বাঙালির দেশে বাংলা ভাষার মর্যাদা

24

লিটন দাশ গুপ্ত

বিশ্ব মানচিত্রে বাঙালিজাতির একটা মাত্র দেশ, যার নাম বাংলাদেশ। ১৯৫২ সালে ভাষার দাবীতে আমাদের পরাধীন দেশের সূর্যসন্তানগণ রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্যে পথ রচনা করেছিলেন। সেই পথ বেয়ে ত্রিশ লক্ষ শহিদের বিনিময়ে এই দেশ ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জন করেছিল। সেই স্বাধীন বাঙালিজাতির বাংলাদেশে বাংলাভাষা কতটুকু মর্যাদা পাচ্ছে সেটা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। এই প্রসঙ্গে ভিয়েতনামের একটি উদাহরণ দিয়ে কিছুকথা বলতে চাই। গত কয়েক বছর আগে সরকারিভাবে প্রশিক্ষণে ভিয়েতনাম গিয়েছিলাম। সেখানে দেখেছি, প্রাথমিকস্তর থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত কোন শ্রেণিতে, কোথাও ইংরেজি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হয়না। ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়; এই হ্যানয় শহরে ইংরেজি হরফে ভিয়েতনাম বা হ্যানয় লেখা আছে, এমন কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি সংস্থা, ভবন, সড়ক-মহাসড়কে কোন প্রকার সাইনবোর্ড খুঁজে পেলাম না, যেখানে ইংরেজিতে ভিয়েতনাম লেখার সামনে দাঁড়িয়ে, স্মৃতি স্বরূপ একটি ছবি উঠাবো। শুধু তাই নয়, সেই দেশের ‘শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ’ মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী ও মহাপরিচালকসহ অন্যান্য উর্ধ্বতন কর্মকর্তার সাথে শিক্ষা সম্পর্কীয় আমাদের বৈঠকেও দেখলাম, তারা তাদের ভাষায় কথা বলছে, আর দোভাষী আমাদেরকে ইংরেজিতে অনুবাদ করে দিচ্ছে। জানতে পারলাম যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সাথে ভিয়েতনামের যুদ্ধের কারণে, ইংরেজি আন্তর্জাতিক ভাষা হবার সত্তে¡ও তারা এই ভাষা প্রত্যাখান করেছে। তারপরেও দেখলাম, ভিয়েতনামীয়রা মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে- শিক্ষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি সর্বক্ষেত্রে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তাল মিলিয়ে সমানতালে ও সমান্তরালে এগিয়ে যাচ্ছে। শুধু ভিয়েতনাম নয়; আমরা দেখছি চীন, ফ্রান্স, জাপান, জার্মান ইত্যাদি শীর্ষস্থানীয় দেশও তারা নিজেদের ভাষাকে গুরুত্ব দিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। অথচ মাতৃভাষা বাংলা এত রক্তাক্ত হবার সত্তে¡ও নিজ দেশে কতটুকু মর্যাদা পাচ্ছে তা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। ইংরেজি বিশ্বের অপরাপর দেশের সাথে যোগাযোগের জন্যে আন্তর্জাতিক ভাষা। সর্বক্ষেত্রে এর গুরুত্ব রয়েছে এটাও অস্বীকার করা যায়না। কিন্তু বাংলাদেশের মত বাঙালিস্তানে প্রথম শ্রেণি থেকে ত্রয়োদশ শ্রেণি পর্যন্ত তের বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাধ্যতামূলকভাবে ইংরেজি বিষয় পড়িয়ে, সব মানুষকে ইংলিশম্যান বানানোর উপযোগিতা আছে কি-না তা নিয়ে ভাবতে হবে। আজ সর্বক্ষেত্রে দেখা যায় ইংরেজি ভাষার প্রচলন। যাতায়াতের টিকিট থেকে ক্রয়বিক্রয়ের রসিদ, দোকান ব্যবসা প্রতিষ্ঠান রাস্তাঘাট অধিকাংশক্ষেত্রে ইংরেজি হরফ দেখতে পায়। শুধু তা নয় আইন বিচারসহ অনেক দাপ্তরিক সিদ্ধান্ত, বিভিন্ন প্রকল্পের পরিকল্পনা ও গৃহীত পদক্ষেপ ইংরেজিতে লেখা। এছাড়া বিভিন্নক্ষেত্রে ভুল বানান ও ভুল উচ্চারণ যেন ফ্যাশনে রূপ নিয়েছে।
আর একটি বিষয়ে দীর্ঘদিন যাবৎ বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করছি এবং বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যবেক্ষণে দেখছি, ইংরেজি বানান লিখতে পড়তে শিখতে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয় সংশ্লিষ্ট সকলের পক্ষ থেকে। কিন্তু অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের বাংলা বানান, উচ্চারণ ও ব্যাকরণগত ভুলের দিকে বিশেষ দৃষ্টি থাকেনা। অর্থাৎ, যে ভাবে ইংরেজি বিষয়ের যেকোন ভুলের প্রতি দ্রæত দৃষ্টি আকর্ষিত হয়, ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়, সেইভাবে