বাঁশখালী হতে পারে সামুদ্রিক পর্যটন কেন্দ্র

27

অধ্যাপক নুসরাত জাহান ডায়না

উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক পর্যটন শিল্প অনেক দেশের উন্নয়নের অন্যতম চাবিকাঠি স্বরূপ। উদাহরণ স্বরূপ, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র ও থাইল্যান্ডের কথা উল্লেখ করা যায়। পর্যটন শিল্প এখন বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ শিল্প। বর্তমান সময়ে, যে সময়কে এখন অনেকেই আধুনিক নয় উত্তরাধুনিক মনে করে থাকেন, পর্যটন শিল্প এখন আর উচ্চবিত্তের বিলাস নয়। পর্যটন শিল্প এখন এমন একটি শিল্প বা Industry যেটি মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন মধ্যবিত্তের নাগালে চলে এসেছে। এ শিল্পকে এখন আর ‘বিলাস’ হিসেবে দেখা হয়না। উচ্চ আয়ের দেশ, মধ্য আয়ের দেশ এমনকি নিম্ন আয়ের দেশেও পর্যটন সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তিত হয়ে গেছে।আগে যেমন ৩০ বছর আগেও ছুটিতে বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা আত্মীয় বা গ্রামের বাড়ি যেত এখন তারা পরিকল্পনা করে পর্যটনে দেশের ভেতর কোথাও যেতে। এক্ষেত্রে কক্সবাজার বা সিলেট প্রাধান্য পায়। বিশ্বব্যাপি পর্যটকের সংখ্যা প্রায় ১০০ কোটি। তাদের ৭৫ শতাংশ এখন ভ্রমণ করেন এশিয়ার দেশগুলোতে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশও সারাবিশ্বের দ্রুততম বর্ধনশীল কয়েকটি পর্যটন মার্কেটের একটি হয়ে উঠেছে। WTTC (World Travel and Tourism Council) এর এক গবেষণা অনুযায়ী, ২০১৪ সালে পর্যটন খাতে ১ দশমিক ৩ মিলিয়ন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যা দেশের মোট কর্মসংস্থানের ১ দশমিক ৮ শতাংশ। ২০২০ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর এ খাতে গড়ে ২ দশমিক ৭ শতাংশ হারে কর্মসংস্থান বাড়ার সম্ভাবনা আছে (রহিম, ২০২০)। ঋধননৎর (১৯৯০) এর মতে, উপকূলীয় এলাকায় বিনোদনের জন্য ভ্রমণ মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। মিলার (১৯৯০) এর মতে, সমুদ্রের প্রতি মানুষের একটি শক্তিশালী আকর্ষণ রয়েছে। এটা শুধুমাত্র খাদ্য এবং যাতায়াতের উৎসের জন্য নয়। বিশ্বের বিপুল জনসংখ্যা এই কারণেই সমুদ্র উপকূলে বসবাস করে।
সামুদ্রিক পর্যটন শিল্প বাংলাদেশে প্রধানতঃ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, খুলনা এবং পটুয়াখালী জেলাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। চট্টগ্রাম জেলার উপকূলীয় পর্যটন স্থানগুলো হলো পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এবং পারকি সমুদ্র সৈকত। কক্সবাজার জেলায় আছে ১২০ কিলোমিটার অবিচ্ছিন্ন দীর্ঘ সমুদ্র সৈকত যা পৃথিবীতে ‘কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত’ হিসেবে পরিচিত। এছাড়া আরো কিছু সমুদ্রসৈকত রয়েছে কুতুবদিয়া, কাট্টলি, বাঁশবাড়িয়া, গুলিয়াখালী এবং বাঁশখালিতে। এ সমস্ত পর্যটন কেন্দ্রগুলোর সবগুলোই বঙ্গোপসাগর কেন্দ্রিক। সমুদ্র সৈকতগুলো এখনো পর্যন্ত অনুন্নত, অপরিচিত। যদি এই পর্যটন কেন্দ্রগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবস্থাপনা করা যায় তাহলে এগুলো দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে উল্লেখযোগ্য পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গণ্য হবে। বাঁশখালি কাথারিয়া থানার খানখানাবাদে ৩৫ কিলোমিটার দীর্ঘ বালুকাবেলা রয়েছে। এই বিচ খানখানাবাদ ছাড়াও কাথারিয়া, গন্ডামারা, কদমরসুল, বাহারছড়াচেবং রত্নাপুরায়ও এই ধরনের বিচ রয়েছে। এই বিচ কাকড়াঁ, প্রবাল এবং শামুক ঝিনুকের আবাসস্থল (Islam et al., 2016)। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শুধুমাত্র বিচকে কেন্দ্র করেই কত পর্যটন শিল্প গড়ে উঠেছে। সেসকল দেশে এমন বৈচিত্র্য নেই। তবুও তারা এগিয়ে যাচ্ছ বিচকে পুঁজি করে।
বাঁশখালির কাথারিয়া, খানখানাবাদ, গন্ডামারা, কদমরসুল, বাহারছড়া এবং রত্নাপুর, কাট্টলি, গুলিয়াখালী, বাঁশবাড়িয়া, কুতুবদিয়াসহ চট্টগ্রাম -কক্সবাজার অঞ্চলের এই ছোট ছোট সমুদ্র সৈকতগুলোকে উন্নত করে ট্যুরিজম হাবের (Tourism Hub) অন্তর্ভুক্ত করা গেলে পর্যটন শিল্প অনেকদূর এগিয়ে যাবে। এই ছোট ছোট সমুদ্র সৈকতগুলো আলাদা আলাদাভাবে উন্নত এবং আকর্ষণীয় করতে হবে। সরকার এই দিকে নজর দিলে খুব ভালো হবে। এক্ষেত্রে পর্যটকদের নিরাপত্তা, বেশ কিছু অবকাঠামো পর্যটক পরিবহনসেবা এবং এ বিচগুলোর প্রচারণা জরুরি।
বাঁশখালির এই পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হতে গেলে এর ব্রান্ডিং ইমেজ তৈরি করতে হবে। এর ভিত্তিতে পর্যটকেরা তাঁদের ভ্রমণ স্থান নির্ধারণ করতে পারবে। তাই বাঁশখালির ব্যান্ডিং ইমেজ তৈরি করা জরুরি। এক্ষেত্রে গোষ্ঠীভিত্তিক পর্যটনের ব্যবস্থাও নেওয়া যায়। তাছাড়া ৩ তারকা অথবা ৫ তারকা হোটেল না বানিয়ে এখানের গ্রাম্য জীবন উপভোগের জন্য ব্যবস্থা করা যায়। গবেষক হিসেবে বলতে পারি, গ্রামের ঐতিহ্যের সাথে যায় এরকম অবকাঠামো তৈরি করা যেতে পারে কোন এলাকার কেন্দ্রিয় পয়েন্টে। দেশীয় অনুষ্ঠানের স্বাদ যেমন, পিঠা উৎসব, যাত্রা-পালা গান, বাউল গান- পর্যটকেরা যেন উপভোগ করতে পারেন তার পরিকল্পিত ব্যবস্থা রাখা যায়। অবশ্যই পরিবহন এবং যাতায়াতের সঙ্গে সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ করতে হবে। একটি বিচের সাথে অন্য বিচে যাওয়ার সহজ পথ উন্নত করা জরুরি। কেউ যেন চাইলেই একদিনে সকল জায়গা ঘুরে আসতে পারে। সেই সাথে বাঁশখালি থেকে সরাসরি কক্সবাজার পর্যন্ত সড়কপথ এবং নৌযানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এইভাবে বাঁশখালি সমুদ্র সৈকত কেন্দ্রিক পর্যটন ব্যবস্থাকে উন্নত করা গেলে বাঁশখালিতে অনেক কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। আশা করি বাঁশখালি কেন্দ্রিক নীতিনির্ধারকেরা এই বিষয়ে নজর দিবেন এবং পরিকল্পনা প্রণয়নে সচেষ্ট হবেন।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক