বাংলার সূর্যসন্তান সিআর দত্ত বীর উত্তম

19

মহাকবি মাইকেল মধুসুদন দত্ত ‘বঙ্গভূমির প্রতি’ কবিতায় লিখেছেন, ‘জন্মিলে মরিতে হবে,/অমর কে কোথা কবে,/ চিরস্থির কবে নীর, হায়রে, জীবন-নদে?’ কবিগুরু তাঁর ‘বলাকা’ কাব্যের ‘শা-জাহান’ কবিতায় লিখেছেন, ‘জীবনেরে কে রাখিতে পারে!/ আকাশের প্রতি তারা ডাকিছে তাহারে।’ সত্যদ্রষ্টা কবিদের উল্লেখিত কবিতাংশের সুসজ্জিত শব্দমালায় জীবন ও জগতের পর্যবেক্ষণে ‘মৃত্যু’ নামক নামক চিরন্তন সত্যের বাতাবরণে নশ্বর জীবনের লিপিবদ্ধ রূপ প্রকাশ পেয়েছে। যে কোন মানুষকে চলমান জীবনের এক পর্যায়ে গিয়ে চিরদিনের মতো থেমে যেতে হয়। অর্থাৎ সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের প্রাণস্পন্দন অনন্তকালের জন্য নয়, তাতে কালের নির্দিষ্ট সীমারেখা অঙ্কিত। চির জাগতিক নিয়মে জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য সত্য এবং চিরন্তন রীতি।এই চিরন্তন সত্যরীতি সকলের ভাগ্য লিখন যা অলঙ্ঘনীয়। এই চিরন্তন সত্যের পথে গত ২৫ আগস্ট ২০২০ খ্রিস্টাব্দে চলে গেলেন মুক্তিযুদ্ধকালীন ৪নং সেক্টর কমান্ডার চিত্ত রঞ্জন দত্ত বীরোত্তম। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় ৯৩ বছর বয়সে তিন মেয়ে ও এক ছেলে রেখে শেষ নিঃশ^াস ত্যাগ করেন।তিনি সি আর দত্ত নামেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত ও খ্যাত। কালের নিয়মে নিভে গেল বাংলার আকাশের এক উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক। তিনি দেশপ্রেমের অনন্য প্রতীক এবং প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরের প্রেরণা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শক্তি ও সাহসের উৎস। কর্তব্য পালনে যিনি ছিলেন অবিচল এবং জাতিসত্তার হিত সাধন ছিল তাঁর একনিষ্ঠ ব্রত। তাঁর বর্ণাঢ্য জীবনের পরতে পরতে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী ভূমিকা সূর্যালোকের বর্ণচ্ছটার মতো সুউজ্জ্বল হয়ে আছে।তিনিমানবাধিকারের পক্ষে অদম্য সাহসিকতায় উচ্চকণ্ঠ ছিলেন। নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের কণ্ঠস্বর এবং অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাতিঘর ছিলেন অকুতোভয় এই বীর। সর্বোপরি সাতকোটি বাঙালিকে পরাধীনতার কঠিন শৃঙ্খল থেকে মুক্তি দিতে সম্মুখ রণাঙ্গনে নেতৃত্বদানকারী শত্রæবিনাশী বিজয়ী রণনায়ক জাতীয় বীর এবং বাংলার সূর্য সন্তান প্রয়াত সি আর দত্ত। তাঁর মহাপ্রয়াণ একদিকে যেমন জাতীয় জীবনকে প্রবল শোকগ্রস্ত করেছে ঠিক অন্যদিকেএক অপূরণীয় শূন্যতা তৈরি করেছে।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারিআসামের রাজধানী শিলংয়ে তাঁর জন্ম। বাবা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত। মালাবণ্য প্রভাদত্ত। পুলিশ অফিসার পিতা উপেন্দ্র চন্দ্র দত্তের চাকরির কারণে তাঁর পরিবার শিলংয়ে থাকতেন। তাঁর পৈত্রিক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। প্রাথমিকের দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত শিলংয়ের লাবান গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে পড়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে তাঁর বাবা চাকরি থেকে অবসর নিলে স্থায়ীভাবে হবিগঞ্জে চলে আসেন তাঁরা।তখন তিনি হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে ম্যাট্রিক এবং দৌলতপুর বিএল (ব্রজ লাল) কলেজ থেকে আইএসসি ও বিএসসি পাস করেন। পড়ালেখা ও নিয়মকানুন মানার ক্ষেত্রে বাবার কড়া নজরদারি আর মায়ের পরম মমতা মাখা দেখভালের ভেতর দিয়ে চমৎকার পারিবারিক আবহে তাঁর বেড়ে উঠা। তাঁরা পাঁচভাই, দুইবোন। ভাইদের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। বোনেরা ছিলেন বড়। তাঁর ডাকনাম রাখাল। ছোট বেলায় তিনি খুব সাহসী ও দুরন্ত ছিলেন। ছোট্ট দুরন্ত রাখাল পরবর্তীকালে হয়ে উঠেন বাঙালির মুক্তিপথের অন্যতম কাÐারী সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্ত বীর উত্তম এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের ক্ষেত্রে আপোসহীন ইস্পাত কঠিন স্তম্ভস্বরূপ অসাম্প্রদায়িক চেতনার সংগ্রামী অগ্রনায়ক।
