বাংলাদেশ এবং তার কুলাঙ্গার সন্তানেরা

17

কামরুল হাসান বাদল

বাংলাদেশ, শেখ হাসিনা এবং তাঁর সরকার ও পরিবার নিয়ে মিথ্যা প্রচার-প্রপাগান্ডার কোনো শেষ নেই। কাতারভিত্তিক টিভি চ্যানেল আল-জাজিরা থেকে শুরু করে কনক সরওয়ারদের প্রাইভেট চ্যানেল, পিনাকী ভট্টাচার্যের লাইভ এবং দেশি-বিদেশি অনেক অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টের কথাবার্তা শুনলে মনে হয় দেশে বুঝি এখনই কোনো অভ্যুত্থান ঘটে যাবে, হাসিনার সরকার লেজ গুটিয়ে পালাবে। মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক আদালত গঠিত হওয়ার পর থেকে প্রতিদিন, প্রতিমুহূর্তে এমন সম্ভাবনার স্বপ্ন দেখলেও এবং দেখালেও তাদের মুখে ছাই দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার পরপর তিন মেয়াদ পূর্ণ করতে যাচ্ছে।
তাদের এইসব অপকর্মের কিছু কিছু নমুনা অনিচ্ছা সত্তে¡ও দেখে ফেলি কারণ গুগলে কিছু সার্চ করতে গেলে এইসব উদ্ভট খবরের লিঙ্কগুলো ভাসতে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু শিরোনামটাই পড়ি। বাকিটুকু দেখে সময়ের অপচয় করি না।
বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল দিন ২৮ ডিসেম্বর ২০২২। দক্ষিণ এশিয়ার তৃতীয় দেশ হিসেবে বাংলাদেশে চালু হল মেট্রোরেল। এদিন প্রধানমন্ত্রী যে সময় মেট্রোরেল উদ্বোধন করে মন্ত্রীপরিষদের সদস্য ও আমন্ত্রিত অতিথিদের নিয়ে প্রসন্ন হৃদয়ে ‘জয় বাংলা বাংলার জয়’ গান গেয়ে গেয়ে উত্তরা থেকে আগারগাঁও যাচ্ছিলেন সে সময়ও ষড়যন্ত্রীরা ‘শুরু হয়েছে শেখ হাসিনার দৌড়াদৌড়ি’ শিরোনামের অপপ্রচার চালিয়েই যাচ্ছিল।
আমি ভাবি মানুষ কতটা নিচে নামলে, কতটা বিকৃত মনস্ক হলে লাগাতার এমন মিথ্যা, বানোয়াট এবং দেশবিরোধী প্রপাগান্ডা চালাতে পারে। তাদের কথা মনে হয় বাংলাদেশের মানুষ দুদিন পরেই উপোসে মারা যাবে। বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে গেছে। আর বাংলাদেশ সত্যি সত্যি এমন পরিস্থিতিতে পড়লেই যেন তাদের যত লাভ। আসলে দেশের পরিস্থিতি কি সত্যি শোচনীয়? তা জানার জন্য আমাকে বিশ্বাস না করলেও চলবে।
বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা কী তা তুলে ধরতে সরকারের কড়া সমালোচক প্রথম আলোয় মঙ্গলবারে প্রকাশিত একটি সংবাদের উদ্ধৃতি দিচ্ছি, ‘২০২২ সাল কেটেছে সংকটের মধ্যে। বছরের দ্বিতীয় মাসেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। তার জেরে দেশে দেশে বাড়তে থাকে মূল্যস্ফীতির চাপ। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে যায়। কমতে থাকে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের ক্রয়াদেশ (অর্ডার)। বছরের মাঝামাঝি সময়ে দেশে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকট প্রকট হয়।
লোডশেডিংয়ের কারণে দিনের বড় একটি সময় কারখানায় উৎপাদন ব্যাহত হয়। এমনও হয়েছে, কোনো কোনো কারখানায় গ্যাসের অভাবে দিনে ১২ ঘণ্টা উৎপাদন বন্ধ ছিল।
এমন সংকটের মধ্যে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাস, অর্থাৎ গত জুলাই থেকে ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি আয় সাড়ে ১০ শতাংশ বেড়েছে। সদ্য সমাপ্ত মাস ডিসেম্বরে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫৩৭ কোটি ডলার, যা এক মাসের রপ্তানি আয়ের হিসাবে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।’
একই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘রপ্তানির মতো প্রবাসী আয়ও (রেমিট্যান্স) বাড়ছে। ডিসেম্বরে ১৭০ কোটি ডলারের প্রবাসী আয় এসেছে, যা আগের বছরের একই মাসের তুলনায় ৪ দশমিক ২৯ শতাংশ বেশি।
রপ্তানি ও প্রবাসী আয়ের এই ইতিবাচক ধারা দেশের অর্থনীতির জন্য স্বস্তিজনক। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রার মজুত নিয়ে দুশ্চিন্তা রয়েছে। এখন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত ৩ হাজার ৪০০ কোটি (৩৪ বিলিয়ন) মার্কিন ডলারের মতো, যা ২০২১ সালে ৪ হাজার ৮০০ কোটি (৪৮ বিলিয়ন) ডলার পর্যন্ত উঠেছিল। সংকটের কারণে গত মে মাস থেকে লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়ে মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ৮৬ টাকা থেকে ১০৫ টাকায় ওঠে। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় নিত্যপণ্য, শিল্পের কাঁচামাল ও অন্যান্য পণ্যের দাম। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান দুটি উৎস রপ্তানি ও প্রবাসী আয়। গত সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে এ দুটি খাত থেকে আয় কমে গিয়েছিল। তবে নভেম্বর থেকে খাত দুটি আবার ঘুরে দাঁড়ায়। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গতকাল সোমবার পণ্য রপ্তানির হালনাগাদ পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। তাতে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধ্বে (জুলাই-ডিসেম্বর) ২ হাজার ৭৩১ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। এটা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় ১০ দশমিক ৫৮ শতাংশ বেশি।
বাংলাদেশ যে সত্যি সত্যি সংকট কাটিয়ে উঠতে যাচ্ছে তার স্বপক্ষে আরও একটি রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিচ্ছি সেটিও সরকারবিরোধী পত্রিকা প্রথম আলোতে ছাপা হয়েছে গত ৫ ডিসেম্বরে। ‘ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতি হওয়ার পথে বাংলাদেশ’ শিরোনামে খবরে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশের অর্থনীতি নানাভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ভিয়েতনাম, ভারত, ইন্দোনেশিয়া ও থাইল্যান্ডের মতো দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ দ্রæতবর্ধনশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। আগামী এক-দুই দশকে এক ট্রিলিয়ন তথা এক লাখ কোটি ডলারের অর্থনীতিতে পরিণত হতে পারে এই দেশে। গত ছয় বছরে দেশের গড় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৬ দশমিক ৪ শতাংশ। সেটি যদি ৫ শতাংশেও নামে, তাতেও ২০৪০ সালের মধ্যেই এক ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির মাইলফলক স্পর্শ করবে বাংলাদেশ। আর প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশ হলে ২০৩০ সালেই সেখানে পৌঁছানো সম্ভব।
বিপুল ভোক্তাশ্রেণি ও তরুণ জনগোষ্ঠী, উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের দ্রæততর বিকাশ এসবের বদৌলতে একের পর এক অর্থনৈতিক সফলতা পাচ্ছে বাংলাদেশ। এখন বলা হচ্ছে, দেশের ভবিষ্যৎ অগ্রযাত্রায় মূল চালিকা শক্তি হবে বেসরকারি খাত। এখান থেকে উদীয়মান চ্যাম্পিয়নরা তৈরি হচ্ছে। তাঁরা বৈশ্বিকভাবে ছড়িয়ে পড়ছেন। সমাজেও তাঁদের প্রভাব আছে।’
‘উচ্চমাত্রায় অর্থনৈতিক স্থিতিস্থাপকতা, মানুষের ঘুরে দাঁড়ানোর সক্ষমতা, ডিজিটাল ব্যবস্থায় অগ্রগতি, বেসরকারি খাতের দ্রæততর বিকাশ’- এই যে কারণগুলো চিহ্নিত করা হল তা কীভাবে এবং কাদের দ্বারা সম্ভব হল? নিশ্চয়ই সরকারের। সরকার এসব বিষয়ে বিচক্ষণতা দেখিয়েছিল বলেই তো অসম্ভব সম্ভব হয়ে উঠছে বাংলাদেশে। সুশাসন যদি না-ই থাকল তাহলে এই উত্তরণ সম্ভব হলো কী করে ? সুশাসন মানে কি দেশে জঙ্গি ও উগ্রবাদী আর তাদের লালনপালনকারীদের অবাধে রাজনীতির নামে ধ্বংসলীলা চলতে দেওয়া? দেশকে মৌলবাদী, সা¤প্রদায়িক শক্তির হাতে তুলে দেওয়া? এতসব অগ্রগতির পরও অনেকের চোখে ঘুম নেই। গণতন্ত্র নেই, মানবাধিকার নেই, জবাবদিহি নেই, সুশাসন নেই বলে বলে গলা ফাটিয়ে ফেলেছেন অনেকে।
পক্ষে বলা যদি দালালি হয় তাহলে আমি বাংলাদেশের একজন নির্ভেজাল দালাল। বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, কার্পণ্য নেই। শুধু আমি নই বাংলাদেশকে যারা মা ভাবেন তারাও তাই করবেন। কারণ বাংলাদেশ ভালো না থাকলে আমি এবং তারাও ভালো থাকেন না। অনেক আগে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লিখেছিলেন ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি’। তাই বাংলাদেশের মুখটি মলিন হলে আমার মতো তার কোটি সন্তানের চোখ জলে ভাসে।
ভাবি দেশের মুখ মলিন কেন হবে না? তার কোটি কোটি সন্তান যে রুগ্ন, অসুস্থ। ওরা শারীরিকভাবে অসুস্থ, ওরা মানসিকভাবে অসুস্থ। এত এত অসুস্থ সন্তান নিয়ে সে কী করবে । তার মুখ মলিন না হয়ে উজ্জ্বল হবে কী করে। মুখ মলিন হওয়ার কত কাজই না করছে তার সন্তানেরা।
দেশের উন্নয়নে অনেকের গাত্রদাহ হয়। তারা সে উন্নয়ন ঠেকাতে চায়। তারা উন্নয়নবিরোধী প্রচার প্রপাগান্ডা ছড়ায়। তারা গুজব ছড়ায়, আতঙ্ক ও ভীতি ছড়ায়।
এই দেশের কিছু সন্তানের ভÐামি, প্রতারণা দেখতে দেখতে আমি জানি বাংলাদেশ তুমি লজ্জিত হও কেন তাদের জন্ম দিয়েছিলে। লজ্জিত হওয়ার কথাই তো। তোমার স্বাধীনতার জন্য। তোমার সম্ভ্রম ও সম্মানের জন্য তোমার প্রায় ত্রিশ লাখ সন্তান জীবন দিয়েছে। তোমার কন্যাদের সম্ভ্রম হানি হয়েছে। তোমার বুক থেকে অন্যায়, অবিচার, স্বৈরতন্ত্র, মৌলবাদ দূর করতে তোমার কত শত সন্তান জীবন দিয়েছে। আমি জানি তুমি তাদের আত্মত্যাগের কথা ভেবে গর্বিত হও আর ভেবে পাও না তুমি দু’ধরনের সন্তান কীভাবে জন্ম দিয়েছিলে। একদিকে একদল সন্তান তোমাকে রক্ষার জন্য প্রাণ দেয় আরেকদিকে আরেক দল কুলাঙ্গার সন্তান তোমাকে খুবলে খেয়ে দেয়ে মাকড়সার মতো ঝুলিয়ে দিতে চায়।
ওরা প্রকৃত বাংলাদেশ চায় না। ওরা চায় পাকিস্তানের প্রদেশ।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট