বানের পনিতে ভাসছে লাখো মানুষ

74

বান্দরবানে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা
মো.শাফায়েত হোসেন, বান্দরবান

উজানে টানা বৃষ্টিপাতের কারণে পাহাড়ি ঢল নামছে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদীতে। নদীর পানি বেড়ে পাশ্ববর্তী নি¤œ অঞ্চলগুলোতে ছড়িয়ে পড়েছে। গত কয়েকদিন ধরে ভারী বৃষ্টিপাত অব্যাহত রয়েছে। এতে বান্দরবানের বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে।
গত শুক্রবার গভীর রাতে বন্যার পানি শহর থেকে নেমে গেলেও কয়েকঘণ্টা ব্যবধানে শনিবার দুপুরের দিকে জোয়ারের পানির মত হঠাৎ করে বেড়ে যায়। এতে নতুন নতুন এলাকা বন্যার পানিতে প্লাবিত হয়। ১৯৯৭ সালের পর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ার আশঙ্কা করছে বান্দরবানের লোকজন। টানা পঞ্চম দিনের মতো সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। বন্যার পানি জেলা শহরের জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে।
প্রশাসন সূত্র জানায়, এক সপ্তাহের বন্যা ও পাহাড়ি ঢলের কারণে সাঙ্গু ও মাতামুহুরী নদী আরো আগ্রাসী হয়ে উঠেছে। এখনো নদী দুটির পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। নি¤œ অঞ্চেলের লোকজন গত কয়েকদিন ধরে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ঘরবাড়ি ব্যবহার অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। পাহাড়ের কিনারায় থাকা অন্তত অর্ধশতাধিক কাঁচা ঘরবাড়ি ভেঙ্গে গেছে। শহরের আর্মিপাড়া, ইসলামপুর,বালাঘাটা, অফিসার্স ক্লাব, বনানী স’মিল, বাস টার্মিনাল, হাফেজঘোনা, শেরেবাংলা নগর, মেম্বারপাড়া এবং সাঙ্গু নদীর তীর এলাকার অন্তত দশ হাজারেরও বেশি মানুষ চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্র ও আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। পাহাড় ধসে প্রাণহানির ঘটনাসহ যেকোন ধরণের পরিস্থিতি মোকবেলায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সব ধরণের প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। বান্দরবানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া লোকজনের মধ্যে জেলা প্রশাসন ও পৌরসভার পক্ষ থেকে শুকনো খাবার ও খিচুড়ি বিতরণ করা হচ্ছে। বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট নিরসনে জেলা জনস্বাস্থ্য বিভাগ পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট বিতরণ করছে।
এদিকে টানা পঞ্চম দিনের মতো গত শনিবারও বান্দরবান জেলা শহরের সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন ছিল। বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের বাজালিয়া বড়দুয়ারা অংশের রাস্তা পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। নদীর পানি ও পাহাড় ধসের কারণে থানচি, রুমা ও রোয়াংছড়ি সড়কেও যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। পুরো জেলাতে ১৩১টি আশ্রয়ণ কেন্দ্র খোলা হয়েছে। যোগাযোগ বন্ধ থাকায় স্থানীয় ব্যবসায়ীরা নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সংকটে ভুগছে। সবজি ও কাচাবাজার লাগামহীন হয়ে পড়েছে। জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে বন্যা কবলিত এলাকা সার্বক্ষণিক তদারকি করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, জেলা পরিষদ, পৌরসভা ও উপজেলা পরিষদের পক্ষ থেকে দুর্গত মানুষের মাঝে খাবার সরবরাহ করা হচ্ছে।

