বাংলাদেশের অর্থনীতি ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ

15

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য

অর্থনীতির জটিল বিষয়গুলো অনেক সময় সাধারণ মানুষের পক্ষে বুঝা সম্ভব নয়। তবে এটাও ঠিক যে, অর্থনীতির নীতিগত তত্ত্ব দিয়ে সঠিকভাবে অর্থনীতি চালানোও সম্ভব নয়। কারণ অর্থনীতির সকল তত্ত¡ মানুষের আচরণ, অভ্যাস এবং মনমানসিকতার ওপর নির্ভরশীল। যেহেতু মানুষের আচরণ অভ্যাস, মনমানসিকতাও সময়ের পরিবর্তনের সাথে সাথে পরিবর্তন হয়ে যায় সেহেতু অর্থনীতির ক্লাসিক্যাল তত্ত¡গুলোকেও পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। পুরানো তত্ত¡ দিয়ে নতুন অর্থনীতিকে পরিচালনা করা সম্ভব হয় না।
আবার অর্থনীতি পর্যালোচনা করার সুবিধার্থে অর্থনীতিকে কয়েকটি খাতে ভাগ করা হয়েছে। যেমন- শিল্পখাত, কৃষিখাত, আমদানি খাত, রপ্তানি খাত, আর্থিক খাত ইত্যাদি। এরূপ প্রতিটি খাতকে অর্থনীতিতে পৃথক পৃথকভাবে আলোচনা করা হয়। শিল্পখাতকে নিয়ে ব্যাপকভাবে আলোচনা করে শিল্প অর্থনীতি, কৃষিকে নিয়ে আলোচনা করে কৃষি অর্থনীতি, আমদানি ও রপ্তানি খাতকে আলোচনা করে আন্তর্জাতিক অর্থনীতি। নির্দিষ্ট সময়ের আমদানি ও রপ্তানি খাতের একটি পরিপূর্ণ হিসাব পাওয়ার জন্য হিসাব তৈরি করা হয়। ইহাকে লেনদেনের হিসাব বলে। কোন কোন সময় ইহাকে লেনদেনের ভারসাম্যও বলা হয়। লেনদেনের হিসাব আবার দুই প্রকার। যেমনÑ বাণিজ্যের ভারসাম্য (ইধষধহপব ড়ভ ঞৎধফব) ও লেনদেনের ভারসাম্য (ইধষধহপব ড়ভ চধুসবহঃ)। যদি নির্দিষ্ট সময়ের শুধুমাত্র দৃশ্যমান আমদানি ও রপ্তানি পণ্যের হিসাব করা হয় তখন তাকে বাণিজ্যের ভারসাম্য বলে। আর যখন দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান আমদানি ও রপ্তানিকৃত পণ্যসামগ্রীর আর্থিক হিসাব করা হয় তখন তাকে লেনদেনের ভারসাম্য বলে। এখানে অদৃশ্যমান বস্তু বলতে সেবা রপ্তানি করাকে বুঝানো হয়। প্রতি বৎসর বাংলাদেশ থেকে প্রচুর লোক পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গমন করে। তাদের মধ্যে অধিকাংশ লোক যায় শ্রমজীবী হিসেবে। এসব লোকদেরকে রপ্তানি করা হয় না। বরং তাদের শ্রম, মেধা ইত্যাদিকে রপ্তানি করা হয়। এজন্য বলা হয় যে, জনশক্তি রপ্তানি করে বাংলাদেশ। এ জনশক্তি রপ্তানি হচ্ছে একটি অদৃশ্যমান পণ্যের ন্যায়। এ বিশাল জনশক্তি রপ্তানি থেকে যে পরিমান বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয় তা লেনদেনের হিসাবে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আর লেনদেনের হিসাবে অর্জিত অর্থ বা বৈদেশিক মুদ্রা জমা থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে তথা বাংলাদেশ ব্যাংকে। শুধু জনশক্তি রপ্তানি থেকে নয়। বরং সকল প্রকার খাত থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশ ব্যাংকের ভান্ডারে জমা থাকে। ইহাকে বলা হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ যত বেশি থাকে অর্থনীতির শক্তিও তত মজবুত হয়। তা ছাড়া একটি দেশের অভ্যন্তরে যত প্রকারের উন্নয়ন কর্মকাÐ দেখা যাবে, তা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে দেশীয় উৎপাদন, রপ্তানির পরিমাণ ইত্যাদির ওপর। কারণ দেশীয় উন্নয়ন কর্মকাÐ সংগঠিত করতে হলে বিভিন্ন প্রকারের পণ্যাদির প্রয়োজন হয়। এসব পণ্যের মধ্যে অধিকাংশ পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আর বিদেশ থেকে আমদানি করতে হলে প্রয়োজন হয় বৈদেশিক মুদ্রা তথা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল দেশ। এদেশের মানুষের জন্য খাদ্য আমদানি করতে হয়। যদিও কোন কোন সময় বাংলদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয় তবুও খাদ্যের উৎপাদন অনেকাংশে প্রকৃতির ওপর নির্ভরশীল বলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস পায়। আর খাদ্যের এরূপ ঘাটতি মোকাবেলা করার জন্য দ্রæত সময়ের মধ্যে সরকারকে খাদ্য আমদানি করতে হয়। খাদ্য বা নিত্যপ্রয়োজনীয় যে কোন পণ্য আমদানি করতে হলে অবশ্যই বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। আর বৈদেশিক মুদ্রা জমা থাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ফান্ডে। অতএব বলা যায়, বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিশীলতা সম্পূর্ণরূপে নির্ভর করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পরিমাণের ওপর।