বাংলা বিষয়ে হয়না। প্রাথমিক থেকে উচ্চশিক্ষাস্তরের শিক্ষায়, যেকোন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি বিষয়ে ভুলের জন্যে যেভাবে প্রশ্নের সম্মুখিন হতে হয়, বাংলা বিষয়ে ভুলের জন্যে এভাবে প্রশ্ন উঠেনা। বিশেষ করে ‘বাংলা’ বিষয় ছাড়া, অন্য বিষয়সমূহের বিষয়বস্তু বা তথ্যউপাত্ত সঠিক থাকলে, ঐ বিষয়ে বাংলাভাষার, ভাষাগত ভুল যাচাই বাছাই বা মূল্যায়ন করা হয়না। প্রসঙ্গক্রমে আড়াই দশক আগের একটি ঘটনা স্মরণ হয়ে গেল। আমি চট্টগ্রাম মহানগরীতে ‘উত্তরণ কোচিং সেন্টার’ নামে একটি কোচিং সেন্টার প্রতিষ্ঠা করেছিলাম। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে বিভিন্ন ব্যানার লিফলেট ও পোস্টারে বড় করে ভর্তির বিজ্ঞাপনের প্রয়োজনীয়তা পড়ে। এই সময় আমি সংশ্লিষ্ট অন্যান্যদের বলছিলাম, পোস্টার ব্যানারে সব লেখা যখন চলতি ভাষায় লেখা, সেই হিসাবে ঐ পোস্টার বা লিফলেটসমূহের শিরোনাম ‘ভর্তি চলছে’ লিখতে হবে। যদিও কোচিং এর পরিকল্পনা পরিচালনা প্রতিষ্ঠাসহ স্থান নির্ধারণ সবই আমার ছিল, কিন্তু শেয়ার হোল্ডার নেয়া হয়েছিল আরো বেশ কয়েকজন। তাই সকল ক্ষেত্রে সবার সাথে আলোচনা করে গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে থাকি। এই অবস্থায় অংশীদারের দুয়েক জন বলছে, ঐ লেখাতে ‘ভর্তি চলিতেছে’ হবে। এতে দেখা যায় কেউ ছাড়াছাড়ির পাত্র নয়, বাড়াবাড়ি বেশী হয়ে যাওয়ায় বিষয়টি তাড়াতাড়ি নিষ্পত্তির চেষ্টা করি। যদিও ঐ সময়ের ঘটনা এই সময়ে এসে অনুধাবন করলাম, তরুণ বয়সে সকলের ‘আমার কথা’ রাখতে হবে, ‘আমি পারি’ বা এই ধরনের আমিত্বভাব প্রদর্শনের প্রচেষ্টা বা চাহিদা থাকে। অর্থাৎ তরুণ বয়সে সকলে নিজেকে জাহির করতে চাই! যা ঐসময় কোচিং-এ অংশীদারদের হয়েছিল।
যাইহোক, যেহেতু আমাদের সাথে বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বেশ কয়েকজন সমবয়সী মেয়ে শিক্ষক ছিল, সেহেতু সংশ্লিষ্টরা নিজেকে আরো বেশী জাহির করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে! এই অবস্থায় আবারো গণতান্ত্রিক ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, একজন খ্যাতিমান বাংলাবিষয়ের অধ্যাপকের শরণাপন্ন হব। অবশেষে সকলের গ্রহণযোগ্য এক শিক্ষকের অভিমুখে গিয়ে বিস্তারিত উপস্থাপন করলাম। ঐ শিক্ষক আমাদের কথা গুরুত্ব সহকারে শোনেন এবং সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন, যেহেতু পোস্টার লিফলেটের সব কথায় চলিত ভাষায় লেখা, সেহেতু ‘ভর্তি চলছে’ লেখাটি রাখা বাঞ্ছনীয়। একইসাথে আরো বলেন, বর্তমানে সাধুভাষার প্রচলন নেই বললেই চলে, তাই ব্যাকরণগত ভাবে ‘ভর্তি চলছে’ শতভাগ সঠিক। তবে একটা কথা থেকে যায়; যেহেতু সবজায়গায় ‘ভর্তি চলিতেছে’ কথাটি দীর্ঘদিন যাবৎ সবখানে ব্যবহৃত হচ্ছে এবং অধিকাংশ মানুষের মস্তিষ্কে ঐ ‘চলিতেছে’ শব্দটি স্থাপিত হয়ে গেছে, সেহেতু ‘চলিতেছে’ সাধু-চলিত ভাষায় দূষণীয় হলেও, প্রচলিত হিসাবে ‘ভর্তি চলিতেছে’ প্রথাসিদ্ধ।
এখন অনেক পুরানো এই দৃষ্টান্ত এখানে আনার কারণ হচ্ছে, বাংলায় চারিদিকে যেভাবে বানানগত, উচ্চারণগত, ব্যাকরণগত ভুল চলে আসছে, একদিন ভুল বা অশুদ্ধ শব্দ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ গ্রহণ করার ফলে ঐ ভুলই শুদ্ধ হিসাবে পরিগণিত হবে। আর ‘ভর্তি চলছে’ আর ‘ভর্তি চলিতেছে’ এই দৃষ্টান্ত একটি আগামীদিনের বার্তা।
ইদানিং আরো প্রত্যক্ষণ করছি, তরুণ প্রজন্মের একাংশ আধুনিকতা দেখাতে গিয়ে, বাংলা+ইংলিশ মিশ্রণে ‘ব্যাংলিশ’ ভাষার প্রচলন করেছে! এইসব বিষয় নিরসনে বিশেষ কোন উদ্যোগ দেখিনি। কেবল ৩৬৫ দিনের বছরে, ফেব্রæয়ারি মাসের ২৮ দিন বাংলাভাষার মর্যাদা নিয়ে আমরা সোচ্চার হই, অবশিষ্ট ৩৩৭ দিন বাংলাকে ভুলে যাই। তাই স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর হলেও বাঙালিজাতির বাংলাদেশে, বাংলাভাষাকে সর্বক্ষেত্রে গুরুত্ব দিয়ে বিশেষ মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করা হোক এটাই আজকের ভাষার মাসে আমার প্রত্যাশা এবং আবেদন।
লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক