বাংলাদেশ কতটা সুনামির ঝুঁকিতে?

45

বিশ্বজুড়ে গতকাল মঙ্গলবার পালন করা হয়েছে সুনামি সচেতনতা দিবস। বাংলাদেশ ভূখন্ডে খুব সম্প্রতি বড় ধরনের কোন সুনামি না হলেও, আরাকান অঞ্চলের একটি টেকটনিক প্লেটের কারণে সুনামির ঝুঁকি রয়েছে বলে বলছেন বিশ্লেষকরা। তবে খুব তাড়াতাড়ি সেটি ঘটার আশঙ্কা নেই বলে বলছেন একজন বিশেষজ্ঞ। কিন্তু সুনামির কোন ঘটনা ঘটলে প্রাণহানি বা ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে বাংলাদেশে প্রায় কোন প্রস্তুতি নেই বলেই বিশেষজ্ঞরা বলছেন।
সুনামি শব্দটি জাপানি ভাষা থেকে এসেছে, যার অর্থ হারবার ওয়েভ বা পোতাশ্রয়ের ঢেউ। এটি আসলে বিশাল আকারের শক্তিশালী জলোচ্ছ্াস। সমুদ্রতল বা তীরবর্তী মাটির গভীরে ভূমিকম্প অথবা টেকটনিক প্লেটের আকস্মিক উত্থানপতনের ফলে সমুদ্রের পানিতে কম্পনের তৈরি হয়, ফলে সেখানে বিশাল আকারে ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়।
সেই ঢেউয়ের ফলে পানি আরো ফুলে উঠে যখন প্রবল বেগে ধাবিত হতে থাকে, সেটাকেই সুনামি বলে বর্ণনা করা হয়। সমুদ্রতলের আগ্নেয়গিরি থেকে হঠাৎ অগ্নুৎপাতের কারণেও সুনামির তৈরি হতে পারে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরের শেষ সপ্তাহে ইন্দোনেশিয়ার পালুতে সাড়ে সাত মাত্রার ভূমিকম্পের পর যে সুনামি হয়, তাতে ঢেউয়ের উচ্চতা হয়েছিল ১৯ ফুট। ওই সুনামির আঘাতে পালু শহরে ১৩০০-র বেশি মানুষ নিহত হয়। এর আগে ২০০৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায় আরেকটি সুনামিতে আড়াই লক্ষ মানুষ নিহত হয়েছিল।
২০১১ সালে জাপানে রিখটার স্কেলে ৯ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানার পর ৩৩ ফিট উচ্চতার সুনামি আঘাত হানে। ওই ঘটনায় প্রায় ১৮ হাজারের মানুষের মৃত্যু হয়। ২০১৬ সালে জাপানে আরেকটি ভূমিকম্প ও সুনামির আঘাতের ঘটনা ঘটে, যাতে ফুকুশিমা পরমাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের অধ্যাপক একিউএম মাহবুব বলছেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মাঝে বার্মিজ প্লেট বলে একটি টেকটনিক প্লেট রয়েছে, যেখানে কোন রকম নড়াচড়া হলে বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার একটা ঝুঁকি রয়েছে। সেখানে বড় ভূমিকম্প হলে অবশ্যই আশেপাশের সাগরে বড় ধরনের সুনামির তৈরি হবে।
এরকম কিছু হলে সেটা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বিপদজনক হবে বলে তিনি বলছেন। কারণ এর ফলে যে ভয়াবহ সুনামির সৃষ্টি হবে, তাতে ঘন জনবসতির বাংলাদেশে উপকূলীয় এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি হতে পারে।
তবে ভূ-তত্ত¡ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, এই প্লেটে ভূমিকম্প হলে অবশ্যই বড় সুনামির আশঙ্কা রয়েছে। তবে এখানে খুব তাড়াতাড়ি এই বড় ধরনের ভূমিকম্প হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
তিনি বলছেন, অতীতের নানা নথিপত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, এই অঞ্চলে ১৯৬২ সালের ২ এপ্রিল আরাকান কোস্টে প্রায় সাড়ে আট মাত্রার একটি ভূমিকম্প হয়েছিল। সে সময়কার তথ্যে জানা যায়, তখন বড় ধরনের সুনামির তৈরি হয়েছি, যা উপকূল থেকে অনেকদূর পর্যন্ত ভেতরে এসে পৌঁছেছিল। যদিও তখনকার সময়ে মানুষ কম ছিল বলে ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা হয়তো ততো বেশি হয়নি। তবে ঢাকায় নদীর পানি বেড়ে গিয়ে পাঁচশো মানুষের মৃত্যু হয়েছিল বলে জানা যায়। এরপর আর এই অঞ্চলে কোন এতো বড় ভূমিকম্প বা সুনামির তথ্য পাওয়া যায় না। আমাদের হিসাবে, একবার ভূমিকম্প হওয়ার পর ওই প্লেটে শক্তি সঞ্চয় হয়ে পরবর্তী ভূমিকম্প হতে আরো ৫০০ থেকে ৯০০ বছর লেগে যায়। সেই হিসাবে এখানে ওই প্লেটে বড় ভূমিকম্প হতে আরো দুইশো-আড়াইশো বছর বাকি আছে।
বাংলাদেশ দুইটা বড় টেকটনিক প্লেটের সংযোগস্থলে রয়েছে, যা চিটাগাং-আরাকান থেকে আন্দামানের দিকে চলে গেছে। তবে কখনো কখনো কিছু ব্যতিক্রমের ঘটনাও ঘটে বলে তিনি বলছেন। ভৌগলিকভাবে বাংলাদেশ ফানেল শেপ অবস্থায় রয়েছে অর্থাৎ বাংলাদেশ থেকে সমুদ্র দক্ষিণ দিতে প্রসারিত হয়ে গেছে।
ড. সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, আন্দামান বা ভারত মহাসাগরে যদি বড় সুনামির তৈরি হয়, ফানেল শেপ হওয়ার কারণে তার প্রভাব কিছুটা বাংলাদেশে এসেও লাগবে। যদিও সেটা হয়তো ইন্দোনেশিয়ার মতো অতোটা প্রলয়ঙ্করী হবে না। কিন্তু আগে থেকে সতর্ক না হলে তাতেও অনেক প্রাণহানি ঘটতে পারে, তিনি আশঙ্কা করছেন।
ভূমিকম্প সম্পর্কে খুব আগেভাগে সতর্ক করা সম্ভব না হলেও, যেহেতু ভূমিকম্পের পরে পানির কম্পনে সুনামির সৃষ্টি হয়, ফলে সুনামি সম্পর্কে আগেভাগে সতর্ক করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখন বিশ্বের অনেক স্থানে সুনামি সতর্কীকরণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। ফলে কোন ভূমিকম্পের ফলে সুনামির ঝুঁকি তৈরি হলে দ্রুত সতর্কতা জারি করা হয়। ফলে সমুদ্র তীরবর্তী দেশগুলো বা ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলগুলোয় সতর্কতা জারি করা হয়, যাতে সেখানকার বাসিন্দারা দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যেতে পারে।
একিউএম মাহবুব বলছেন, চীনে এখন এমন প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে যে, সুনামির ঝুঁকি দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে সবার মোবাইলে বার্তা চলে যায়, যাতে সবাই সঙ্গে সঙ্গে নিরাপদে চলে যেতে পারে। আরো অনেক দেশ সুনামির ক্ষেত্রে দ্রæত নিরাপদ করার ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু বাংলাদেশে এরকম কোন ব্যবস্থা নেই বলে বলছেন বিশেষজ্ঞরা।
অধ্যাপক একিউএম মাহবুব বলছেন, অনেক সময় বড় সুনামির ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময় পাওয়া যায়। তাই দ্রæত নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে না পারলে তখন অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যায়। ২০০৭ সালে ঘুর্ণিঝড় সিডরের সঙ্গে আসা জলোচ্ছ¡াসে অনেক মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। সুনামির ক্ষেত্রে এরকম জলোচ্ছ্বাস আরো বড় হতে পারে।
অধ্যাপক ড. একিএম মাহবুব বলছেন, আমাদের দেশে সাইক্লোন বা বন্যা মোকাবেলায় আমরা অনেক সক্ষমতা অর্জন করেছি। কিন্তু সুনামির ক্ষেত্রে তেমন কোন প্রস্তুতি এখনো আমাদের নেই।
উপকূল একেবারে নাজুক, ওয়াল অব ওয়াটার নেয়ার মতো কোন ব্যবস্থা সেখানে নেই। এমনকি যেসব সাইক্লোন সেন্টার আছে, সেগুলোও বড় সুনামি ঠেকাতে শক্ত নয়। ভবিষ্যতে সাইক্লোন সেন্টারও করার সময় সুনামির ব্যাপারটি বিবেচনায় রাখতে হবে এবং সেগুলো সেভাবে শক্ত আর উঁচু করে নির্মাণ করতে হবে।
আসলে ভূমিকম্পের জন্যই তো আমাদের এখানে যথেষ্ট প্রস্তুতি বা প্রশিক্ষণ নেই। কিন্তু ভূমিকম্প এবং সুনামি, দুইটার জন্যই সচেতনতা ও প্রশিক্ষণ থাকাটা জরুরি।
বিশেষ করে কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় মানুষজনের সচেতনতার অভাব রয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন। ফলে উপকূলীয় দেশ হওয়া সত্বেও সুনামির ভয়াবহতার জন্য পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ বা প্রস্তুতি নেই।
অধ্যাপক সৈয়দ হুমায়ুন আখতার বলছেন, আধুনিক প্রযুক্তিতে অনেক সময় একঘণ্টা আগেও সুনামির সতর্কতা বার্তা পাওয়া যায়। ফলে যেভাবে সাইক্লোন মোকাবেলায় নানা প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে, তার সঙ্গে সুনামির প্রস্তুতির ব্যাপারটিও যোগ করা উচিত। তাহলে যদি কখনো সেরকম পরিস্থিতি দেখা যায়, প্রাণহানি অন্তত এড়ানো যাবে।