বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্ব জনমত এবং একজন অঁদ্রে মারলো

163

১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় বাংলাদেশের মানুষের দুঃসময়ে যে দেশটি সর্বপ্রথম মানবতার হাত প্রসারিত করে, সেটি হলো আমাদের প্রতিবেশি দেশ ভারত। দেশটি ২৫ মার্চের বর্বরতা, দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল তা বিশ্ববাসীর নিকট সার্থকভাবে তুলে ধরে। ভারতেন জনগণ ও সরকার প্রায় এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দেয়। এসব দেশহারা মানুষকে মাথা গোঁজার ঠাঁই দিয়ে, দুমুঠো খাবারের ব্যবস্থা করে, জামা-কাপড় ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করে মানবতার ইতিহাসে এক অনন্য নজির স্থাপন করে। শুধু তাই নয় দেশটি হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করে। সর্বোপরি ভারত বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে একটি নতুন দেশের অভ্যুদয়কে অবশ্যম্ভাবী করে তোলে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে। খ্যাতনামা লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এই যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রায় দেড় হাজার সৈনিক প্রাণ দিয়েছিল। ( মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, প্রতীতি, ঢাকা, ২০০৮, পৃষ্ঠা-১৫)
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের পর সর্বাধিক ভূমিকা রাখে সোভিয়েত ইউনিয়ন- বর্তমান রাশিয়া। বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন বন্ধ এবং জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য ইয়াহিয়া খানকে অনুরোধ জানান তখনকার সোভিয়েত রাষ্ট্রপ্রধান নিকোলাই পদগর্নি। তিনি ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল বাংলাদেশের মানুষের ওপর পৈশাচিক নির্যাতন বন্ধ, নির্বাচনে নিরঙ্কুশ বিজয়ী দলকে কেন সরকার গঠন করতে দেয়া হবে না তা জানতে চেয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি পত্র লিখেন। তখনকার অন্যতম পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নে এই পত্রে ইয়াহিয়া খান বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন। ইতিহাসে এটি পদগর্নি পত্র: হিসেবে খ্যাত হয়ে আছে। সোভিয়েত প্রচার মাধ্যমগুলো বাংলাদেশে হানাদারদের নির্যাতনের কাহিনি ও মুক্তিকামী মানুষের বীরোচিত প্রতিরোধের কথা তুলে ধরে বিশ্ব জনমত সৃষ্টিতে সহায়তা করে। জাতিসংঘে সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের পক্ষে রাখে জোরালো ভূমিকা। দেশটি পাকিস্তানের যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাবে ভেটো দিয়ে বাংলাদেশেন মুক্তিযুদ্ধে প্রাণের সঞ্চার করে। সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বে কিউবা, যুগোশ্লাভিয়া পোলান্ড, হাঙ্গেরি, বুলগেরিয়া, চেকস্তেভাকিয়া, পূর্ব জার্মানিসহ তখনকার সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো বাংলাদেশের স্বাধীনতা স্ংগ্রামের পক্ষে অকুণ্ঠ সমর্থন ব্যক্ত করে।
ব্রিটেনের প্রচার মাধ্যম-বিবিসি এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা বাঙালিদের ওপর হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক নির্যাতন এবং মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি সম্পর্কে বিশ্ব জনমতকে জাগ্রত করে তোলে। লন্ডন ছিল বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে প্রচারের প্রধান কেন্দ্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটিশ গণমাধ্যমের প্রতিটি সংবাদ ছিল স্বাধীকারকামী মানুষের জন্য অতুল প্রেরণার উৎস। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরুর পর পর ৩১ মার্চ ‘ গার্ডিয়ান পত্রিকা প্রকাশ করে ম্যাসাকার ইন পাকিস্তান শিরোনামে সংবাদ। ২ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে নিউ স্টেটসম্যান প্রকাশ করে হৃদয়ছোঁয়া সংবাদ উইপ ফর বাংলাদেশ (বাংলাদেশের জন্য কাঁদো) শিরোনামে সংবাদ। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের পুরোটা সময়জুড়ে ব্রিটিশ গণমাধ্যমগুলো বাংলাদেশের মানুষকে সহানুভূতি জানানোর পাশাপাশি জুগিয়েছে অফুরান প্রেরণা ও সাহস। ব্রিটেন ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া, পশ্চিম জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, জাপান ও কানাডার প্রচার মাধ্যম বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে অবদান রাখে। ইরাক ও মিসর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জানায়। মিসরের মিডিয়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণের পক্ষে সোচ্চার ছিল। কায়রোর আধাসরকারি সংবাদপত্র আল আহরাম এর সম্পাদক ছিলেন ড. ক্লোভিস মাসুদ। তিনি তাঁর পত্রিকায় বিভিন্ন প্রতিবেদনের মাধ্যমে ভারত থেকে শরণার্থীদের নিরাপদ এবং নিঃশর্তভাবে দেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা নিতে আন্তর্জাতিক স¤প্রদায়ের প্রতি আহŸান জানান। একমাত্র মুসলিম দেশ সৌদিআরব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কোনো সমর্থন জানায়নি। দেশটি হানাদার বাহিনীর পক্ষ নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী মানুষের আত্মদানকে কোনো মূল্যই দেয়নি। এমনকি দেশটি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর।
সারা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের মানুষের প্রাণের চেয়ে প্রিয় স্বাধীনতাকে সমর্থন জানালেও দুই পরাশক্তি-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীন বাংলাদেশ নামক নতুন সূর্য অভ্যুদয়ের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের নির্লজ্জ পাকিস্তান প্রীতির পরিচয় দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বাংলাদেশের বিরুদ্ধে সরাসরি অবস্থান নিলেও মার্কিন জনগণ, শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রচার মাধ্যম এবং কংগ্রেসের অনেক সদস্য এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে সোচ্চার ছিল। পÐিত রবিশংকর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আর্থিক সহযোগিতার জন্য আয়োজন করেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে আয়োজিত এ কনসার্টে ৪০,০০০ দর্শকের উপস্থিতিতে জর্জ হ্যারিসন, বব ডিলানসহ বিশখ্যাত শিল্পীরা অংশগ্রহণ করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের মানুষের পাশাপাশি বিদেশি অনেক ব্যক্তি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের আন্তরিক ও দায়িত্বশীল ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হয়। তেমনি একজন বিদেশি বন্ধুর নাম অঁদ্রে মারলো। ফরাসি কলম সৈনিক ও চিন্তাবিদ অঁদ্রে মারলোকে ভারতীয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে ১৯৭১ সালের ১৮- ২০ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিতব্য একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদানের আহŸান জানিয়েছিলেন। অঁদ্রে মারলো সভার মাধ্যমে স্বাধীনতা পাওয়া যাবে বলে মনে করলেন না। তাই তিনি সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে জয়প্রকাশকে বললেন, সম্মেলনে আলাপ আলোচনা হবে, প্রবন্ধের উপাদান জন্ম নেবে, কিন্তু পাকিস্তানি ট্যাংকগুলো ততক্ষণে আরও বহুদূর এগিয়ে যাবে। বাংলাদেশের পক্ষে সেই বুদ্ধিজীবীরাই কথা বলার অধিকার রাখেন যাঁরা বাংলাদেশের জন্য যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। আমি মুক্তিবাহিনীর অধীন একটি দল পরিচালনার অনুমতি চাই। (ফরাসি লেখকের প্রতিবাদী কণ্ঠ, প্রথমা প্রকাশন, নভেম্বর ২০১৮, পৃষ্ঠা -৯১) ৬৯ বছর বয়সী ফরাসি লেখক ও সাবেক মন্ত্রী স্বাধীনতাকামী মানুষের বিরুদ্ধে মার্কিন সপ্তম নৌবহর পাঠানোর খবরে ক্ষোভ প্রকাশ করে তখনকার মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিটি ছাপা হয়েছিল ফ্রান্সের লা ফিগারো’ পত্রিকায় ১৮ ডিসেম্বর। মারলো সেই চিঠিতে লিখেছিলেন, আপনার বিমানবাহী রণতরী কলকাতাকে বিপন্ন করতে পারে, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ওখানকার মৃত্যুমুখী শরণার্থী মানবগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারন করতে পারে না। পৃথিবীর সবচেয়ে পরাক্রমশালী সেনাবাহিনী যদি নগ্নপদ ভিয়েতনামীদের গুঁড়িয়ে দিতে না পারে, আপনি কি বিশ্বাস করেন ইসলামাবাদের সেনাবাহিনী ১৮০০ কিলোমিটার দূর থেকে স্বাধীনতায় উদ্দীপ্ত একটি দেশকে আবার দখল করতে পারবে? পৃথিবীর ভাগ্য যখন ঝুঁকির মুখে তখন বঙ্গোপসাগরে বিমানবাহী রণতরী পাঠানো কোনো নীতি নয়, অতীতের ধ্বংসাবশেষ মাত্র। ( পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা -৯৬)
আন্তর্জাতিক সেনাদল গঠন করে অঁদ্রে মারলো শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি। ততদিনে মুক্তিকামী মানুষের বিজয় সুনিশ্চিত হয়ে যায়। তবে তিনি তাঁর দৃঢ় ইচ্ছার কথা জানিয়ে সারা পৃথিবীজুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে যে জনমত সৃষ্টি করেন তা বাংলাদেশের মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে। ১৯৭৩ সালে মারলো বাংলাদেশ সফরে এসে ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও কাপ্তাই ভ্রমণ করেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট এবং বাংলাদেশ সরকার ‘ মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায় ভূষিত করে। মারলোর মতো বিদেশি বন্ধু যাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন বাঙালি জাতি তাঁদের অবদানের কথা কোনোদিন ভুলবে না।

লেখক : শিশুসাহিত্যিক ও কলামিস্ট