প্রত্যেক দেশ চায়, বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস করতে। এ কথা অর্থ এই যে, আমদানির পরমাণ হ্রাস করতে পারলে এবং রপ্তানির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাবে। এ রিজার্ভের পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। আবার আন্তর্জাতিক মুদ্রা সমূহের তুলনায় দেশীয় মুদ্রা তখনই শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে যদি রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে যায়। এ রিজার্ভ হতে হবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা ডলারে। সমসাময়িক কালে এশিয়া মহাদেশের শ্রীলংকা নামক দেশটি একসময়ে ভাল অবস্থানে ছিল। শিক্ষা-দীক্ষায় দেশটির অবস্থান ছিল অনেকাংশে ওপরে। অথচ হঠাৎ করেই দেশটি রিজার্ভ একেবারে তলানিতে নেমে এসেছে। খাদ্য, ঔষধ, জ¦ালানী এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করার মত তেমন বৈদেশিক মুদ্রা না থাকাতে এমন এক চরম সংকটে পড়ছে যা দেশটিকে দেউলিয়ার কাছাকাছি নিয়ে গেছে। অথচ শ্রীলংকার লোকসংখ্যা বাংলাদেশের তুলনায় অনেক কম। এক সময়ে মাথাপিছু আয়ও আমাদের তুলনায় বেশি ছিল। আর আজকে সেই শ্রীলংকা দেউলিয়া একটি দেশে পরিণত হয়েছে। কিন্তু কেন? করোনা, দুর্নীতি, সুশাসনের অভাব ইত্যাদি কারণে রপ্তানির পরিমাণ দ্রæতগতিতে হ্রাস পেয়েছিল। ফলে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ একেবারে কমে গিয়েছিল। তাই শ্রীলংকা আজ একটি দেউলিয়া দেশে পরিণত হয়েছে।
কিন্তু চীন বিশে^র বিভিন্ন দেশে হাজারো রকমের পণ্য রপ্তানিতে নিয়োজিত। বিশে^র এমন কোন দেশ সেই যেখানে চীনের তৈরি পণ্য পৌঁছেনি, আর যে কোন রপ্তানি মানে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন। যে কারণে আজ চীনের রিজার্ভের পরিমাণ ৩ হাজার ৫০ বিলিয়ন ডলার। এর ফলে চীনে উন্নয়নের গতি দ্রæত হচ্ছে। রিজার্ভ একটি দেশের অর্থনৈতিক শক্তি এবং সামর্থ্যরে প্রতীক। বাংলাদেশের রিজার্ভ ২ বছর ধরে ৪০ বিলিয়ন ডলার বা এর চেয়ে একটু বেশি। সম্প্রতি এ রিজার্ভের পরিমাণ ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। যদিও কেউ কেউ বলছেন ৪০ বিলিয়ন ডলারের নিচে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থাকা মানেই বিপদসংকেত। বাংলাদেশের ন্যায় ছোট্ট একটি দেশে যেখানে লোকসংখ্যা ১৬ কোটির তুলনায় একটু বেশি (সর্বশেষ জনশুমারী অনুসারে) সেখানে ৪০ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে প্রায় পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয় মিটানো সম্ভব। এটাকে মোটেই বিপদসংকেত বলা যায় না। অর্থনীতির ধারাবাহিকতা অনুসারে বলা হয় যে, একটি দেশের রিজার্ভ দিয়ে যদি তিন মাসের ব্যয় মিটানো যায় তাহলে তা স্বস্তিদায়ক। সেই হিসেবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কোন বিপদসংকেত আছে বলে মনে হয় না। অন্তত অর্থনীতির তত্তে¡ তা বলে না। তাছাড়া বিশে^ এখন সব দেশের রিজার্ভেই নি¤œমুখী প্রবণতা। বিশে^ সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে চীনে। গত সাতমাসে চীনের রিজার্ভ ৩ হাজার ২৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে ৩ হাজার ৫০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। জাপানে রিজার্ভ ১ হাজার ৪০০ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে ১ হাজার ৩০০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের রিজার্ভ ৯৫০ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ৮৪০ বিলিয়ন ডলার হয়েছে। ভারতের রিজার্ভ জানুয়ারি ’২২ ছিল ৬০০ বিলিয়ন ডলার। এখন তা ৫৭২ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। পাকিস্তানের রিজার্ভ মাত্র ১৫ বিলিয়ন ডলার। এ রিজার্ভ দিয়ে দেশটি তিন মাসের ব্যয় মিটাতে পারবে না। আর শ্রীলংকার রিজার্ভ এখন মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে।
বাংলাদেশ ব্যাংকে বর্তমানে যে ৪০ বিলিয়ন ডলার রিজার্ভ আছে তা দিয়ে অন্তত পাঁচমাসের আমদানি ব্যয় মিটানো সম্ভব। ইতিমধ্যে পোশাক শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়েছে। অতএব উন্নয়নের গতি স্থিমিত হবে না। তবে পূর্ব সতর্কতা হিসেবে অবশ্য সর্বক্ষেত্রে কৃচ্ছতা সাধন করতে হবে।

পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাষ্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ।