বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক

32

নাজিমুদ্দীন শ্যামল

ভারতের সাথে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক, সামাজিক, এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে। দুই দেশেরই ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভাষাগত, ঐতিহ্যগত এবং শিল্পকলা এবং সংস্কৃতির প্রতি আবেগ প্রায় সমরূপে এবং উক্ত বিষয়গুলোতে মিল রয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে দুই দেশই একে অপরের ঘনিষ্ঠ মিত্ররূপে কাজ করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দুই দেশের মধ্যে শক্তিশালী জোটের সম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৭০ সালের শেষ দিকে এবং আশির দশকের বিভিন্ন স্নায়ু যুদ্ধে এই সম্পর্ক আরও উন্নত হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অর্থনৈতিক উদারীকরণের সূত্রপাত সাথে তারা বৃহত্তর প্রবৃদ্ধি ও বাণিজ্যের উদ্ভাবন ঘটায়। পরবর্তীতে ১৯৯৬ সালে দুই দেশের মধ্যে ঐতিহাসিক গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই সন্ত্রাসবাদ-বিরোধী সব কৌশলগত অংশীদার হিসেবে ভূমিকা রাখছে। ফলে তারা দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে বড় ব্যবসায়িক অংশীদার হয়ে উঠে। তবে উভয় দেশই পরস্পরের ভৌগোলিক সীমারেখা, সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক নিরাপত্তা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নকে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। ২০১০ সালে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে অর্থনৈতিক বিনিময় বিস্তৃতকরণের মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যেকার এই সম্পর্ক আরও ত্বরান্বিত হয়। কোভিড-১৯ অতিমারি সত্তে¡ও ভারত ২০২১ সালে বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রæত অর্থ প্রদান করেছে। ভারত ও বাংলাদেশের ভাষা-সংস্কৃতি বহু যোগসূত্রের অংশীদার। সার্বভৌমত্ব, সমতা, পারস্পরিক আস্থা ও সমঝোতার ভিত্তিতে দুই দেশের চমৎকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক। যা কৌশলগত অংশীদারিত্বকেও অতিক্রম করে যায়। এই অংশীদারিত্ব বাংলাদেশের জন্য ভারতের ১৪০ কোটি মানুষের উদার ভালোবাসার পরিচয় বহন করে। তাই লাইনস অব ক্রেডিট (এলওসি) কর্মসূচির অধীনে ভারত এখন বাংলাদেশের অন্যতম উন্নয়ন অংশীদার। ফলস্বরূপ ভারত সরকার বাংলাদেশকে প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত ক্রয়ের জন্য ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারসহ প্রতিশ্রæতিবদ্ধ ৯.৪৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রেয়াতি অর্থায়ন এবং ৭.৮৬২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কনসেশনাল লাইনস অফ ক্রেডিট (খঙঈং) প্রদান করেছে। যার মধ্যে ১.৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার কনসেশনাল ফাইন্যান্সিং স্কিম (ঈঋঝ) এর অধীনে। এলওসি তহবিল ব্যবস্থার অধীনে ভারত সরকারের মোট প্রতিশ্রæতির প্রায় এক-চতুর্থাংশ বাংলাদেশকে প্রদান করা হয়েছে।
২০২১-২২ অর্থবছরের শেষ পর্যন্ত চুক্তিসমূহ ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের মাইলফলক অতিক্রম করেছে এবং মোট ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদানের মাইলফলকও অতিক্রম করেছে। ২০২১-২২ সালে লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় সর্বোচ্চ ২২৮.৬৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার প্রদান করা হয়েছে, যা ২০২০-২১ সালে প্রদান করা ১৪১.১৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চেয়ে ৬২% বেশি। বাংলাদেশ সরকারের মতে, কোভিড-১৯ অতিমারি সত্তে¡ও ভারত ২০২১ সালে বাংলাদেশের অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্যে সবচেয়ে দ্রæত অর্থ প্রদান করেছে।
ইআরডির সূত্র মতে, ২০২২ সালের জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ১৪৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও বেশি অর্থ প্রদান করা হয়েছে, যা ভারতকে বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় উন্নয়ন অংশীদারে পরিণত করেছে। ৪২টি প্রকল্প প্রতিশ্রæতিবদ্ধ এলওসিভুক্ত প্রকল্পসমূহের অংশ, যার ভেতর ১৪টি প্রকল্প ইতোমধ্যেই শেষ হয়েছে এবং বাকি ২৮টি প্রকল্প বাস্তবায়নের বিভিন্ন প্রক্রিয়াধীন [৮টি সক্রিয় নির্মাণাধীন, ৯টি ইপিসি টেন্ডারিং/চুক্তি পর্যায়ে, ২টি পিএমসি টেন্ডারিং-এ/চুক্তি পর্যায়ে, এবং ৯টি প্রকল্প প্রস্তুতি পর্যায়ে রয়েছে]। প্রকল্পসমূহের মাঝে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে রেলপথ, সড়ক ও পরিবহণ, বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সঞ্চালন, অভ্যন্তরীণ জলপথ, বন্দর ও শিপিং, অর্থনৈতিক অঞ্চল, আইসিটি, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি (রিনিউয়েবল এনার্জি), বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বিমান চলাচলের মতো বিভিন্ন সেক্টর। প্রায় ২.৪২ বিলিয়ন ডলার মূল্যের ১১টি প্রকল্প চুক্তি পর্যায়ে রয়েছে।
খুলনা-মোংলা রেললাইন প্রকল্প ভারতীয় অর্থায়নে এলওসি-র অধীনে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বন্দর অর্থাৎ মোংলা বন্দরকে বাংলাদেশ রেলওয়ে নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত করেছে, যার ফলে বাংলাদেশের জন্য এটি জেটি থেকে রেলপথের মাধ্যমে কনটেইনার ও কার্গো পরিবহণ সুবিধাসমন্বিত প্রথম বন্দর হয়ে উঠেছে। ভারত সরকারের সিএফএস ফান্ডের অর্থায়নে রামপালে মৈত্রী আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের ‘ইউনিট-১’ ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরকালে তাঁর কাছে হস্তান্তর করা হয় এবং প্ল্যান্টটি এখন বাংলাদেশের জাতীয় গ্রিডের সাথে সংযুক্ত। উভয় দেশের যৌথ উদ্যোগে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প শেষ হওয়ার পথে। এছাড়াও, আখাউড়া-আগরতলা রেল সংযোগ প্রকল্প, ইন্ডিয়া বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ পাইপলাইন প্রকল্প (ওইঋচখ), আশুগঞ্জ- জকিগঞ্জ/করিমগঞ্জে ড্রেজিং প্রকল্প, সিরাজগঞ্জ-দাইখোয়ায় ড্রেজিং প্রকল্পের মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পসমূহের পাশাপাশি কমিউনিটি-কেন্দ্রিক বেশকিছু প্রকল্প অনুদানের আওতায় গৃহীত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। ভারতীয় এসব ঋণ সহযোগিতা বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো খাতকে বিশেষভাবে উপকৃত করে চলেছে।
ভাষা, সংস্কৃতি, মানুষের ভাবাবেগ ও স্বার্থের এক অসাধারণ সম্পর্কের মিথস্ক্রিয়া বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে এক বিশেষ মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ও সোভিয়েত ইউনিয়নের অবদানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা ভারত এবং বাংলাদেশের সম্পর্ক কালক্রমে তাই নতুন মাত্রা পেয়েছে। মূলত বঙ্গবন্ধু তনয়া দেশরতœ শেখ হাসিনা ১৯৯৬ ও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমঝোতার ওপর ভিত্তি করে এ সম্পর্ক সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছায়। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে ‘প্রতিবেশীই প্রথম’ নীতির কারণে বাংলাদেশ ভারতের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ২৬ ও ২৭ মার্চ নরেন্দ্র মোদি বংলাদেশ সফর করছেন। করোনা মহামারি শুরুর পর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর এটাই প্রথম বিদেশ সফর। নরেন্দ্র মোদির আসন্ন ঢাকা সফর তাই নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ।
লেখক : কবি, সাংবাদিক
চট্টগ্রাম ব্যুরোপ্রধান, দি ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস/ চট্টগ্রাম প্রতিনিধি, রয়টার্স