পটিয়ায় পানিবন্দী
১৭ ইউনিয়ন ও
পৌরসভা
আবেদ আমিরী, পটিয়া

টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে পটিয়ার কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল শনিবার সকাল থেকে ভারী বর্ষণে শ্রীমাই খালের বেশ কয়েকটি স্থানে নতুন করে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে। বর্ষণ অব্যাহত থাকলে এ পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
গতকাল উপজেলার শোভনদন্ডী, বরলিয়া, ছনহরা, ভাটিখাইন ও আশিয়ার ইউনিয়ন এলাকায় বন্যা পরিস্থিতির সবচেয়ে বেশি অবনতি হয়। এসব ইউনিয়নে গ্রামীণ রাস্তাঘাট ও বেশ কিছু ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে। এ অবস্থায় পটিয়া আসনের এমপি ও জাতীয় সংসদের হুইপ সামশুল হক চৌধুরী গতকাল ব্যক্তিগত উদ্যোগে এসব ইউনিয়নে ৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে খোলার পর, সেখানে নিজ অর্থে খাবারের ব্যবস্থা করেছেন। বরাদ্দ করেছেন ৪ হাজার কেজি আলু, ২ তাজার কেজি ডাল, ২০ টন চালসহ প্রয়োজনী পণ্য-সামগ্রী। আশ্রয় কেন্দ্রে আসা লোকজন যতদিন ঘরে ফিরতে পারবেন না, ততদিন তাদের খাবার দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন হুইপ সামশুল হক চৌধুরী।
জানা গেছে, ঢলের কারণে উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফলে এলাকার লোকজন দুর্ভোগের কবলে পড়েছেন। পানির ঢলে কচুয়াই, ভাটিখাইন, ছনহরা, আশিয়া ও বড়লিয়া এলাকার ফসলি জমি সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে। প্রবল বর্ষণ, পাহাড়ি ঢল ও জোয়ারের পানিতে উপজেলার ১৭ ইউনিয়ন ও একটি পৌর এলাকায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্পটে হাঁটু পানি জমে থাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে গেছে। ছনহরা, কচুয়াই ও ভাটিখাইন এলাকায় শ্রীমাই খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে অসংখ্য মানুষের ক্ষতি হয়েছে।
গত শুক্রবার বিকেলে জাতীয় সংসদের হুইপ ও চট্টগ্রাম-১২ (পটিয়া) আসনের সংসদ সদস্য সামশুল হক চৌধুরী ভাটিখাইন ও ছনহরা ইউনিয়নের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করেন। গতকাল শনিবার শোভনদন্ডী ও খরনা এলাকা পরিদর্শন করেন। এ সময় তিনি ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অনুদান প্রদান করেন।
পটিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী জানান, উপজেরার খরনা, ভাটিখাইন, শোভনদন্ডী, বরলিয়া ও আশিয়ায় কুরাংগিরি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, আশিয়া গাউছিয়া মাদ্রাসা, ভাটিখাইন উচ্চ বিদ্যালয়, শোভনদন্ডী ইউনিয়ন পরিষদ, আরফা করিম স্কুল, মেট্রো কমিউনিটি সেন্টারসহ ৮টি আশ্রয় কেন্দ্রে এবং তাতে লঙ্গরখানা খোলা হয়। এসব কেন্দ্রে ইউপি চেয়ারম্যান, স্থানীয় দলীয় প্রতিনিধি ও ইউপি সদস্যরা সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করবেন।
হুইপ সামশুল হক চৌধুরী বলেন, সবগুলো আশ্রয় কেন্দ্রসহ পুরো উপজেলার খবরা-খবর নিতে একটি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে। উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকবেন উপজেলা চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল হাসান।
তিনি জানান, গত দুইদিনে তার পক্ষ থেকে দুই লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। অবস্থার প্রেক্ষিতে খোলা আশ্রয় কেন্দ্র সমূহে তার অর্থায়নে খাবারের ব্যবস্থা এবং দুর্গত যেসব পরিবার আশ্রয় কেন্দ্রে আসবেন না, তাদের জন্য খাবার ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া হবে।
গতকাল বন্যা দুর্গত এলাকা পরিদর্শনকালে হুইপের সাথে ছিলেন, উপজেরা পরিষদ চেয়ারম্যান মোতাহেরুল ইসলাম চৌধুরী, পটিয়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক হারুনুর রশিদ, উপজেলা নির্বাহী অফিসার হাবিবুল হাসান, আলমগীর খালেদ, আলমগীর আলম, এমএনএ নাছির, মিজানুর রহমান, মাহবুবুল কবির, গোলাম কিবরিয়া, জয়নাল আবেদীন প্রমুখ।

ফটিকছড়িতে প্লাবিত
হচ্ছে নতুন এলাকা
অর্ধশত গ্রাম পানির নিচে, সড়ক যোগাযোগ বন্ধ
শহীদুল আলম, ফটিকছড়ি

ফটিকছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। সপ্তাহজুড়ে বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ১১ ইউনিয়ন ও দুই পৌরসভার অন্তত অর্ধশত গ্রাম পানির নিচে। ক্রমে নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। পানিবন্দি প্রায় দুই লাখ মানুষ চরম দুর্ভোগের মধ্যে রয়েছেন। এছাড়া গহিরা-হেঁয়াকো সড়কে সেতু ভেঙে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন এবং নাজিরহাট-কাজীরহাট সড়ক ও নানুপুর-বিবিরহাট সড়কে কোমর পানি হওয়ায় যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিন দেখা যায়, উপজেলায় বিক্ষিপ্তভাবে ভারি বৃষ্টি হচ্ছে। এতে উপজেলার রোসাংগিরী, সুয়াবিল, সমিতিরহাট, ভূজপুর, লেলাং, কাঞ্চননগর, হারুয়ালছড়ি, নারায়নহাট ও দাঁতমারা ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চলের সবকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।
গতকাল শনিবার নতুন করে নাজিরহাট পৌরসভা ও ফটিকছড়ি পৌরসভার অন্তত ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামের পরিবারগুলো পাশের বাড়ি কিংবা উঁচু স্থানে অবস্থান নিয়েছেন।
নাজিরহাট পৌরসভার দৌলতপুর গ্রামের মুহাম্মদ আনোয়ার হোসেন জানান, তাঁর পৈত্রিক সম্পত্তির মৎস্য পুকুর পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় ১০ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে।’
নারায়ণহাট গ্রামের মুহাম্মদ তারেকুল ইসলাম জানান, ‘তাঁর ৫০ শতক ক্ষেতের আমন বীজতলা তলিয়ে গেছে। তিনি সরকারের সাহায্য কামনা করেছেন।’
রোসাংগিরী ইউপি চেয়ারম্যান এসএম শোয়েব আল ছালেহীন বলেন, ইউনিয়নের অনেক অংশে ভাঙন এলাকা রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম পানিতে নিমজ্জিত, ক্রমে পানি বাড়ছে।
নারায়ণহাট ইউপি চেয়ারম্যান মুহাম্মদ হারুন বলেন, ‘গ্রামের অনেক নি¤œাঞ্চল পানিতে তলিয়ে গেছে। জনজীবনে নেমে এসেছে স্তবিরতা। কিছু কিছু এলাকায় সরকারের সামান্য ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে।
সমিতিরহাট ইউপি চেয়ারম্যান মো. হারুন অর রশীদ বলেন, ‘ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হয়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। অন্যদিকে গত মঙ্গলবার আরবানিয়ায় হালদার ভাঙনে সাতটি বসতঘর সম্পূর্ণ তলিয়ে গেছে।’
লেলাং ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ সরোয়ার হোসেন বলেন, ‘ইউনিয়নের সবকটি গ্রাম এখনও পানিতে থৈ থৈ করছে। গতকাল নতুন করে আরও কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। দুর্গতদের ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।
কাঞ্চনগর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান রশিদ উদ্দিন চৌধুরী বলেন, ‘ইউনিয়নের নি¤œাঞ্চল এখনও পানির নিচে। পানি সবখানে বাড়ছে। এলাকার ঐতিহ্যবাহী চমুরহাট বাজারটি ধুরুং খালের ভাঙনের মুখে পড়েছে।’
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা লিটন দেন নাথ বলেন, ‘প্রায় ৩৫০ হেক্টর আমন বীজতলা ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে। ফলে চলতি মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রায় এর বিরূপ প্রভাব পড়বে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সায়েদুল আরেফিন বলেন, ‘বন্যাকবলিত এলাকার ক্ষয়ক্ষতি নিরুপন করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত অর্ধশতাধিক গ্রামের নি¤œাঞ্চল তলিয়ে আছে। বৃষ্টির সাথে পানি বাড়ায় নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ৩৫ মেট্রিক টন চাল, ৪০০ প্যাকেট শুকনা খাবার এবং ১ লাখ টাকা পেয়েছি। এসব ত্রাণ সহায়তা দুর্গতদের মাঝে সরবরাহ করা হচ্ছে।’