আমাদের দুর্ভাগ্য, পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা জাতিরজনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা এবং ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী জাতীয় চার নেতা যথাক্রমে বাংলাদেশের প্রথম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিসভার সদস্য ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী ও এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলার স্বাধীনতার প্রকৃত গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করে ছিল একদল ঘাতক, দেশদ্রোহী, স্বাধীনতা বিরোধী ও পাকিস্তানী প্রেতাত্মা। এরই সাথে ৭৫ এরপরে দীর্ঘ দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার ইতিহাস বিকৃতির নগ্ন প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকায় স্বাধীনতার প্রকৃত ইতিহাসও বীর উত্তম সিআর দত্তদের মতো বাঙালি জাতির অনেক সূর্যসন্তানদের বীরত্ব গাঁথার অনেক তথ্য ৭৫ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অজানা রয়ে গেল।
প্রয়াত চিত্ত রঞ্জন দত্ত ১৯৫১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদানের কিছুদিন পর সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট পদে কমিশন পান। সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাধে ১৯৫১ থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তিনি দীর্ঘ সময় পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলেন। তিনবছর পর পর ছুটিতে দেশে আসতেন।১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামের পাহাড়ী এলাকা আসালংয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়েছিল। সে যুদ্ধে সেনাবাহিনীর কম্পানি কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে হারিয়ে আসালং মৌজা পুনর্দখল করেছিলেন তাঁরা। আসালং জয়ের ফলে পাকিস্তান সরকার তাঁকে মেডেল দিয়েছিল ও পুরস্কৃত করেছিল। পাকিস্তন সেনাবাহিনীতে প্রথম ও একমাত্র বাঙালি হিন্দু অফিসার ছিলেন তিনি। একনিষ্ট কর্তব্যপরায়ণতা ও আনুগত্যের কারণে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও একটা সম্মানজনক অবস্থান ছিল তাঁর। পরবর্তীতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান হিন্দুদের নিয়ে যখন বিষোদগারে মেতে উঠলেন তখন তিনি দুরন্ত সাহসিকতার সহিত দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করে বলে উঠেছিলেন, ’আই অ্যাম অ্যা হিন্দু অ্যান্ড আই অ্যাম প্রাউডটু বি অ্যা মেজর অব পাকিস্তান আর্মি।
১৯৭১ সাল। জানুয়ারি মাস। ছুটি নিয়ে পাকিস্তান থেকে হবিগঞ্জে এলেন। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সিক্স ফ্রন্টিয়ার্সের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সিনিয়র মেজর। দেশে চারদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা চলছিল। পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক অনাচার, অবিচার ও শোষণ থেকে মুক্তির জন্য মানুষ উন্মুখ হয়ে রইলো। ৭ মার্চ হবিগঞ্জে রেডিওতে তিনি শুনলেন ঐতিহাসিক সেই ভাষণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ শুনে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন এবং সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আর ফিরে যাবেন না। দেশ ও মানুষের মুক্তির জন্য লড়বেন। দেশকে শত্রুমুক্ত করবেন। পরবর্তীতে স্ত্রী মণিষা দত্ত (যিনি ২০১০ সালে মৃত্যুবরণ করেন) ও ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে দেশ মাতৃকার সম্মান রক্ষার মরণপণ শপথ নিয়ে হবিগঞ্জ-মৌলভীবাজারে প্রতিরোধযুদ্ধ করেন। প্রতিরোধযুদ্ধ শেষে ভারতে যান। পরে তিনি ৪ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি এলাকা ছিল এই সেক্টর। দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিরাট অংশ নিয়ে ছিল এই সেক্টরের অবস্থান। এই সেক্টরের আওতাধীন সিলেট জেলার কানাইঘাট, জকিগঞ্জ, বিয়ানীবাজার, গোলাপগঞ্জ, ফেঞ্চুগঞ্জ, বালাগঞ্জ ও বিশ্বনাথ উপজেলা, সুনামগঞ্জ জেলার জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা উপজেলা এবং মৌলভীবাজার জেলা। এটি পাহাড়ী এবং দুর্গম এলাকা ছিল। গেরিলা যুদ্ধের জন্য উপযুক্ত এলাকা। তাঁর সেক্টরে প্রায় নয় হাজার গেরিলা যোদ্ধা ছিলেন। তাঁদের মধ্যে নিয়মিত মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন প্রায় চার হাজার। তিনি ও তাঁর সহযোদ্ধারা হানাদারবাহিনীর সাথে অসংখ্য মুখোমুখি ও গেরিলা যুদ্ধ করেছিলেন। যুদ্ধশেষে মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি বীর উত্তম খেতাবে ভূষিত হন। যুদ্ধের পর ১৯৭২ সালে সেনাবাহিনীর রংপুর ব্রিগেডের বিগ্রেড কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ১৯৭৩ সালে দায়িত্ব পেয়ে সীমান্ত রক্ষী বাহিনী বিজিবি ( পূর্ব নাম বাংলাদেশ রাইফেলস্ ) গড়ে তোলেন। তিনি বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম মহাপরিচালক। ১৯৭৭ সালে প্রথম মেয়াদে এবং ১৯৮২ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে দু-দুবার মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান এবং ১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। সর্বক্ষেত্রে তাঁর কর্তব্যপরায়ণতা ছিল প্রবল এবং সফলতা ছিল ঈর্ষণীয়। কল্যাণ ট্রাস্টের বিভিন্ন লাভজনক প্রতিষ্ঠান বিক্রি করতে সরকারকে বাঁধা দেয়ার কারণে ১৯৮৪ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের নির্দেশে এলপিআর ছাড়াই আইনবহির্ভূতভাবে তাঁকে চাকরি থেকে অবসর নিতে হয়।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার নিয়ে সি আর দত্তের মতো বাংলার সূর্য সন্তানরা জীবনবাজি রেখে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলেন। কিন্তু পঁচাত্তর পরবর্তী অসাংবিধানিক সরকারগুলো রাষ্ট্রকে মুক্তিযুদ্ধের সেই অঙ্গীকার পূরণের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছিল। এদেশে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী যখন থেকে খুব বেশি অসহায় ও বিপন্ন বোধ করতে শুরু করল তখনএই বীর সকল সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে গিয়ে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন এবং তাঁদের অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করেছিলেন। অবশ্য এজন্যও তিনি তৎকালীন এরশাদ সরকারের রোষানলে পড়েন। এমনকি তাঁকে হত্যার জন্য সরকারের লোকেরা বাংলা একাডেমির সামনে, তিন নেতার মাজারের পাশ দিয়ে গাড়ি চালিয়ে আসার সময় তাঁর উপর গুলি চালায়। তাঁর স্ত্রীও এসময় সঙ্গে ছিলেন। গুলি তাঁদের কারও গায়ে না লেগে কাচে লাগাতে তাঁরা ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান। তাই তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, ‘আমি মুক্তিযুদ্ধ করে এই দেশকে স্বাধীন করেছি। কখনো ভাবিনি, আমাকে এই দেশের সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর অধিকার ও নিরাপত্তার জন্য লড়াই করতে হবে।’ তিনি আমৃত্যু বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি ছিলেন। তিনি ২০০৭ সালে গঠিতসেক্টর কমান্ডারস্ ফোরামের মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতেও সোচ্চার ছিলেন।
দেশ ও জাতির কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ হয়ে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে অসীম সাহসিকতায় বীর দর্পে এগিয়ে যাওয়া বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে আমরা হারিয়েছি ঠিকই কিন্তু তাঁর গগনচুম্বী কীর্তি তাঁকে ইতিহাসের পাতায় অমর করে রাখবে। তিনি বেঁচে থাকবেন মুক্তি পাগল মানুষের স্বপ্নের মাঝে। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের শক্তির উৎস হয়ে থাকবেন চিরদিন। হে বীর যোদ্ধা সশ্রদ্ধ স্যালুট আপনাকে। পরিশেষে কবিগুরুর ভাষায় বলবো- ‘নয়নসম্মুখে তুমি নাই,/নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই।
লেখক: শিক্ষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক