বান্দরবানের ২৮টি অবৈধ ইটভাটায় ধ্বংস হচ্ছে বন

7

মো. শাফায়েত হোসেন, বান্দরবান

বান্দরবানের লামা উপজেলার ফাইতং এবং নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুমে অবৈধ ইটভাটায় প্রতিদিনই পোড়ানো হচ্ছে হাজার হাজার মণ বনের গাছপালা। এতে ধ্বংস হচ্ছে বন, ঝুঁকিতে পড়েছে পরিবেশ। বনের গাছ পোড়ানোর কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই এসব অবৈধ ভাটা চলছে বলে অভিযোগ করে ক্ষতিকর ভাটাগুলোর বিরুদ্ধে স্থায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি স্থানীয়দের।
জানা গেছে, লামা উপজেলার ফাইতং ইউনিয়নে অবৈধভাবে ২৮টি ইটভাটায় প্রকাশ্যে চলছে ড্রাম চিমনি ও পাকা চিমনির ইটভাটার কার্যক্রম। নীতিমালা লঙ্ঘন করে বনের মাঝে ও লোকালয় এবং কৃষিজমিতে গড়ে উঠেছে এসব ইটভাটা। প্রতিদিনই গহীনের পাহাড়গুলো কেটে এর মাটি ব্যবহার করা হচ্ছে ইট তৈরিতে। ফলে পাহাড়গুলো নিশ্চিহ্ন হচ্ছে প্রতিনিয়ত, হুমকির মধ্যে পড়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও প্রাণীক‚লও। উজাড় হচ্ছে আরণ্যক প্রকৃতি। অধিকাংশ ইটভাটা গড়ে উঠেছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশে, লোকালয়ে, বনাঞ্চল ঘেঁষে ও ঊর্বর কৃষি জমিতে। অধিকাংশ পাহাড় এখন ইটভাটায় পরিণত হয়েছে। আবার আর্থিকভাবে সাময়িক লাভবান হওয়ার আশায় অনেক কৃষক তাদের ফসলী জমির মাটি বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানান স্থানীয়রা।
ইটভাটার শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতি ইটভাটায় ইট পোড়াতে দৈনিক প্রায় ৪০০ মন কাঠ প্রয়োজন। সে হিসেবে ২৮টি ইভাটায় দৈনিক সাড়ে ১১ হাজার মন কাঠ বনবিভাগকে ম্যানেজ করে ইটভাটায় জ্বালানো হচ্ছে। গত নভেম্বর থেকে শুরু হয়ে এই কাঠ পোড়ানোর কাজ চলবে চলতি বছরের এপ্রিল মাস পর্যন্ত। ফলে আশেপাশের পাহাড়ি বন ও প্রাকৃতিক প্রাণীক‚লের অভয়াশ্রমগুলো ঝুঁকিতে পড়ছে। বন ও পাহাড় উজার করে পরিবেশকে মারাত্মক সংকটাপন্ন করে তোলা হচ্ছে।
জানা গেছে, ইট প্রস্তুত মৌসুম শুরুর আগে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে চলছে সকল অবৈধ ইটভাটা। বছরের পর বছর এসব অবৈধ ইটভাটাগুলো আইনের তোয়াক্কা না করে চালানো হলেও প্রশাসন, বনবিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তর শক্ত কোনো পদক্ষেপই গ্রহণ করছে না অজ্ঞাত কারণে। মাঝে মধ্যে প্রশাসনের পক্ষ থেকে নামে মাত্র অভিযান চালিয়ে আর্থিক জরিমানা করা হলেও পরদিনই আবারো ভাটাগুলো বহাল তবিয়তে তাদের অবৈধ কাজ শুরু করে দেয়।
সম্প্রতি নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুম এলাকায় তিনটি ইটভাটা বন্ধ করে দেওয়া হয় বলে দাবি পরিবেশ অধিদপ্তর ও উপজেলা প্রশাসনের। কিন্তু অভিযানের দুই দিন পর ওই ইটভাটাগুলো পুনরায় কাজ শুরু করে এখনো দিব্যি কার্যক্রম চালাচ্ছে।
এদিকে ইটভাটায় জ্বালানী হিসেবে কয়লা ব্যবহারের নিয়ম থাকলেও যথেচ্ছভাবে কাঁচামাল হিসেবে বন ও পাহাড়ি গাছ পোড়ানো হচ্ছে। ইট প্রস্তুতে জলাশয়ের মাটি ব্যবহারের কথা থাকলেও ব্যবহৃত হচ্ছে পাহাড়ের মাটি। এজন্য এস্কেভেটর দিয়ে দিন-রাত কাটা হচ্ছে বড় বড় পাহাড় ও টিলা। উজাড় হচ্ছে শত শত একর বনভ‚মি। ফসলী জমির মাটিও ইটভাটায় ব্যবহৃত হচ্ছে যা আইনবিরুদ্ধ। ইট তৈরিতে পাহাড়ের মাটি ও বনের কাঠ ব্যবহার করায় একদিকে যেমন ধংস হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ তেমনি ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। ইটভাটার কালো ধোঁয়ায় দূষিত হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ। অতিরিক্ত ইট বোঝাই ট্রাক চলাচলের কারনে নষ্ট হচ্ছে যাতায়াতের সরকারি রাস্তাও। ফলে ভোগান্তিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ ও স্কুল-কলেজগামী ছাত্র-ছাত্রীরা।
ইটভাটায় পাহাড়ের মাটি ব্যবহারের কথা অস্বীকার করে সরকারি নিয়মানুযায়ী কয়লার চুল্লী দিয়ে ইটভাটা তৈরিতে অধিক খরচ হওয়ায় নিয়ম মানা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানান ফাইতং ইটভাটা মালিকেরা।
এ বিষয়ে ফাইতং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ওমর ফারুক বলেন, ‘যত্রতত্রভাবে ইটভাটা গড়ে উঠায় আমাদের ইউনিয়নে নানাবিধ সমস্যা দেখা দিয়েছে এবং পরিবেশ হুমকির মুখে পড়েছে। ইটভাটার মালিকরা ইউনিয়ন পরিষদের কোনো আইন কানুন মানেনা। গায়ের জোরে সব কাজ করে। প্রতিদিন ২০০ থেকে আড়াইশ ছোট-বড় ট্রাক দিয়ে ইট পরিবহনের নামে সরকারি অর্থায়নে নির্মিত সকল সড়ক ভেঙ্গে গেছে’। এই জনপ্রতিনিধি মনের করেন, যারা ইটভাটা গড়ে তুলেছে তাদেরকে তো সরকার অনুমতি দেয়নাই। একটি ইউনিয়ন ২৮টি ইটভাটায় সবগুলো বড় বড় সব পাহাড় সাবাড় করে ফেলছে। এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। সবুজ পাহাড় বেষ্টিতে পরিবেশ ও বায়ু দূষন করে চলছে অবৈধ ভাটাগুলো।
নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম ইউনিয়নে খুব কাছাকাছি এলাকায় অন্তত ৫টি ইটভাটা গড়ে উঠেছে। আওয়ামী লীগ নেতা খালেদ সরওয়ার হারেজ এর মালিকানাধীন কেআরই, সাজু বড়–য়ার ডিএসবি, ফরিদ আহম্মদের বিবিএম, জয়নাল আবেদীনের জেএসবি ও আবুল কালামের মালিকানাধীন কেআরএস ইটভাটার কেনোটিরই লাইসেন্স ও পরিবেশ ছাড়পত্র ছিল না। প্রশাসন মাঝেমধ্যে এসব ইটভাটাগুলোতে অভিযান চালালেও কার্যত কোনো পদক্ষেপ চোখে দেখেনি স্থানীয়রা। অভিযোগ উঠেছে আওয়ামীলীগ নেতা খারেদ সরওয়ার হারেজ প্রশাসন ম্যানেজ করেই এই ইটভাটাগুলো চালাচ্ছে।
জেলা প্রশাসক শাহ মোজাহিদ উদ্দিন বলেন, ‘বান্দরবানের একটি ইটভাটারও বৈধ অনুমতি নেই। উচ্চ আদালতের ১০টি রায় আছে। প্রতিটি রায় ভিন্ন ভিন্ন। সরকারি উন্নয়ন কাজের জন্য ইটের প্রয়োজন। কিন্তু আদালতের নির্দেশ জেলায় কোনো ইটভাটা পরিচালনা করা যাবে না। হাইকোর্টের রায় বাস্তবায়নে অবৈধ ইটভাটার বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান চালানোর পরদিনই আবারো নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে চালু হয় ভাটা।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ফখরউদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘এক দশক ধরে অবৈধভাবে বান্দরবানের ইটভাটাগুলো পরিচালিত হয়ে আসছে। চলতি বছরও ইটভাটাগুলো সরকারি অনুমতি ও পরিবেশ ছাড়পত্র নেই।’ তবে এই কর্মকর্তা বলেন, ২০১৯ সাল থেকে ২৪ সালের মার্চ পর্যন্ত পাহাড় কাটা ও ইটভাটা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৩ কোটি ৭১ লক্ষ টাকা জরিমানা করা হয় এবং ৪১ ফৌজদারী মামলা দায়ের করা হয়। তবে ২০১৩ সালে ইটভাটা প্রস্তুত ও ভাটা নিয়ন্ত্রণ আইন হওয়ার পর বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলায় কোনো ইটভাটার অনুমতি দেয়া হয়নি। ইটভাটাগুলো বন্ধ করে দেওয়ার জন্য সুপ্রিম কোর্ট নির্দেশনা রয়েছে। কিন্তু এর পরও অবৈধভাবে চলছে এসব ইটভাটা।