বাণিজ্যিক রাজধানীর স্বপ্ন-পূরণে প্রধানমন্ত্রীর উন্নয়ন দর্শন

24

অমল বড়ুয়া

চট্টগ্রামে সাড়ে চার বছর আগে এক সমাবেশের পর নগরীতে আবার কোনো দলীয় সভায় অংশ নিচ্ছেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এর আগে ২০১৮ সালের ২১ মার্চ চট্টগ্রামের পটিয়া আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তারও আগে ২০১৬ সালে বন্দর নগরীতে জনসভা করেছিলেন। দীর্ঘ ছয় বছর পর চট্টগ্রামে পলোগ্রাউন্ডের বিশাল জনসভায় ভাষণ দিবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিপ্লব-তীর্থ ও বার-আউলিয়ার পুণ্যভ‚মি চট্টগ্রাম থেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনা বারবার নির্বাচনী রাজনৈতিক কর্মস‚চি শুরু করেছেন। চট্টগ্রাম পাহাড়, সমুদ্র ও উপত্যকায় ঘেরা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্যে প্রাচ্যের রাণী হিসেবে বিখ্যাত। বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার এই চট্টগ্রাম এশিয়ার সপ্তম এবং বিশ্বে দশম দ্রæততম ক্রমবর্ধমান শহর। চট্টগ্রাম দক্ষিণ এশিয়ার পঞ্চম বৃহৎ অর্থনীতির শহর। বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম। দেশের অর্থনৈতিক জীবনীশক্তি সঞ্চালিত হয় চট্টগ্রামের মধ্য দিয়েই। চট্টগ্রামের মাধ্যমে সংঘটিত হয় দেশের মোট রপ্তানি বাণিজ্যের প্রায় ৭৫ ভাগ। আমদানি বাণিজ্যের প্রায় ৮০ ভাগ ঘটে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে। রাজস্ব আয়ে চট্টগ্রামের ভুমিকা অপরিসীম। দেশের মোট রাজস্ব আয়ের শতকরা ৬০ ভাগ আসে চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্য থেকে। দেশের মোট জাতীয় উৎপাদনে চট্টগ্রামের অবদান ১২ শতাংশ। চট্টগ্রাম কেবল অর্থনৈতিকভাবে নয় একই সাথে ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিকভাবেও সমৃদ্ধ অঞ্চল। চট্টগ্রাম প্রাকৃতিক ও ভৌগোলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকার কারণে চট্টগ্রামের উন্নয়নের সুযোগ বেশি হওয়ায় চট্টগ্রামকে আগামী দিনের ব্যবসা বাণিজ্যের প্রধানতম কেন্দ্রে পরিণত করতে চান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। বর্তমান সরকার বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবে চট্টগ্রামের উন্নয়নে অনেক বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ইতোমধ্যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের উন্নয়নে রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নে নিরলসভাবে কাজ করছেন। আর তারই ধারাবাহিকতায় চলমান রয়েছে বহু মেগাপ্রকল্প, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে মিরসরাইয়ে বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক অঞ্চল, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফ্লাইওভার, বে-টার্মিনাল, মহেশখালীতে এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, মহেশখালী ইকোনমিক জোন, আউটার রিং রোড, আনোয়ারায় অর্থনৈতিক অঞ্চল, কোরিয়ান ইপিজেড, চায়না ইকোনমিক জোন, দোহাজারী-ঘুমধুম রেললাইন স্থাপন প্রকল্পসহ অনেক বৃহৎ প্রকল্প। এসব প্রকল্পসম‚হ সম্প‚র্ণর‚পে বাস্তবায়ন করা গেলে চট্টগ্রাম নগরীটি একটি আধুনিক নগরীতে পরিণত হবে।
এছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দক্ষ মানবসম্পদ গড়ে তোলে চট্টগ্রামের নৌ-বাণিজ্যের অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিশ্বমানের একটি মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হচ্ছে। নগরীর কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী চান্দগাঁও-মোহরা এলাকার হামিদ চরে চট্টগ্রাম বন্দরের ১০৬ একর জায়গায় নির্মিত হবে বিশ্ববিদ্যালয়। চট্টগ্রামে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় জলাবদ্ধতা। ১৯৬৯ সালের মাস্টারপ্ল্যান ও আরএস সিট অনুযায়ী চট্টগ্রাম মহানগরে ছোট-বড় খাল ছিল ৭০টি। কিন্তু বর্তমানে ৪৬টি খালই অস্তিত্বহীন। শহরের পানি কর্ণফুলী নদীতে গিয়ে পড়ার জন্য শহরের উত্তর-দক্ষিণ আর পূর্ব-পশ্চিমে একাধিক খাল ন্যুনতম ৫০ থেকে ৬০ ফুট প্রশস্ত ছিল, যার অন্যতম চাক্তাই খাল। চট্টগ্রাম নগরের জলবাদ্ধতা নিরসনে ১০ হাজার ৯২১ কোটি টাকা ব্যয়ে চারটি প্রকল্পের কাজ চলছে। দুটি প্রকল্প সিডিএর ‘চট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের’ আওতায়, একটি প্রকল্প চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এবং অন্যটি পানি উন্নয়ন বোর্ড বাস্তবায়ন করছে। বর্তমানে চট্টগ্রামের বড় সমস্যা এই জলাবদ্ধতা। মূলতঃ খাল-ছরা, পুকুর-ডোবা-দীঘি, নালা ভরাট ও অবৈধ দখলের কারণে এই সমস্যার সৃষ্টি। দল-মত নির্বিশেষে অবৈধ দখলদারদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে; সেতু ও কালভার্ট তৈরি, বন্যার পানি সংরক্ষণের জন্য জলাধার নির্মাণ করা গেলে এ সমস্যার লাঘব হতে পারে। এ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রীর দিকনিদের্শনা চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ লাঘবে সহায়ক হবে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্প ছাড়াও প্রধামন্ত্রীর কাছে যেসব বৃহৎ প্রকল্প চট্টগ্রামের মানুষ প্রত্যাশা করছে, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে কালুরঘাটে সড়ক ও রেলসেতু নির্মাণ, বন্দর-পতেঙ্গা এলাকায় বিশেষায়িত মাতৃসদন ও জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণ, সরকারি বিশেষায়িত হাসপাতাল নির্মাণ, নতুন সরকারি স্কুল ও কলেজ নির্মাণ, আন্তর্জাতিক মানের বিনোদন কেন্দ্রসহ বিদেশী পর্যটকদের জন্য বিশ্বমানের হোটেল নির্মাণ, আর্ন্তজাতিক মানের বিমান বন্দর নির্মাণ। এর মধ্যে কালুরঘাটে সড়ক ও রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পটি দ্রæত বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট ঘোষণা শোনার অপেক্ষায় আছে বৃহত্তর চট্টগ্রামের জনগণ। আর চট্টগ্রামবাসীর এসব প্রত্যাশা পূরণের মাহেন্দ্রক্ষণে বলে মনে করা হচ্ছে বিজয়ের মাসে আগামী ৪ ডিসেম্বর নগরীর পলোগ্রাউন্ড মাঠের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জনসমাবেশকে। পরিবেশ ও ঐতিহ্য রক্ষায় সিআরবিতে বেসরকারি হাসপাতাল নির্মাণ বন্ধের দাবিতে দীর্ঘদিন চট্টগ্রামের মানুষ আন্দোলন করে আসছেন। ধারণা করা হচ্ছে সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ কার্যক্রম বন্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও চট্টগ্রামের অনেক ইতিহাসের সাক্ষী আদালত ভবন বা পরীর পাহাড়কে হেরিটেজ ঘোষণাসহ যথাযথ সংরক্ষণের নির্দেশনা দেয়ারও সম্ভাবনা রয়েছে এই জনসভা থেকে। চট্টগ্রাম কাগজে-কলমে বাণিজ্যিক রাজধানী হলেও এখানে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সুবিধাসম্বলিত অবকাঠামো আদৌ গড়ে ওঠেনি। নেই কোনো জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সদর দফতর, কর্পোরেট অফিস, ব্যাংক, বীমা, বায়িং হাউজ, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি সংস্থার প্রধান কার্যলয়। বাণিজ্যিক ও বন্দরনগরী হলেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত কার্যবলি নিয়ন্ত্রিত হয় ঢাকা থেকে। কাস্টমস, বিডবিøউটিআই, নৌ-পরিবহন মন্ত্রণালয়, ব্যাংক, বীমা, বিদেশি সংস্থা, দাতা সংস্থা, উন্নয়ন সংস্থা, বায়িং হাউজ, বহুজাতিক কোম্পানি ইত্যাদির প্রধান কার্যলয় চট্টগ্রামে স্থানান্তর করা গেলে বাণিজ্যিক রাজধানীর গুরুত্ব ও ঐতিহ্য বাড়বে। ঢাকার উপর থেকেও চাপ কমবে। বিকেন্দ্রিভূত প্রশাসনিক কাঠামোর কারণে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত হয়; এ বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সহৃদয়তা গুরুত্বপূর্ণ। চট্টগ্রামবাসী আশা করছে পলোগ্রাউন্ডের জনসভায় প্রধানমন্ত্রী চট্টগ্রামের উন্নয়নে আরও কিছু ঘোষণা বা প্রতিশ্রæতি দিবেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কালুরঘাটের কাছে হামিদচরে সেক্রেটারিয়েটের আদলে চট্টগ্রামের মিনি সেক্রেটারিয়েট গড়ে তোলার ঘোষণা। এই ঘোষণার মাধ্যমে বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামের মানুষের বহু দিনের আকাক্সক্ষা পূরণ হবে। চট্টগ্রামে প্রতিনিয়ত ৮ থেকে ১০ শতাংশ হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে আর বছরে যুক্ত হচ্ছে ৫০ হাজার মানুষ। ফলে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি, পয়নিস্কাশন ব্যবস্থা, সড়ক, হাসপাতাল, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিনোদনকেন্দ্র ও গণপরিবহনসহ নাগরিক সুবিধাসমূহ সংকুচিত হচ্ছে। বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের সাথে সাথে নাগরিক দুর্ভোগ লাঘবে সুষম ও টেকসই পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর মধ্য দিয়ে চট্টগ্রামের সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার পথের অবকাঠামোগত সংকটও দ‚র হবে। চট্টগ্রামের উন্নয়নে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত বিকেন্দ্রিকরণ করা উচিত। একই সাথে প্রয়োজনীয় সরকারী ও বেসরকারী সংস্থার প্রধান দফতর চট্টগ্রামে স্থানান্তর হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল পুরো বাংলাদেশ পাবে। চট্টগ্রামকে বাস্তবিক অর্থে বাণিজ্যিক রাজধানীতে উত্তরণে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর এ শুভাগমন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক