বাকযুদ্ধ নয়, উন্নয়নে সমন্বয় চাই

13

 

দেশের দ্বিতীয় বৃহৎ মেগাসিটি বাণিজ্যিক রাজধানী খ্যাত চট্টগ্রামে কিছুদিন পরপরই নালায় পড়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে। বিশেষ করে অতি বৃষ্টি ও জোয়ারের কারণে ড্রেন, নালা ও খালে পানি নিষ্কাশন বাধাপ্রাপ্ত হয়ে রাস্তায় ব্যাপক জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। এসময় মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে চলাচল করতে বাধ্য হয় সাধারণ মানুষ ও যানবাহন। আগস্টে এ ধরনের পরিস্থিতিতে মুরাদপুর থেকে চকবাজার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাওয়ার পথে মধ্যবয়সী সবজি বিক্রেতা আবু ছালেহ পা পিছলে ড্রেনে পড়ে নিখোঁজ হয়, যার লাশ এখনও মিলেনি। এঘটনার রেশ না কাটতেই গত সপ্তাহে সোমবার আগ্রাবাদে ফুটপাত দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় নালায় পড়ে মারা যান বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রী মেহেরীন মাহবুব সাদিয়া। এর আগে চলতি বছরের ৩০ জুন নগরীর ষোলশহর চশমা হিল এলাকায় খালের পাশের সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় খালে পড়ে যায় একটি সিএনজি টেক্সি। খালে তলিয়ে মারা যান চালক ও এক যাত্রী। ২০১৭ সালে এম এম আলী সড়কে রয়েল গার্ডেন কমিউনিটি সেন্টার সংলগ্ন বড় নালায় পড়ে তলিয়ে যান এক সাবেক সরকারি কর্মকর্তা। দৈনিক পূর্বদেশসহ সহযোগী সকল দৈনিকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, সাদিয়া যেখানে পড়ে গিয়েছিলেন, সেখানে রাস্তার পাশে নালা সংস্কার করা হয়েছে কয়েক মাস আগে। ফলে হাঁটার পথটি একেবারে সরু, কাদাযুক্ত হয়ে পড়ে, তদুপরি নালাটি সংস্কারের পর জননিরাপত্তা রক্ষায় কোন বেস্টনি বা স্ল্যাব না বসিয়ে নালাটি উম্মুক্ত রাখা হয়। যার খেসারত দিতে হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়াকে।
এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ঘটার পর সিডিএ ও সিটি করপোরেশন একে অন্যকে দায়ী করে। সা¤প্রতিক ঘটনাটি নিয়ে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র বলেছেন, নগরীর বড় বড় ড্রেন, খালের সংস্কার ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের দেওয়ানহাট থেকে পতেঙ্গা পর্যন্ত যে কাজ চলছে, তা সিডিএর আওতায়। এখানে সড়ক সংস্কার থেকে পরিষ্কার রাখা সব তাদের দায়িত্ব। অনেক গর্ত হয়েছে। তাদের অবহেলা ও অসতর্কতার জন্য এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। অন্যদিকে সিডিএ বলছে, এটা সিটি করপোরেশনের খাল। খালটা অনেক আগে থেকেই ওপেন ছিল। সেটা সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব। তারা যদি খালের ওপর স্ল্যাব না দেয় তাদের কিছু করার নেই। সিডিএর কোনো দোষ নেই, দাবি করেছেন সিডিএর এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের প্রকল্প পরিচালক।
আমরা লক্ষ্য করে আসছি, নগরীর অবকাঠামো উন্নয়ন ও নাগরিক সেবার মান উন্নয়নে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সিটি করপোরেশন ব্যাপক কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতা ও সঠিক তথ্যের আদান-প্রদানের অভাব থেকে পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও আস্থার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। এতে ড্রেনে পড়ে মানুষের মৃত্যুর ঘটনার পরও তাদের দায়িত্বহীন বাকযুদ্ধ চট্টগ্রামবাসীকে বিস্মিত করেছে। যা কারো কাম্য ছিল না। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে জানা যায়, নগরের প্রধান সড়কের পাশের নালা ও খালগুলো ছাড়াও শহরের ভেতরের সড়কগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। ড্রেনেজব্যবস্থাও ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। নগরীর নি¤œাঞ্চলে জোয়ার-ভাটায়ও পানি উঠে আসে, দেখা দেয় জলাবদ্ধতা। খালগুলো দখল ও ভরাট হয়ে থাকায় বৃষ্টির পানি নামতে পারে না। ফলে নগরবাসীকে এ নিয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়, যেখানে-সেখানে বর্জ্য জমে দুর্গন্ধ সৃষ্টি করে। নগরের উন্নয়নে জোড়াতালি দেওয়ার মতো বিচ্ছিন্ন কিছু কাজ হলেও মাস্টারপ্ল্যানের মাধ্যমে নগরের উন্নয়ন হচ্ছে না।
দেখা যাচ্ছে, এই নগরীর উন্নয়ন ও নাগরিক সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের হলেও চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও সড়ক অবকাঠামো উন্নয়ন এবং জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ করছে । সুতরাং কোনো প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নকাজ যদি নাগরিক ভোগান্তি শুধু নয়, মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়, তার দায় কে নেবে। এমন অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু আমরা দেখতে চাই না। আমরা বাকযুদ্ধও চাই না। চাই উন্নয়ন কাজের সমন্বয়। আর এ সমন্বয়ের উপায় বের করবে সরকার।
সমন্বয় করার জন্য প্রয়োজন সিটি কর্পোরেশনের পর্যাপ্ত ক্ষমতা এবং মেয়রের পদমর্যাদা বৃদ্ধি। স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞদের মতে ‘সিটি গভর্ন্যান্স’ ছাড়া এ ক্ষমতা প্রয়োগ সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, দেশের সিটি কর্পোরেশনগুলো নাগরিক সমস্যা দূরীকরণ ও উন্নয়ন বিষয়ক কার্যক্রম নাগরিকবান্ধব করতে সিটি গভর্ন্যান্সের বিকল্প নেই। সরকার বিষয়টি অনুধাবন করে, চট্টগ্রাম দেশের অর্থনীতিতে যেভাবে অবদান রাখছে, তাতে অতি দ্রুত নিরাপদ, বাসযোগ্য ও পরিকল্পিত চট্টগ্রাম নগরী গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে-এমনটি প্রত্যাশা আমাদের।