বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ : প্রতিষ্ঠার ইতিকথা

380

স্বাধীনতা পরবর্তী একদিকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিপুণ ও দায়িত্বশীল নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বন্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজ চলছে , অন্যদিকে জাসদ কর্তৃক সারা দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির তৎপরতা অব্যাহত রাখে। সদ্য স্বাধীন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি যখন এমনি ঘোলাটে অবস্থায়; তখন মুক্তিযুদ্ধের চেতনাধারী তরুণ ও যুবসমাজের বিভ্রান্তি দূর করতে এবং যুবসমাজ যেন হতাশাগ্রস্ত হয়ে না পড়ে; সে লক্ষ্যে দেশে পরিশীলিত মুক্তচিন্তার একটি যুব সংগঠন তৈরি আবশ্যকতা প্রতীয়মান হয় জাতির জনকের কাছে। যদিও মহান মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, তোফায়েল আহমদ, শাহজাহান সিরাজ, আ স ম আবদুর রব থাকলেও তাদের নেতৃত্বে দেশের যুবসমাজ পাক হায়েনাদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধ করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। জানা যায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই সাবেক ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান ছাত্র ও যুবশক্তির বড় একটি অংশকে আওয়ামী রাজনীতির মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করার হীন উদ্দেশ্যে গোপন একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের পর সিরাজুল আলম খান ক্ষমতা দখলের হীন পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে ভিন্ন মতাদর্শে এ দেশের কিছুসংখ্যক যুবসমাজকে সংগঠিত করেন। এরই অংশ হিসেবে সদ্য স্বাধীন দেশে ১৯৭২ সালের ৩১ অক্টোবর জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ’ নামের একটি সংগঠনের আত্মপ্রকাশ হয়। শুরুতে আ স ম আবদুর রবের নেতৃত্বে যুব সংগঠন করার চিন্তা-ভাবনা থাকলেও সিরাজুল আলম খানের ফর্মুলায় পরবর্তীতে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল ‘জাসদ’ গঠন করে দেশের যুবসমাজের একটা অংশকে আওয়ামী লীগের মূলধারার রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন করার কার্যক্রম শুরু হয়।
এ অবস্থায় বঙ্গবন্ধু একদিন শেখ মনিকে বলেন, ছাত্রজীবন পেরিয়েছে অথচ যৌবন পেরোয়নি এরকম বহু যুবক এখন আদর্শহীন, লক্ষ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। এখন অলস ও অকর্মণ্য জীবনে লক্ষ্যহীন হয়ে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। নানা উচ্ছৃঙ্খল কাজে জড়িত হচ্ছে। এদের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে দেশ ও জাতি গঠনের কাজে লাগাতে পারলে একটি যুবশক্তি তৈরি হবে, যে শক্তির ভেতর থেকে দেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব বেরিয়ে আসবে। দেশ ও সমাজের ভবিষ্যতের রূপকার এই যুবসমাজ।
বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে শেখ ফজলুল হক মনি যুবলীগ গঠন করেন এবং অল্পদিনের মধ্যে যুবলীগ একটি শক্তিশালী যুব প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মহান মুক্তিযুদ্ধে মুজিব বাহিনীর অন্যতম সংগঠক, দেশখ্যাত সাংবাদিক শেখ ফজলুল হক মনি স্বচ্ছ রাজনৈতিক কর্মপরিধিতে যুবসমাজের অংশগ্রহণের ব্রত নিয়ে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর দেশের প্রথম যুব সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেন। মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত ও মুজিব ভাবাদর্শের সংগঠন আওয়ামী যুবলীগ আন্দোলন-সংগ্রামের সিঁড়ি বেয়ে বর্তমানে উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ যুব সংগঠন হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের বুলেটে শহীদ হন এই কালজয়ী নেতা। বাঙালি জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র এই তিনটি মতাদর্শের উপর ভিত্তি করে গঠিত হয় যুবলীগ। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা অর্থাৎ সকল ধমের্র মানুষের স্ব স্ব ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার তথা জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা স¤প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসা¤প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনিভর্রশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং যুবসমাজের ন্যায্য অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এদেশের যুব আন্দোলনের পথিকৃৎ শহীদ শেখ ফজলুল হক মনি বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে যুবলীগ নেতাকর্মীরা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও দেশগড়ার কাজে আত্মনিয়োগের পাশাপাশি অপশক্তির অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে রাজপথে সোচ্চার ছিলো। যুবলীগের অনেক কর্মী বুকের তাজা রক্ত দিয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদে রুখে দাঁড়ায়। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার প্রতিবাদে আন্দোলন করতে গিয়ে বগুড়ায় যুবলীগ নেতা আব্দুল খালেক খসরু, চট্টগ্রামে যুবলীগ নেতা মৌলভী ছৈয়দ আহমদ নির্মম হত্যাকাÐের শিকার হন। ১৯৮৭ সালের ১০ নভেম্বর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে যুবলীগ নেতা নূর হোসেনের তাজা রক্তের ঋণ শোধ করার মধ্য দিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয় স্বৈরশাসক এরশাদ। এছাড়া ১৯৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে যুবলীগের অনবদ্য ভূমিকা, ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট জোট সরকারের সরাসরি মদদে তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী, দেশরত্ন শেখ হাসিনার প্রাণনাশের উদ্দেশ্যে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার প্রতিবাদে যুবলীগ ছিলো সোচ্চার, অপ্রতিরোধ্য।
২০০৫ সালের লগি-বৈঠা আন্দোলন, ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিরোধী আন্দোলনসহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আওয়ামী যুবলীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। ১/১১ এর প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা কারান্তরীণ হলে তার মুক্তির আন্দোলনে গ্রেফতার হয়ে কারা নির্যাতনের শিকার হয় শত-সহস্র যুবলীগ নেতা কর্মী। ২০০৮ সালে ভোট বিপ্লবের অগ্রভাগে আওয়ামী যুবলীগের অসামান্য অবদান রয়েছে। যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত আসামিদের বিচারকার্য সম্পন্ন এবং ২০১৩ সালের ৫ এবং ৬ মে হেফাজতের ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা প্রতিরোধে আওয়ামী লীগ সরকারের নিরবচ্ছিন্ন ছায়াসঙ্গি হিসাবেও যুবলীগ রাজপথে সংগ্রাম অব্যাহত রাখে।
জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে যুবলীগের নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়। ৪৭ বছরে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে এ পর্যন্ত সাতটি কংগ্রেস অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের জাতীয় নেতৃত্বের পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় কংগ্রেসে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মনি চেয়ারম্যান ও এডভোকেট সৈয়দ আহমদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৭৮ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় কংগ্রেসে আমির হোসেন আমু চেয়ারম্যান ও ফকির আব্দুর রাজ্জাক সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় কংগ্রেসে মোস্তফা মহসীন মন্টু চেয়ারম্যান ও ফুলু সরকার সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে অনুষ্ঠিত চতুর্থ কংগ্রেসে শেখ ফজলুল করিম সেলিম চেয়ারম্যান ও কাজী ইকবাল হোসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ২০০৩ সালে পঞ্চম কংগ্রেসে এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক চেয়ারম্যান ও মীর্জা আজম সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এই কংগ্রেসের পর ২০০৯ সালে এডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মনোনীত হলে মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান এর দায়িত্ব পালন করেন। ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত ষষ্ঠ জাতীয় কংগ্রেসে মোহাম্মদ ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান ও মোঃ হারুনুর রশীদ সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়। ২০১৯ সালে নভেম্বর মাসে সর্বশেষ ৭ম জাতীয় কংগ্রেসে শহীদ শেখ ফজলুল হক মনির বড় ছেলে অধ্যাপক শেখ ফজলে শামস পরশ চেয়ারম্যান ও মাইনুল হোসেন খান নিখিল সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। যে সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব শেখ ফজলুল হক মনি, সময়ে অসময়ে সেই সংগঠন নানা সময়ে নানা কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হলেও বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরতœ শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি বারবার এগিয়ে নিয়েছে সংগঠনকে। এই যুবলীগ দেশের কল্যাণে, আওয়ামী লীগের কল্যাণে কাজ করবেই। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী যুবলীগকে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বা অঙ্গ সংগঠন হিসেবে গণ্য করা হয়ে থাকে। সে হিসেবে মানব দেহের একটি অঙ্গ নষ্ট হয়ে গেলে সমগ্র দেহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তেমনি আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন বা সহযোগী সংগঠন হিসেবে যুবলীগের মধ্যে যদি পচন ধরে, আওয়ামী লীগ তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হতে বাধ্য। আগামীতে সংগঠনের ভাবমূর্তির সংকট কাটিয়ে উঠে যুবলীগকে বাংলার প্রতিশ্রুত ও প্রগতিশীল নির্ভীকদের যুব ঠিকানা হিসাবে কেন্দ্র পর্যন্ত তৃণমূল অবধি প্রতিষ্ঠিত করবে এটাই প্রত্যাশা।

লেখক : সাবেক ছাত্রনেতা ও সংগঠক