেলার ছবি। যেখানে লতার কোলে বসে আছেন ছোট্ট বাপ্পি। আজ দু’জনের কেউই আর নেই। নেটমাধ্যমে ভাইরাল হল সেই ছবি। ভক্তরা ছবিটির নীচে লতা মঙ্গেশকর এবং বাপ্পি লাহিড়ী দু’জনেরই আত্মার শান্তি কামনা করছেন।
বাপ্পী লাহিড়ী এত গয়না পরতেন কেন?
গানে তো বটেই, ব্যক্তিত্বেও অন্যদের চেয়ে অনেকটা আলাদা ছিলেন বাপ্পী লাহিড়ী। নন্দিত এই সংগীতশিল্পী সবসময় অনেকগুলো গয়না পরে থাকতেন। গলায় মোটা স্বর্ণের চেইন, ব্রেসলেট, আংটিতে ভরে থাকতো তার অঙ্গ। এটা তার প্রধানতম বৈশিষ্ট্য ছিল। এজন্য তাকে বলা হয় বলিউডের ‘গোল্ডেন ম্যান’। কিন্তু প্রশ্ন হলো এত গয়না পরতেন কেন বাপ্পী লাহিড়ী? এ প্রশ্নের জবাব জীবিত থাকাকালীন দিয়েছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে কিংবদন্তি জানিয়েছিলেন, গহনার প্রতি ভালোবাসার প্রধান কারণ তিনি মার্কিন মিউজিশিয়ান এলভিস প্রেসলির দ্বারা অনুপ্রাণিত। বাপ্পী লাহিড়ী বলেছিলেন, ‘মার্কিন গায়ক এলভিস প্রেসলি সোনার হার পরতেন। আমি প্রেসলির বড় ভক্ত ছিলাম। আমি ভাবতাম, যদি কোনো দিন সফল হই, তাহলে নিজের অন্যরকম ভাবমূর্তি গড়ে তুলব। ঈশ্বরের আশীর্বাদে সোনার মাধ্যমে সেটা করতে পেরেছি। আগে লোকে ভাবত, আমি সবাইকে দেখানোর জন্যই সোনার গয়না পরি। কিন্তু সেটা ঠিক না। সোনা আমার কাছে পয়া। আমার এগিয়ে যাওয়ার সাহস।’
যেভাবে গিনেস রেকর্ডে নাম উঠেছিল বাপ্পি লাহিড়ী-
শুধু বলিউডই নয়, নামটা একেবারে গিয়েছিল গিনেস বুকে ওয়ার্ল্ড রেকর্ডেও। সে গল্পটাই বলা হবে। তার আগে এই সংগীত তারকার শুরুটা জেনে নেওয়া যাক। বাবা অপরেশ লাহিড়ী আর মা বাঁসুরী লাহিড়ী ছিলেন বাংলা সংগীত জগতের পরিচিত নাম। ফলে মা-বাবার থেকেই গানের জগতে হাতেখড়ি। ১৯ বছর বয়সে চোখে স্বপ্ন নিয়ে মুম্বাই পাড়ি দেন বাপ্পি লাহিড়ী। ইচ্ছে- সেখানেই প্রতিষ্ঠা পাওয়া।
১৯৭৩ সালে হিন্দি ভাষার সিনেমা ‘নানহা শিকারি’ ছবিতে প্রথম গান করলেন তিনি। তারপর থেকে একের পর এক সিনেমায় গান লেখা ও মিউজিক ডিরেক্টরের কাজ। তাহির হোসেনের ‘জখমি’ সিনেমায় তার সংগীত বেশ প্রশংসিত হয়েছিল। সেখান থেকেই তার জীবনের মোড় ঘুরতে শুরু করে। এরপর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। বরং চলচ্চিত্র নির্মাতারা তার দিকেই তাকিয়ে থেকেছেন। ব্যস্ততাও বেড়ে যায় বহুগুণে। আর কাজের সূত্রেই করেন বিশ্ব রেকর্ড। ৩৩টি ছবির জন্য ১৮০টি গান রেকর্ড করে ১৯৮৬ সালে গিনেস বুক অব ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নিজের নাম তুলেছিলেন বাপ্পি লাহিড়ী। এমনকি জনাথান রসের লাইভ পারফরম্যান্সে আমন্ত্রণ পাওয়া একমাত্র ভারতীয় মিউজিক ডিরেক্টর ছিলেন তিনি। এরপর প্রায় পাঁচ দশক ধরে বিস্তৃত তার সংগীতজীবন। রোমান্টিক থেকে শুরু করে ভজন, কাওয়ালী, রাগাশ্রয়ী গান থেকে শুরু করে ডিস্কো সংগীত, সবকিছুতেই তার অনেক যাতায়াত। নিজের গান দিয়ে নাচিয়ে ছেড়েছিলেন ছোটবড় সবাইকেই।
জীবনীচিত্র বানাতে চেয়েছিলেন অনেকেই, নিজের চরিত্রে কাকে পছন্দ ছিল বাপ্পির-

ঘটনাবহুল জীবন তাঁর। বর্ণিলও বটে। বলিউডের ‘ডিস্কো কিং’-এর জীবনের গল্প পর্দায় ফুটিয়ে তুলতে চাওয়া পরিচালক-প্রযোজকদের অভাব ছিল না। অতীতে এক সাক্ষাৎকারে সে কথা জানিয়েছিলেন বাপ্পি লাহিড়ি স্বয়ং। জীবনীচিত্র করতে চেয়ে অনেকেই ভিড় করেছিলেন বাপ্পির কাছে। কিন্তু এ বিষয়ে কোনও কথাই চূড়ান্ত করে উঠতে পারেননি প্রখ্যাত সুরকার-গায়ক। তবে নিজের যৌবনকালের চরিত্রে রণবীর সিংহকে দেখতে চেয়েছিলেন প্রয়াত শিল্পী। চেয়েছিলেন, তাঁর ফেলে আসা দিনগুলি পর্দায় ফুটিয়ে তুলুন ‘৮৩’-র অভিনেতা।