‘বাতাসে উড়ছে পাঁজর’ কাব্যগ্রন্থে দৃঢ়তার চমক চুমুক

8

মোস্তফা হায়দার

কবিতা একটি শিল্প। কবিতা শিল্পের নান্দনিক শোকেসও বটে। আর এ কবিতার জন্য কবিরা হয়েছে ঘরছাড়া, ছন্নছাড়া, বৈরাগি। কখনো কখনো সন্যাসি হয়ে পাড়ি দিয়েছে মনুষ্যহীন অরণ্যে। কেউ কেউ হয়েছে হতাশার দিঘির জলে নোংরা শ্যাওলা। কবিতার শক্তির কাছে প্রতিটি মানুষ আনন্দ-নিরান্দে পরাজয়ী। এটাই কবিতার মূলচালিকা শক্তি। কবিতার কাছে সমর্পিত হতে পারাটাই কবির সফলতা।
একজন কবি যখন কবিতাকে আপন করে নেয় তখন কবি হয়ে ওঠে কাব্যকলার মহীরুহ। কবির যাপন ক্রিয়ার বাসনে কবিতা হয়ে যায় পাঠকের ক্ষুধা নিবারণ। তেমনি একজন কবির কবিতা পাঠ করতে বসে পাঠকের অন্তরাত্মায় হেসে উঠে কবিতার শক্তিময়তা। লিখছিলাম কবি সারাফ নাওয়ার এর কথা। লিখছিলাম কবির ‘বাতাসে উড়ছে পাঁজর’ কাব্যগ্রন্থের কথা। কবি খ্বু সচেতনভাবে শব্দচয়নে মনোয়োগী হয়ে কবিতাকে আপন করে নিয়েছে। কবি সারাফ নাওয়ারের ‘বাতাসে উড়ছে পাঁজর’ কাব্যগ্রন্থের শিরোনামে প্রেমের মাদকতা দেখতে পেলেও খুঁজে পেয়েছি ভিন্ন আমেজ। একজন কবির শৈল্পিকতা ও উপমার ব্যবহারে পাঠককে দোদূল্যমান রাখতে পারাটাই কবির সার্থকতাও বটে। সারাফ নাওয়ার প্রেমাশ্রিত এক শিল্পও বটে! চলনে বলনে তাকে দেখতে পেয়েছি কাব্যের প্রেয়সীরূপে। কবির নিতম্ব বেয়ে উড়ন্ত কালো কেশের কাছে কখনো কখনো পাঠক কবিরা মাদকতায় হারিয়েছিল দৃষ্টির দৃশ্য। কবি সারাফ নাওয়ার আপাদমস্তক শিল্পের পরিচায়ক।
তার কবিতার নান্দনিকতায় বিমুগ্ধতা ছুঁয়ে দিয়েছে ঠিক এমন করে –
কবিতাকে দিয়েছি আমার একান্ত ইতিহাস।
পৃথিবীর অন্য কোথাও গচ্ছিত রাখিনি।
ছত্রে ছত্রে শুনতে পাই
নবাগত শব্দের আগমনী সংকেত।
(কবিতাকে দিয়েছি আমার একান্ত ইতিহাস- বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
কবিতার এ শিরোনামের কাছে কবির দায় যেন ইতিহাসের দায় হয়ে গেল। যদিও ইতিহাসের দায় থাকতে নেই। উক্ত কবিতার শেষ চরণগুলো এমন আঁচড় দিয়েছে তা যেন নিতান্তই ইতিহাসের দায়। কবির ভাষায়-
ওয়্যার সেম্যাট্রির সবুজ চাদরের ওম ছেড়ে
একটা মানচিত্র উঠে এলো
মুষ্টিবদ্ধ হাত খুলে দেখি
সকল শহীদের সিলমোহর।
(কবিতাকে দিয়েছি আমার একান্ত ইতিহাস- বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
কবি সারাফ নাওয়ার সচেতনভাবে শব্দ চাষের মাঠে মই বসাতে নিজেকে করেননি আড়াল। কবিতার কাছে তার সব দায় যেন শিল্পের সুষমায় মন্ডিত এক প্রেতাত্মা। ছায়া না হয়ে সরাসরি শিল্পের কাঁধে রেখেছে তার দায়। কবির ভাষায়-
স্বদেশ জারজ,
মা নেই মাসির প্রশ্ন কোথায়?
ডিএনএ টেস্ট বলে, এদেশ তোমার সন্তান।
ডিএনএ টেস্ট বলে, এ দেশ আমার সন্তান।
ডিএনএ টেস্ট বলে, এ দেশ তার সন্তান।
(গোধূলির অনীহ- বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
কবি সমাজে বসবাস করা রাষ্ট্রের নাগরিকও বটে। তাই কবিকে হতে হয় সময়জ্ঞান সম্পন্ন মানুষ। কবি সেই সময়ের যাত্রাপালা নিরানান্দ দৃশ্যের পিঠ ছুঁয়ে একটি ব্যানার খোঁজার চেষ্টা করেছেন। কবির এ চেষ্টার কাছে পাঠকের চোখ পড়ে। ধরা পড়ে বিষাদের রঙের বাহুল্যতার। কবি সারাফ নাওয়ার সেই বিষাদের আয়নায় যে কবিতাটির গ্রাফচিত্র এঁকেছেন তা হলো ‘সভ্যতার ব্যানার।’ কবির ভাষায-
জিইসির মোড়ে শ্যামারা দাঁড়িয়ে
শিকারির খোঁজে। জিরাফ বাড়িয়ে গলা
মুখে তুলে নেয় পাখিদের সব
এ সভ্যতার ব্যানার গলায় ঝুলিয়ে
বিবেকের কর ফাঁকি দিয়ে যায়
স্থলের রাঘব-বোয়াল।
(সভ্যতার ব্যানার- বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
কী অসাধারণ উপমায় পাঠকের বুকে আঘাত করে সভ্যতাকে করে দিল চূর্ণবিচূর্ণ। আসলেই শ্যামারা আর শ্যামাদের শিকারীরা আজীবনই বিবেকের সঠিক কর্ষণের বিপরীতে চড়ে দেখায় নব্য বিষাদের ছায়ারেখা। যে রেখায় সময় ও সমাজ হারায় বর্ণিল রেখার মিহি সুর। বেড়ে যায় আকামের দোকানদারি।
কবির চোখে পড়া ঘটনা না হলেও বাস্তবতার এক সরল অংকও বটে। অসাধারণ আবরণের পিঠ ছুঁয়ে থাবরিয়ে দিলেন সময়খেকো অসভ্যদের।
কবিরা প্রেমপূজারি না হলে কবিতারা হয়ে ওঠে রুক্ষ! কবিতা হয়ে যায় সাদামাটা এক বাতাবিলেবু। যে লেবু দেখতে সাদা, খেতে স্বাদহীন, ঘ্রাণে সবুজ! টক মিষ্টি দুটোই হারিয়ে গেলে কবিতা হয়ে ওঠে অনাদরি এক বাতুন্পুত্রীর মত। এ কবিও চিরন্তন প্রেমের জলে তরী ভাসাতে চেয়েছেন ভিন্ন সুরে। যে সুরের আন্দোলিত মোহে কবিতা পায় প্রাণ। কবির ভাষায়-
বিশ্বাসের চাষ হয় এখানে বুকের ক্ষেতে
বাইরে নাকি প্রেমিক হয়ে ওঠে ক্ষেপা ষাঁড়?
ফুটো করে শিং ফুড়িয়ে একদিন
তাঁতি বোনা ভোরের লাল চাদর?
(গোধূলির রঙ- বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
একদিন তুমি দিয়েছিলে আমাকে যে প্রান্তর
বেড়িতে আজ তা এক উঠোন সীমানা।
(বেড়ি- বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
কবি সারাফ নাওয়ার কবিতা জীবনের সাজানো কাননে অতি সন্তর্পনে হাঁটতে চেয়েছেন। কবিতাকে কখনো তন্ময় কখনো মুন্ময়ের সুরে গেঁথে দিতে চেয়েছেন আপন আলোয়। সাধুবাদের জায়গাটা বড়ই মসৃণ। এ মসুণের মাঠ চষে কবিতায় টেনে ধরেছেন জীবনচরিত্রের বিশ্বাস আর রোপন করা পাতাদের সংসার। ইচ্ছে ডানায় যদি থাকে বিশ্বাসের চিরায়ত সুর তা আর কে রুখবে! তার একটি কবিতায় দেখি-
বিশ্বাসের বীজতলাতে সেও একটি চারা
কবিতার টঙ করেছে তার ভিন্ন পাড়া।
বেকারত্ব ঘোচাতে খায় কুড়িয়ে পাপ
সা¤প্রদায়িক চারাদের এই বড় সন্তাপ।
(পদ্যের সূতো – বাতাসে উড়ছে পাঁজর)
কবির বিশ্বাসের চরাচর অনেক বড়। রুদ্রের একটি কবিতা ছিল ‘বাতাসে লাশের গন্ধ পাই’। ক্ষতবিক্ষত এক সময়ের বিবেক তাড়িত রুক্ষতার অবকাঠামো থেকে বের হতে না পেরে কবির এতো বড় শঙ্কাটা ছিল। কবি নিজের শঙ্কা মনে করে জাতির শঙকায় গেঁথে নিলেন আপনার বিশ্বাস। আর কবি সারাফ নাওয়ার ‘বাতাসে উড়ছে পাঁজর’ এ শিরোনামীয় কবিতায় এঁকেছেন দৃঢ়তার এক গ্রাফরেখা। যে রেখার চলন্ততায় পাঠক ফিরে পেতে পারে আস্থার জায়গাটুকু। প্রেমময় এক বাক্যের সোহাগা দিয়ে পাঠকের কোমড়ে গেঁথে দিলেন বেঁচে থাকা বা ঘুরে দাঁড়ানোর এক বেড়ি। কবির এ চাতুর্যতার কাছে পাঠকের মুগ্ধতার রশ্মিই চুমুকে চমক।