বাঙালি ও পহেলা বৈশাখ

85

প্রফেসর আবু জাফর চৌধুরী

আবহমান কালের বাংলা, হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে আছে। কিন্তু এক সময় বাঙলায় কোন নিজস্ব বর্ষপঞ্জি ছিল না। মূলত এখানে মগী সনকে অনুসরণ করা হত। মোগল আমলে সম্রাট আকবর নতুন বর্ষপঞ্জি চালু করলেন এই বাংলায়। পহেলা বৈশাখ বাংলা বর্ষের প্রথম দিন। সেই থেকে বাঙ্গালি বাংলা নব বর্ষ পালন করে আসছে। কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কিছু ব্যক্তি আছে, যারা এই বাংলা নব বর্ষকে মানতে চায় না। সম্রাট আকবর মুসলিম ছিলেন, তাঁর প্রবর্তিত বাংলা সন বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানেরা মেনে নিলেন, কিন্তু বাঙালি মুসলমানদের মধ্যে কিছু কিছু লোক মানে না। কেন মানে না, সেটা বুঝা বড়োই মুশকিল। তবে তারা কি বাঙালি নয়, তারা কি বাংলাার মাটিতে জন্মগ্রহণ করেনি, তারাা কি বাংলার আলো বাতাসে বেড়ে উঠেনি, তাদের শরীরের শিরায় শিরায় কি বাংলার রবি শস্যের কনা থেকে উৎপাদিত রক্ত প্রবাহিত হয় না ? অবশ্যই তাদের শরীরে বাংলার রবি শস্যের কণা থেকে উৎপাদিত রক্ত প্রবাহিত হয়। আসল কথা হল, তারা বিশ্বাসঘাতক, তারা কুসংস্কারাচ্ছন্ন, যুক্তিবোধহীন, অন্ধ, ধর্মীয় গোঁড়ামিতে বিশ্বাসী, অপরের তথা প্রভুর পা চাটা কুকুর,তারা ভিতরে ভিতরে পাকিস্তানপ্রেমী। পাকিস্তান আমলে কি আমরা দেখেছি ? মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে জাতির পিতা বলা হত, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং সকল মাওলানা সাহেবেরা এক বাক্যে জিন্নাহকে জাতির পিতা বলতে বলতে মুখে ফেনা তুলতেন। কিন্তু এখন বাঙলাদেশের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা বলা হলে ঐ পাকিস্তান প্রেমীরা বলে কি ! জাতির আবার পিতা থাকে নাকি ! মুসলমান জাতির পিতা তো হযরত ইব্রাহিম। পাকিস্তানিদের ক্ষেত্রে জিন্নাহ, আর বাঙালির ক্ষেত্রে হলে হযরত ইব্রাহিম। কি মানসিকতা ! আমরা দেখেছি পাকিস্তানি টাকায় জিন্নাহর ছবি তখনো ছিলো এখনো আছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাকায় তাদের জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটনের ছবি, ভারতের টাকায় তাদের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীর ছবি, অন্যান্য দেশের টাকায় তাদের জাতির পিতার ছবি থাকতে পারে— কিন্তু বাঙলাদেশের টাকায় যখন বঙ্গবন্ধুর ছবি দেওয়া হল, তখন অনেকের পেট কামড়ি শুরু হয়ে গেল। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের এত ক্ষোভ কেন ! ক্ষোভের কারণ একটা—, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছেন।
পাকিস্তানীরা বাঙালিদেরকে কোনদিন ভাই বলে স্বীকার করেনি। চুতিয়া বাঙালি বলে গালি দিত, পথে ঘাটে অপমানিত করতো,লাঞ্চিত করতো। ২৩ বছর শাসন করেছে,শোষণ করেছে, লাথি মেরেছে। তারপরও কিছু কিছু বাঙালির তাদের প্রতি তথা পাকিস্তানিদের প্রতি ভক্তিতে গদ গদ। কিন্তু আমরা যারা এই মাটির প্রতি দায়বদ্ধ, বাঙলা মায়ের প্রতি কৃতজ্ঞ, বাংলা মাকে ভালবাসি, আমরা তেইশ বছর পাকিস্তানিদের মার খেতে খেতে বিদ্রোহ করেছি, মাথা তুলে দাড়িয়েছি। কারণ, আমাদের নেতার মতো নেতা ছিলেন বঙ্গবন্ধু মুজিব।তিনি হাজার বছরের ঘুমন্ত জাতিকে জাগিয়ে তুললেন, একত্রিত করলেন, যেটা আগে কেউ পারেন নি। বাঙালিদেরকে বৃটিশরা ব্যাঙের সথে তুলনা করতেন। ব্যঙকে যদি পাল্লায় তোলা হয় মাপার জন্য, ব্যঙ লাফিয়ে লাফিয়ে পরে যায়, একত্রে রাখা যায় না, তেমনি বাঙালিকে একত্রে রাখা যায় না। বঙ্গবন্ধুই একমাত্র নেতা যিনি বাঙালিকে একত্রিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এখন প্রশ্ন হল, এর আগে কি বাঙালি একবার ও জেগে উঠে নি ? হা, অবশ্যই মাঝে মাঝে বাঙালি হুংকার দিয়ে জেগে উঠেছিল। তবে তা ছিল খÐ খÐ এলাকা ভিত্তিক বিদ্রোহ। এখানে মোগলদের বিরুদ্ধে বার ভূঁইয়াদের বিদ্রোহ হয়েছে, বৃটিশদের বিরুদ্ধে শাওতাল বিদ্রোহ হয়েছে, ফকির সন্যাসীদের বিদ্রোহ হয়েছে, শহীদ তিতুমীরের বিদ্রোহ হয়েছে এবং সূর্য সেনের নেতৃত্বে বিদ্রোহ হয়েছে— অস্ত্রাগার লুন্ঠন হয়েছে, চট্টগ্রামের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু সারা বাংলার নিস্তরঙ্গ মানসলোকে যে দুর্মর সৈনিক বিদ্রোহের মন্দ্রিত ভেরী বাজাতে সক্ষম হয়েছিলেন তিনি বঙ্গবন্ধু মুজিব। তিনি নিজের শক্তিমন্ত সত্তায় যে বজ্র তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, সেই বজ্র নির্ঘোষে প্রকম্পিত ধারায় মুক্তিমাতাল বাঙালি স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছিল। তিনি অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন সেরে বাংলা এ, কে ফজলুল হক থেকে, সোহরাওয়ার্দী থেকে, মাওলানা ভাসানী থেকে, নেতাজী সুভাষ বসু থেকে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ এবং কাজী নজরুল থেকে।তিনি তাদেরকে নিজের মধ্যে ধারণ করলেন, তারপর আমাদেরকে জাগিয়ে তুললেন। আমরা এগিয়ে গেলাম। পেছনে শক্তি যোগাল রবীন্দ্রনাথের কবিতা’- আমার সোনার বাংলা,আমি তোমায় ভালবাসি,চিরদিন তোমার আকাশ তোমার বাতাস আমার প্রােেণ বাজায় বাঁশি, শক্তি যোগাল জীবনানন্দ দাশের কবিতা’-বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই, পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর, শক্তি যোগাল সুকান্তের কবিতা- ‘অবাক পৃথিবী, অবাক করলে তুমি, জন্মেই দেখি ক্ষুব্ধ জন্মভূমি’। গর্জে উঠল নজরুলের কবিতা- লাথি মার ভাংরে তালা, যতসব বন্দীশালা। এল ১৯৫২, ৫৪,৬৬ এবং৬৯। তারপর এলো ১৯৭১। বাঙালি আপন শক্তিমত্তায় জেগে উঠলো। এই শক্তিমত্তার উত্স হল বাংলার মাটি, ইতিহাস-ঐতিহ্য, বাংলার সংস্কৃতি এবং বঙ্গবন্ধু। তার নির্দেশেই পতাকার নক্শা তৈরি, পতাকা উত্তোলন বা প্রদর্শন, তাঁর নির্দেশেই জাতীয় সংগীত নির্ধারিত হয়। তার নির্দেশের বাইরে যাওয়ার সুযোগ বা শক্তি কারও ছিলনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় উপস্থিত না থাকলেও তিনিই ছিলেন শক্তি ও প্রেরণার মূল উত্স।
স্বাধীনতার পর বিশেষ করে১৯৭৫ এর পর একটা প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি কাউকে কাউকে স্বাধীনতার ঘোষক বানাতে চাইলেন, কেউ আবার দেখাদেখি পতাকা উত্তোলনের জনক হতে চাইলেন। আমাদের ভাগ্য ভালো যে, পতাকা যিনি তৈরি করেছিলেন তিনি পতাকা তৈরির জনক দাবি করেননি। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া রব সাহেব,সিরাজুল আলম খান বা শাহজাহান সিরাজ সাহেবেরা যে শূন্য তা বর্তমানে তারা নিশ্চয় উপলব্ধি করতে পারছেন। বঙ্গবন্ধুকে ছাড়া বর্তমানে তাদের অবস্থান কোথায় ?
বাঙালি জাতির হাজার বছরের সমৃদ্ধ ইতিহাস। বাঙালি জাতি অবশ্যই আগে থেকেই ছিল,কিন্তু পরিচয় ছিলনা।পরিচয় ছিল ভারতীয় বা পাকিস্তানি হিসাবে। বিশ্ব মানচিত্রে আমাদের কোন স্থান ছিলনা,পতাকা ছিলনা,জাতীয় সংগীত ছিলনা।১৯৭১ সালে আমরা বঙ্গবন্ধুর নেতৃতে ৩০ লক্ষ প্রাণ ও ২/৪ লক্ষ মা-বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে এ স্বাধীনতা অর্জন করেছি। ২৩ বছর ধরে তিনি আমাদরকে এই স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করেছিলেন তিল তিল করে। তাই তিনি বাংলাদেশের জনক। তিনি না হলে বাংলাদেশই হতোনা।
বাংলাদেশে যখন জতীয় দিবস আসে- যেমন পহেলা বৈশাখ বাংলা নব বর্ষ ,ছাব্বিশে মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ষোলই ডিসেম্বর বিজয় দিবস, একুশে ফেব্রæয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তখন আমাদের কিছু কিছু লোক, কিছু রাজনৈতিক দল এবং কিছু নেতা আছেন তারা কেমন যেন চুপসে যান। বিমর্ষ বিমর্ষ ভাব দেখা যায় তাদের চেহারায়, সারা শব্দ কেমন যেন কমে যায়, গলার স্বর নীচু হয়ে যায়। বুঝা যায়, তখন তাদের মনে বড় দুঃখ,বলতে ও পারে না, সইতে ও পারে না।লোক দেখানো কিছু কথাবার্তা একটু আধটু বলেন- তবে গলার আওয়াজ খুবই নিম্ন— গলায় জোর থাকেনা।কারণ মনে মনে ঐ যে পাকিস্তান প্রেম। এদের উদ্দেশ্যেই ষোড়শ শতকের কবি আবদুল হাকিম বলেছেন, ‘যে জন বংগেতে জন্মে হিংসে বংগবাণী, সে জন কাহার জনম, নির্ণয় জানি’। বাংলায় জন্ম গ্রহণ করে যারা মনে মনে বাংলাকে ভালবাসে না, মাতৃভাষাকে ভালবাসে না, কবির ভাষায় তারা জারজ সন্তান। তাহলে বুঝা যায়, কবির সময়ে ও বাংলায় জারজ সন্তান ছিল, এখনো আছে, কবির পূর্বেও ছিল, ভবিষ্যতে ও থাকবে। এই জারজরা পৃথিবীর বিভিন্ন মুসলিম দেশে যখন নব বর্ষ পালন করে তা দেখে না, ইরানে যখন নওরোজ পালন করে, তখন তা দেখে না। বাংলায় নব বর্ষ পালন করলেই তাদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। কারণ নব বর্ষতো একটি চেতনার নাম, যা বাঙালিকে সাহস যোগায় অন্ধকারের বিরুদ্ধে, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে, ভÐামির বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করার জন্য।
নব বর্ষের সাথে ধর্মের কোন বিরোধ নেই। মুসলমানদের মধ্যে কোন কোন মাওলানা সাহেব পহেলা বৈশাখকে নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করেন। এটা তাদের সীমাবদ্ধতা। ধর্ম সারা বিশ্ব ব্যাপী বিস্তৃত, আর নব বর্ষ একটি ভাষাভিত্তিক জাতি গোষ্ঠীর মধ্যে বিস্তৃত। ধর্ম জাগতিক ও আধ্যাত্মিক, নব বর্ষ পালন সম্পূর্ণ সামাজিক। নব বর্ষ জাতির অন্তর্গত জনগোষ্ঠীর সামাজিক চেতনাকে লালন-পালন করে। একই জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী তাদের স্ব-স্ব ধর্মীয় চেতনাকে ও লালন করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বলতেন, ‘আমি মুসলমান একথা যেমন সত্য- আমি বাঙালি,একথা আরো সত্য’। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব আচার আচরণ, নিজস্ব খাবার—দাবার রয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর শারীরিক কাঠামো পর্যন্ত কারো সাথে কারো মিলে না। এমনকি ভারতের বিভিন্ন জাতি গোষ্ঠীর মধ্যেও এগুলোর কোন মিল নেই। আমি মাদ্রাজ তথা চেন্নাইতে দেখেছি, তামিলেরা হিন্দিতে কথা বলতে চায়না। তারা তামিল ভাষায় কথা বলে অথবা ইংরেজিতে কথা বলতে চায়। পারতপক্ষে হিন্দিতে কথা বলতে চায় না যদিওবা হিন্দি তাদের জাতীয় ভাষা। একই ভাবে হায়দেরাবাদের বাসিন্দারা তেলেগু ভাষায় কথা বলতে পছন্দ করে। তারা সহজে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে চায় না। তারা বৃহৎ ভারতের নাগরিক হওয়া সত্তে¡ও নিজস্ব ভাষা ও আঞ্চলিক স্বার্থের প্রতি অত্যন্ত দুর্বল। অথচ আমরা! এত রক্ত, এত অশ্রæর বিনিময়ে অর্জিত দেশে কিছু কিছু লোক দেখতে পাই, যারা পাকিস্তানের নাম শুনলে জিগির শুরু করে দেয়। এদের প্রতি ধিক্কার।
নববর্ষ বাঙালির গøানি, কূপমন্ডুকতা, কুসংস্কার, ধান্ধাবাজি, অহংকার গোঁড়ামি সব ধুয়ে মুছে নিয়ে যাক এই কামনা। ধ্বংসের মাঝে সৃষ্টির উল্লাস। তাই চির-বিদ্রোহী কবি নজরুল গর্জন করে গেয়ে উঠেছিলেন – ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর, ঐ নতুনের কেতন উড়ে, কাল বৈশাখীর ঝড়’। আমাদের নব প্রজন্মের তরুণেরা কাল বৈশাখীর ঝড় হয়ে আসুক, ধুয়ে মুছে নিয়ে যাক সমাজের সকল অপশক্তি, নতুন আলোয় উদ্ভাসিত হোক সমস্ত ভুবন।
লেখক : কলামিস্ট