বাঙালির প্রাণের উৎসব ‘নবান্ন’

70

নুসরাত সুলতানা

নিজস্ব বহুমুখী বৈচিত্রতা নিয়ে ষড়ঋতুর এই দেশে রূপময় শরতের পরে আসে রূপের রানি হেমন্ত। ঋতু পরিবর্তনের মধ্যে যেমন রয়েছে নির্দিষ্ট ধারাবাহিকতা ঠিক তেমনি প্রতিটি ঋতুর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। কার্তিক-অগ্রহায়ণ এ দু’মাস হেমন্ত কাল। ‘কৃত্তিকা’ ও ‘আগ্রা’ নামক দুটি তারার নামানুসারে এ মাস দুটির নাম রাখা হয়েছে বলে জানা যায়। এ দু’মাস জুড়ে বাংলার প্রকৃতিতে স্বীয় বৈশিষ্ট্যতা নিয়ে বিরাজ করে ফসলের ঋতু হেমন্ত। অগ্রহায়ণ শব্দটির ‘অগ্র’ ও ‘হায়ন’ এ দুটি শব্দের অর্থ যথাক্রমে ‘প্রথম’ ও ‘বৎসর, অব্দ, সাল’। তাই ধরে নেয়া হয় সম্রাট আকবর এই কারণেই অগ্রহায়ণ মাসকে বছরের প্রথম মাস বা খাজনা আদায়ের মাস ঘোষণা দিয়েছিলেন। বর্ষার শেষদিকে কিংবা শরৎ এর শুরুতে বোনা আমন-আউশ ধান শরতে বেড়ে ওঠে। আর হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিকে ধান পাকে। হেমন্ত কাল এসে পোঁছাতেই শস্যের মাঠ গুলোকে হলুদ রঙের বিছানা মনে হয়।
পাকা শস্যের হলুদ মাঠের এই রূপে মুগ্ধ হয়ে পল্লী-কবি জসিম-উদদীন যথার্থই লিখেছেন-
আশ্বিন গেল, কার্তিক মাসে পাকিল খেতের ধান, /সারা মাঠ ভরি গাহিছে কে যেন হলদি- কোটার গান।/ধানে ধান লাগি বাজিছে বাজনা, গন্ধ উড়িছে বায়, /কলমিলতায় দোলন লেগেছে, হেসে কূল নাহি পায়।/সারা মাঠে ধান, পথে ঘাটে ধান উঠানেতে ছড়াছড়ি/সারা গাঁও ভরি চলেছে কে কবি ধানের কাব্য পড়ি।
পাকা সোনালী ধান গুলো দেখে কৃষকের মন আনন্দে নেচে ওঠে। অগ্রহায়ণের শুরুতে সেই ধান কেটে মাড়াই করে গোলায় তুলেন কৃষক। এই হেমন্তে ফসল কাটাকে ঘিরেই শুরু হয় সার্বজনীন ঐতিহ্যবাহী মহোৎসব, লৌকিক উৎসব, বাঙালির প্রাণের উৎসব ‘নবান্ন’। নবান্ন শব্দটির আভিধানিক অর্থ হলো ‘নতুন অন্ন’ বা ‘নতুন ভাত’। আমন ধান কাটার পর নতুন চালের প্রথম রান্না উপলক্ষে আয়োজিত আনন্দানুষ্ঠান, পিঠা-পায়েস প্রভৃতি খাওয়ার উৎসব বা পার্বণ বিশেষ হলো নবান্ন। হেমন্ত কালের খাবারের বিপুল সমাহারের কথা সবারই জানা। নতুন ধানের নতুন চালের পায়েস, ক্ষীর, পিঠে-পুলি তৈরি করে আত্মীয় স্বজন ও প্রতিবেশীর ঘরে বিতরণ করা হয়। এ রীতি বেশ পুরোনো এবং হেমন্তের খাবার বেশ মজাদার। মানুষ সারা বছর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে এই সময়ের খাবারগুলোর জন্যে।
যারা খেতে ভালোবাসেন তারা নির্দ্বিধায় বলতে পারবেন, এ সময়ের খাবারগুলো কতটা সুস্বাদু। নানা রকম পিঠা পুলি আর খাবারের আয়োজন থাকে এ সময়ে। এত এত বাহারি পিঠা! এক এক করে খেয়েও শেষ করা যাবে না এত শতো খাবার। হেমন্তকালীন পিঠাগুলো স্বাদে অতুলনীয়। হেমন্তে বিভিন্ন ধরনের ফলের সমারোহ ঘটে। হেমন্তের বিশিষ্ট ফল হল আমলকী, জলপাই, কামরাঙা ও চালতা। নারিকেল এ ঋতুর প্রধান ফল। তাই হেমন্তের পিঠার তালিকায় থাকে নারিকেলের তৈরি রকমারি মুখরোচক লোভনীয় খাবার। আমাদের দেশে প্রতি বছরই নবান্ন এলে গ্রামে-গঞ্জে মেলা বসে।
হেমন্তে শিউলী, কামিনী, গন্ধরাজ, দোলনচাঁপা ইত্যাদি নানা ধরনের সুরভিত ফুল ফোটে। হেমন্তের সকালে শিউলির সৌরভ মানুষের মনে আনে উৎসবের আমেজ। খুশিতে প্রাণোজ্জ্বল থাকে সকলের প্রাণ। স্নিগ্ধ, শুভ্র সাদার মায়া আর মন মাতানো সুবাসে ছেয়ে থাকা শিউলি ফুল আঙিনায় উজার হয়ে পড়ে থাকে। দোলনচাঁপার হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া সুগন্ধ আমাদেরকে বিমোহিত করে। সন্ধ্যার পরপরই গন্ধরাজ ফুলের মাতাল করা সুবাসে মাতোয়ারা হতে হয় সকলকে। গাঢ় সবুজ পাতার মাঝে ছোট ছোট কামিনী ফুল গুলো তারার মতো ফুটে থাকে। হেমন্তের ঝকঝকে নীল আকাশে ভেসে বেড়ায় টুকরো টুকরো সাদা মেঘ। আকাশের এই সৌন্দর্য পৃথিবীর সব সৌন্দর্য্যকেই হার মানায়। এমন ঝলমলে প্রাণবন্ত আকাশ যে কারও মন মুহূর্তেই ভালো করতে পারে।
দিনের বেলায় কখনো কখনো গরমে একেবারে কাহিল অবস্থা হলেও কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে রাতের আকাশ। উত্তরের হালকা বাতাসের সাথে রাতের তাপমাত্রা কমে আসলে সবকিছু যেনো প্রাণ ফিরে পায়। এই সময় চাঁদের আলোয় নতুন শস্য তোলা ধানের জমিতে মেঠো পথ ধরে হাঁটার আনন্দই অন্যরকম। শরতের পরবর্তী এবং শীতের পূর্ববর্তী ঋতু ‘হেমন্ত’। তাই এ ঋতুকে এ দেশের মানুষ শীতের পূর্বাভাস বলে অভিহিত করেন। হেমন্তের সকাল মানেই শিশিরভেজা মনোমুগ্ধকর এক কোমল সকাল। হেমন্তের সকাল হালকা কুয়াশায় ঢাকা থাকে। সবুজ ঘাস ও ধান গাছের আগায় চিকচিক করতে থাকে মুক্ত দানার মতো শিশিরবিন্দু। সকালের কোমল আলো আসার সাথে সাথেই গাছের পাতাগুলো যেনো হেসে উঠে। যে ছবি হৃদয়ে আলোড়ন তুলে মুগ্ধতার ছোঁয়ায় আর ভালোবাসার অসীম মায়ায়। কুয়াশাচ্ছন্ন সকালে তাজা তাজা হরেক রকমের শাক সবজি নিয়ে ফেরি করে বেড়ায় ফেরিওয়ালা। সারাটা সকাল তাদের হাক ডাকে মুখরিত থাকে প্রায় প্রতিটি এলাকা।
হেমন্তে দিনগুলো একটু একটু করে ছোট হয়ে আসে। দুপুর গড়িয়ে গেলেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে দ্রæত। সারি সারি মেঘ ভেসে বেড়ানো আকাশের গায়ে এসে পড়ে কুয়াশার হিমেল স্পর্শ। সূর্য হারিয়ে ফেলে তার তেজ। হেমন্তের শেষের দিকে প্রায় সবগাছের পাতা ঝরে যেতে শুরু করে এবং অধিকাংশ গাছ এক পর্যায়ে পাতাহীন হয়ে পড়ে। তাই এ ঋতুকে পাতা ঝরার ঋতুও বলা হয়। বিশ্বের অন্যান্য দেশেও এই ঋতুতে ‘পাতা ঝরার উৎসব পড়ে যায়। এমন হাজারো মনোলোভা প্রাচুর্য্যরে সমারোহ হেমন্তকে এনে দিয়েছে রূপের রানি খ্যাতি।
লেখক: প্রাবন্ধিক