একটা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সিলেবাস একটু দেখে দেবার জন্য অনুরোধ এসেছে। কাজে বসেছি, দেখি বেশ ক্লান্তিকর দীর্ঘ সিলেবাস, কিন্তু চোখ আটকে যাচ্ছিলো বরাবর একটা ইংরেজি শব্দের ওপর, নু. বাই বা দ্বারা, অর্থাৎ অমুক বইটি কার লেখা সে অর্থে। তখন আমার মন এই শব্দটার মই বেয়ে নেমে গিয়ে পৌঁছুলো আমার শিশুকালে, যখন আমরা অনেকগুলো ছানাপোনা ভাইবোন একত্রে স্কুলের বিভিন্ন ক্লাশে আসা-যাওয়া করছি, আর প্রতি বছরের শুরুতেই স্কুল থেকে নাচতে নাচতে এসে বাবাকে পাশ করার পাশাপাশি যে কাগজটি ধরিয়ে দিতাম সেটি হলো বুকলিস্ট। আমাদের বুড়ো বাবা আন্দরকিল্লার বইয়ের বাজার থেকে লিস্ট অনুয়ায়ী বইগুলো কিনে নিয়ে আসতেন। অনেক বই নতুন কিনতে হতোনা কারণ সেগুলি পাশ করা বড় ভাইবোনদের কাছ থেকে ছোট ভাইবোনদের কাছে চলে আসতো। তবুও আগ্রহ থাকতো নতুন বইগুলির প্রতি। তো বাবা বই আনার পর বুকলিস্টের সঙ্গে পরম আগ্রহে মেলালাম। দেখি দু’টো বই নেই। বাবার কাছে গেলাম। ‘বাবা, এই বই দু’টো যে নেই!’ বাবা আমার হাত থেকে লিস্টখানি নিয়ে বললেন, এ দু’টো বইয়ের বাই ঠিক নেই।
’বাই’ ঠিক নেই? আমি বাচ্চা ছেলে তখন। না বুঝে বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। বাবা বললেন, এই বই দু’টোর লেখক কে কে সেটা ঠিক ভাবে লেখা হয় নি। তখন থেকে আমি ‘বাই’এর গুরুত্ব বুঝতে শুরু করলাম। তারপর পেশাগত জীবন বলতে এমন এক চাকরিতে ঢুকলাম যেখানে ‘বাই’ নিয়ে ‘বাই’ (চট্টগ্রামের ভাষায় এই ‘বাই’য়ের অর্থ হলো একটা অতি-স্বভাবী রোগ, যেটা না হলেই ভালো।) তৈরি হলো। হয়তো চায়ের কাপে ঠোঁট রেখে সহকর্মীকে বললাম, অমুক বইটা খুব ভালো। সহকর্মী সাথে সাথে বললেন, অমুকের লেখা বইটা পড়েছেন, সেটি আরো ভালো।
অর্থাৎ ‘বাই’ হলো মালিকানা বোধ। এটি মানবসমাজে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুতর বিষয়। জমি কেনাবেচার সময় ’মূলে’ বলে একটা কথা আছে। অর্থাৎ জমিটা কার দ্বারা অধিকৃত। শেক্সপিয়ারের টেম্পেস্ট নাটকে ক্যালিবান রেগেমেগে তার মনিব প্রসপেরোকে বলছে, তুমি আমার মায়ের দ্বীপ জোর করে কেড়ে নিয়েছো। এটার প্রকৃত মালিক আমি: দিজ আইল্যান্ড ইজ মাইন বাই সাইকোরাক্স, মাই মাদার।’ প্রসপেরোর উত্তরসূরি হিসেবে পরবর্তী সময়ে বৃটিশরা ভারত উপমহাদেশ দখল করে নিল, অর্থাৎ আমাদের বাই ওদের কাছে চলে গেল।
‘বাই’-এর আরেকটি উৎকৃষ্ট রাজনৈতিক কনটেক্সট হচ্ছে স্বাধীনতার ঘোষণা নিয়ে আমাদের রাজনৈতিক সমাজে যে বিতর্কটা চালু রাখার চেষ্টা হয়ে থাকে। যা হোক, এখন ঐতিহাসিকভাবে এবং রাজনৈতিকভাবে বিশ্লেষিত হবার পর এ সত্যটা প্রমাণিত যে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার একমাত্র দাবীদার, অর্থাৎ তিনিই একমাত্র ‘বাই’—অন্যরা তাঁর পক্ষে এই ঘোষণা দিতে পারেন মাত্র।
আমার ব্যক্তিগত লেখক জীবনে ‘বাই’ নিয়ে একটা প্রসঙ্গের অবতারণা করে লেখাটি ছেড়ে দেব। অনেকেই হয়তো জানেন আমি ইংরেজি ভাষার শিক্ষার একটা নতুন পদ্ধতির কথা চিন্তা করে ১৯৯৬ সালে “গল্পে গল্পে ইংরেজি শেখা” বইটি প্রথমে নিজে প্রকাশ করি। পরে মাওলা ব্রাদার্স সেটি গ্রহণ করেন এবং তাঁরা এ পর্যন্ত বইটির বিভিন্ন মুদ্রণ বা সংস্করণ প্রকাশ করে যাচ্ছেন। কিন্তু বেশ কয়েক বছর আগে বইয়ের ব্যাপারে বাংলা বাজার গেলে আমার চক্ষু চড়কগাছ। দেখি কি ঠিক একই নামে আরেকজনের প্রকাশিত আরেকটি বই (ভদ্রলোকের নামটি আমার এ মুহূর্তে মনে পড়ছে না। হিন্দু ভদ্রলোক।)। শুধু রক্ষা যে বইটি আমার বইয়ের অনেক পরে প্রকাশিত। পরে দেখলাম যে বাজার ভর্তি “গল্পে গল্পে রসায়ন শেখা,” “গল্পে গল্পে পদার্থবিদ্যা শেখা” ইত্যাকার নামেও বহু বই প্রকাশিত হয়েছে। সে যা হোক—।
‘বাই’ থেকে ‘নাই’ বা ‘বাই বাই’ হয়ে যাবার আশংকাও প্রচুর।