বাংলাদেশে কোরিয়ান ভাষা শেখার এত আগ্রহ কেন?

37

ইদানীং রাস্তার পাশে দেয়ালে সাঁটা পোষ্টারে হরহামেশাই দেখা যায় ‘কোরিয়ান ভাষা শিখুন’ এমন বিজ্ঞাপন। সরকারিভাবেও ইদানীং বিদেশি ভাষা শেখানোর ক্ষেত্রে এই ভাষাটিকে বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। দেশের প্রায় সকল জেলায় সরকারি কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে এই ভাষা শেখানো হচ্ছে। এর বাইরে গড়ে উঠেছে অসংখ্য বেসরকারি কোরিয়ান ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র।
ঢাকার দারুস সালামে বাংলাদেশ-কোরিয়া কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেলো, কয়েকটি শ্রেণীকক্ষে কোরিয়ান ভাষার পাঠদান চলছে। একটি কক্ষে প্রশিক্ষণ নিতে আসা সবাই এক এক করে সামনে আসছেন, আর ব্ল্যাকবোর্ডে লেখা বর্ণমালা উঁচু গলায় পড়ে শোনাচ্ছেন।
কোরিয়ান ভাষায় নামসহ নিজের পরিচয় দিচ্ছিলেন এক শিক্ষার্থী। কিছুটা ঠাট্টা করে বেশ আগ্রহ নিয়ে শিখেছেন ‘আমি তোমাকে ভালোবাসি’ এটুকু বলা।কিন্তু ক্লাসরুম ভর্তি সব শিক্ষার্থীর এই ভাষা শিখতে আসার নানা রকম কারণ রয়েছে।
ঢাকা থেকে অনেক দূরের মাগুরা থেকে দুই মাসের কোর্স করতে এসেছেন কলেজ পড়ুয়া ছাত্রী শাহিনা পারভিন। তিনি বলছেন, ‘আমি আসলে কোরিয়ায় পড়াশুনা করতে চাই। ঐ ভাষার ওপরেই কোন পড়াশোনা।’
তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম ফরাসি, জার্মান বা রুশ ভাষা এরকম অনেক ভাষা রয়েছে। কিন্তু কেন তিনি কোরিয়ান ভাষা শিখেছেন? তিনি বলছেন, ‘কোরিয়ান ভাষা সম্পর্কে আমি আমার জেলায় অনেক সার্কুলার দেখেছি। পরিচিতদের কাছে শুনে আমার আগ্রহ তৈরি হয়েছে।’
মোহাম্মদ আবু জাহের ইলেকট্রনিক্স সামগ্রী আমদানির ব্যবসা করেন। বছরে বেশ ক’বার তাকে কোরিয়া যেতে হয়। তিনি বলছিলেন, তার ব্যবসায়িক পার্টনারদের সাথে কাজের সুবিধার জন্য তিনি নিজেই ভাষাটি শিখে নিচ্ছেন।
তিনি বলছেন, ‘ওরা ইংলিশ ভাষায় অতটা পারদর্শী না। কোরিয়ান ভাষাটা শিখে ওদের সাথে যাতে ঠিকমতো কথা বলতে পারি এবং ব্যবসায়িক লেনদেনের ব্যাপারটি যাতে ভালভাবে ডিলিং করতে পারি- সেজন্য শিখছি।’
এরকম নানা কারণের মধ্যে ইদানীং কোরিয়াতে পড়াশুনায় আগ্রহ যেমন বেড়েছে, তেমনি আবু জাহেরের মতো ব্যবসায়ীরাও কেউ কেউ ভাষাটি শিখছেন। বাংলাদেশে ইপিজেডে কোরিয়ানদের কারখানায় অথবা অন্যান্য কোরিয়ান প্রতিষ্ঠানেও এই ভাষা জানা থাকলে দেয়া হচ্ছে অগ্রাধিকার।
কিন্তু প্রতি বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়ের এই ভাষা শেখার আগ্রহের সবচাইতে বড় কারণ হলো : দক্ষিণ কোরিয়াতে চাকরী করতে যাওয়া, যেমনটা বলছেন ইডেন কলেজের ছাত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস।
তিনি বলছেন, ‘সরকারিভাবে যাওয়াতে মেয়েদের জন্য একটা সেফটি আছে। অবশ্যই আর্থিক একটা ব্যাপার তো থাকেই। যেহেতু গভর্নমেন্ট টু গভর্নমেন্ট। সেভাবে গেলে আর্থিক অতটা চাপ পড়েনা। যেতে যতটুকু খরচ হচ্ছে-সেই তুলনায় অনেক বেশি আয় করা যাচ্ছে।’
২০০৮ সাল থেকে দুই দেশের সরকারের মধ্যে বিশেষ চুক্তির আওতায় লটারির মাধ্যমে দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন কারখানায় কাজ করতে শ্রমিক নেয়া হচ্ছে। গত বছর লটারিতে দক্ষিণ কোরিয়া যাওয়ার সুযোগ মিলেছে মোটে আড়াই হাজারের মতো ব্যক্তির।
কিন্তু লটারি পর্যন্ত যেতে অনলাইনে আবেদন পড়েছে লাখ দেড়েক। যাদের সবাইকে আবেদনের পূর্বশর্ত হিসেবে এই ভাষা অবশ্যই শিখতে হচ্ছে। সরাসরি কোরিয়ানদের কাছেই তাদের ভাষার পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। এবছর বাংলাদেশীদের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কোটা দ্বিগুণ হতে পারে।
প্রায় দশ বছর ধরে কোরিয়ান ভাষা শেখান এমদাদ হোসেন মিথুন। তিনি বলছেন, ‘আমি যখন শুরু করেছিলাম, তখন সবাই মনে করতো কোরিয়া বোধহয় বাংলাদেশের মতোই অনুন্নত একটি দেশ। আমি যখন যাচ্ছিলাম আমাকে বলেছিল কোরিয়া গিয়ে কি করবা? কিন্তু সরকারিভাবে কম পয়সায় গিয়ে কাজের সুযোগের কারণে এখন অনেকেই জানে। আগ্রহটাও অনেক বাড়ছে।’সরকারিভাবে কোরিয়া যেতে খরচ আশি হাজারের মতো। এই ভাষা শিখতে খরচ দুই মাসের কোর্সে বারোশ’ টাকা। বেসরকারিভাবে চার থেকে পাঁচ মাসের কোর্স ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো। তবে বেসরকারি কেন্দ্রগুলো প্রাথমিক পর্যায়ের ভাষা ছাড়াও আরও বাড়তি কিছু শেখায়। শুধু বলতে অথবা পড়তে ও লিখতে শেখা, এরকম নানা ধাপের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। শিক্ষার্থী আকর্ষণ করতে অনেক কেন্দ্র বিনা পয়সায় দুই একটি ক্লাস করার সুযোগ দেয়। এত আগ্রহের কারণে প্রতারণার সুযোগও বাড়ছে ইদানীং। কিন্তু তবুও আশা নিয়ে প্রতি বছর কোরিয়ান ভাষা শেখার দিকে ঝুঁকছেন অনেকেই।