বাংলাদেশের স্থানিক নাম ও ‘ভাঙ্গা’ উপজেলার নাম পরিবর্তন প্রসঙ্গে

10

প্রফেসর ড. গোলাম কিবরিয়া ভূইয়া

পৃথিবীর বহুদেশেই এমন কিছু স্থান নাম রয়েছে যেগুলোর মাধ্যমে স্থানটির নামের উৎস সহজেই অনুধাবন করা যায়। অষ্ট্রেলিয়ার একটি শহর আছে যেটির নাম হলো ‘ডারউইন’। নামটি দিয়ে সহজেই ধারণা করা যায় যে এটি চার্লস ডারউইনের নাম থেকে এসেছে, যিনি বিবর্তনবাদের জনক হিসেবে সারা পৃথিবীতে পরিচিত। এছাড়া রয়েছে লিভিঙস্টোন নামের শহর, আছে পোর্ট আর্থার ইত্যাদি নামের শহর-বন্দর। ভারতীয় উপমহাদেশে বহু স্থান নাম রয়েছে যেগুলো ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, রাজনৈতিক নেতা অথবা অন্য কোন বিশিষ্টজনদের নামকে ভিত্তি করে রয়েছে। ভারতে ঋষি অরবিন্দের আশ্রম রয়েছে পন্ডিচেরিতে। এই আশ্রমকে ঘিরে যে শহর গড়ে উঠেছে সিটির নাম অরবিন্দের নামে থেকে নেয়া হয়েছে। শহরটির নাম ‘অরুভিল’। রয়েছে গান্ধীনগর, শহাজাহানাবাদ, অওরঙ্গাবাদ, মূর্শিদাবাদ, মকসুদাবাদ ইত্যাদি নামের শহর। পাকিস্তানের লায়ালপুর শহরের নাম সৌদি বাদশাহ ফয়সলের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে রাখা হয়েছে ফয়সালাবাদ। লিবিয়ার নেতা গাদ্দাফির নামে লাহোর স্টেডিয়ামের নাম রাখা হয়েছে গাদ্দাফি স্টেডিয়াম, রয়েছে কলকাতার ইডেন গার্ডেন। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে ইতিহাসে বিশিষ্ট অথবা বিখ্যাত ব্যাক্তিদের নামে শহর জনপদের নাম যৌক্তিক কারণেই নামকরণ করা হয়।
বাংলাদেশের স্থান নামগুলোতেও ইতিহাসের সাক্ষী অথবা উদাহরণ লক্ষ করা যায়। মধ্যযুগে অথবা মোগল শাসনে থাকা অঞ্চল, শহর, মসজিদ ইত্যাদি সে সময়ের শাসক অথবা সুলতানদের নামে রয়েছে। ঢাকা শহরের নাম রাখা হয়েছিল জাহাঙ্গীর নগর। সিলেট শহরের অপর নাম জালালাবাদ, চট্টগ্রাম শহরের অন্য নাম ইসলামাবাদ। ময়মনসিংহের অপর নাম হলো মোমেনশাহী। শহরের রাস্তা বা সড়ক, বাজার ইত্যাদি নামগুলোর বহলাংশই স্থানীয় বিশিস্টদের নামে হয়ে থাকে। উদাহরণ হিসেবে চট্টগ্রামের ফিরিঙ্গি (পর্তুগীজ) বাজার, মোগলটুলি (মোঘলদের), নসরত শাহ্ মসজিদ, পার্সিভাল হিল, গুড্স হিল, ফৌজদার হাট ইত্যাদি। আবার ঢাকা শহরে মোগল ও বৃটিশ যুগের সড়ক ও নানা ঐতিহাসিক স্থাপনার নাম রয়েছে। বখশিবাজার, মোগলটুলি, আরমানি (আর্মেনীয়) টোলা, রেঙ্কিন স্ট্রিট, জনসন রোড, ফুলার রোড, কার্জন হল, বাহাদুর শাহ পার্ক ইত্যাদি। বর্তমান বাংলাদেশের রেলওয়ের কিছু ট্রেনের নাম ইতিহাস খ্যাত ব্যক্তি বা দূর্গের নামে রয়েছে। যেমন- ঈসা খাঁ এক্সপ্রেস, এগারসিন্ধুর এক্সপ্রেস, জালালাবাদ এক্সপ্রেস ইত্যাদি। নদীর নামেও কিছু ট্রেনের নাম রয়েছে। তিস্তা, করতোয়া, কর্ণফুলী, সুরমা, মেঘনা ইত্যাদি নদ-নদীর নামে ট্রেন রয়েছে। সুতরাং অর্থবোধক নাম যে কোন স্থানের নামকরণের জন্য যৌক্তিক। এক্ষেত্রে বিশেষ কোন স্থানের জন্য তা আরো বেশি জরুরী ও আবশ্যক। সাম্প্রতিক সময়ে কিছু গ্রামের নাম শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে পরিবর্তন করা হয়েছে। অতি সম্প্রতি পরিবর্তিত হয়েছে ‘চোরের ভিটা’ নামটি। এই নামের একটি গ্রামে ছিল একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়। যৌক্তিক কারণেই তা করা হয়েছে। ঊনিশ শতকের ধর্মীয়-সামাজিক আন্দোলন হিসেবে ফরায়েজী আন্দোলন ছিল বৃহত্তর ফরিদপুরে। হাজী শরীয়তুল্লাহ এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন। তাঁর নামে শরিয়তপুর জেলার নামকরণ করা হয়েছে।
বর্তমানে পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার পর ফরিদপুরের ‘ভাঙ্গা’ উপজেলা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু থেকে চারলেনের মহাসড়ক ‘ভাঙ্গা’ হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলোতে গিয়েছে। অতিসম্প্রতি রেল-পথ‘ভাঙ্গা’ পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশের যোগাযোগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে ‘ভাঙ্গা’ নামটি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এই নামটি পরিবর্তন করে অর্থবোধক কোন নাম দেয়া আবশ্যক। ‘ভাঙ্গা’ নামটি কখনো ইতিবাচক ও গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। তাই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেবেন এটা প্রত্যাশিত।
লেখক: সিনেট সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়