বাঁশখালী-সন্দ্বীপ বেড়িবাঁধ নিম্নমানের ব্লকে নির্মিত

451

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কর্তৃক বাস্তবায়নাধীন বাঁশখালী, সন্দ্বীপ ও সীমান্ত নদীর বেড়িবাঁধ প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও সিসি ব্লক নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছেন টাস্কফোর্স প্রধান কাজী তোফায়েল আহমেদ। দ্বৈবচয়নের ভিত্তিতে যাচাই করা বিভিন্ন আকৃতির ব্লকের বিষয়ে আপত্তি উঠলে গত ২৮ জুলাই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। কমিটিকে এসব প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও ব্লক নির্মাণে অসঙ্গতি নিরূপণে ব্যর্থ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চিহ্নিতকরণের নির্দেশনা দেয়া হয়। সরেজমিনে তদন্ত শেষে গত ১৪ সেপ্টেম্বর জমা দেওয়া প্রতিবেদনে তিন প্রকল্পে অনিয়ম পাওয়ার কথা উল্লেখ করেছে কমিটি। তবে তদন্তকালে ব্লক নির্মাণে অনিয়মের প্রমাণ মিললেও প্রতিবেদনে পাউবোর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দায়মুক্তি দেয়া হয়েছে।
বাঁশখালীর উপজেলার পোল্ডার নং ৬৪/১এ, ৬৪/১বি এবং ৬৪/১সি এর সমন্বয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার স্থায়ী বেড়িবাঁধ পুনর্বাসন, খাগড়াছড়ির সীমান্ত নদী তীর সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্প (২য় পর্যায়), সন্দ্বীপ উপজেলার পোল্ডার নং ৭২ এর ভাঙনপ্রবণ এলাকার তীর প্রতিরক্ষা কাজের পুনর্বাসন প্রকল্পে নিম্নমানের কাজ ও ব্লক বসানোয় এ তদন্ত করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাজের পরিমাণ, অবস্থান, বর্তমান জনবল ইত্যাদি দিক বিবেচনায় বাতিলকৃত সিসি ব্লকের বিষয়ে পাউবোর মাঠ পর্যায়ের কোনও কর্মকর্তা দায়ী নয়। এক্ষেত্রে সিসি ব্লকের গুণগত মান না থাকার কারণে যে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি হবে তার ব্যয়ভার ঠিকাদারকে বহন করার সুপারিশ করা হয়েছে। এছাড়াও সিসি ব্লকের গুণগত মান পরীক্ষা, ব্লক বাতিলের প্রক্রিয়া, বাতিলকৃত সিসি ব্লকগুলির ক্ষেত্রে করণীয় ইত্যাদি বিষয়ে একটি নীতিমালা প্রণয়নপূর্বক ঠিকাদারের সাথে চুক্তিতে অর্ন্তভুক্ত করার কথাও সুপারিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
তদন্তে দায়িত্বপ্রাপ্ত পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান প্রকৌশলী ও তদন্ত কমিটির আহব্বায়ক ফজলুর রশিদ, কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. রুহুল আমিন, কন্ট্রাক্ট এন্ড প্রকিউরমেন্ট সেলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হাফিজুল আলম এ প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে দুইজন কর্মকর্তার সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও সংযোগ পাওয়া যায়নি।
পাউবো সূত্র জানায়, বাঁশখালীর ৩৬টি প্যাকেজের মধ্যে হাসান এন্ড ব্রাদার্স ২১টি, মশিউর এন্ড ব্রাদার্স আটটি, আরাধনা এন্টারপ্রাইজ দুটি, মোস্তফা এন্ড সন্স দুটি, আলম এন্ড ব্রাদার্স একটি, নিয়াজ এন্টারপ্রাইজ একটি ও জিকু এন্টারপ্রাইজ একটি প্যাকেজের কাজ করেছে। সন্দ্বীপে বিশ্বাস বিল্ডার্স পাঁচটি, আনোয়ার ল্যান্ড মার্ক দুটি, ডলি কনস্ট্রাকশন একটি ও শেখ এমদাদুল আলম একটি প্যাকেজের কাজ করেছে।
চট্টগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ড নির্বাহী প্রকৌশলী-২ আবু বক্কর সিদ্দিক ভূঁইয়া পূর্বদেশকে বলেন, ‘একটি ভিত্তিহীন অভিযোগের তদন্ত হয়েছে। যে ব্লকগুলো বাতিলের কথা বলা হচ্ছে সেগুলো সঠিক বলে অভিযোগকারী নিজেই প্রতিবেদন দিয়েছেন। তদন্ত কমিটি গঠনের আগেই এটি সমাধান হয়েছে। এ সমস্যা কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়েছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দোষারোপ করার সুযোগ নেই।’
দাখিলকৃত তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাঁশখালীতে চলমান ৩৬টি প্যাকেজের আওতায় ১৭.৩৪৮ কি.মি প্রতিরক্ষামূলক কাজের তফসিল অনুযায়ী বিভিন্ন আকৃতির মোট প্রায় ১৮ লক্ষ সিসি ব্লকের সংস্থান আছে। অদ্যাবদি প্রায় ১৫ লক্ষ সিসি ব্লক নির্মিত হয়েছে। এরমধ্যে পাঁচটি প্যাকেজে কয়েক ধাপে সিসি ব্লক গণনা করা হয়েছে। গণনাকালে ৩৩টি সিসি ব্লকের চাপন শক্তি বুয়েট হতে পরীক্ষা করা হয়েছে। এসব ব্লকের মধ্যে ১৯টির ফলাফল ৯.০০ হতে তদুর্ধ, একটির ফলাফল ৭.২ হতে ৯.০০ এবং ১৩টির ফলাফল ৭.২ হতে কম। ৩৪টি প্যাকেজের মধ্যে পাঁচটি প্যাকেজের অনুকূলে প্রাথমিকভাবে ১০৫১০টি এবং চূড়ান্তভাবে ২১৬৭টি সিসি ব্লক বাতিল করা হয়েছে। এই পাঁচটি প্যাকেজের অনুকূলে বিভিন্ন আকৃতির যে পরিমাণ ব্লকের নির্মাণ বাবদ বিল প্রদান করা হয়েছে তার পরিমাণ টাস্কফোর্স কর্তৃক চূড়ান্তভাবে বাতিলের পর গ্রহণের জন্য সুপারিশকৃত বøকের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
বাঁশখালীর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী প্রকাশন চাকমা পূর্বদেশকে বলেন, ‘শ্রমিকদের অদক্ষতার কারণে এমন সমস্যা হয়েছে। কোনও ঠিকাদার চায় না এমন সমস্যা পড়ুক। আমাদের দিক থেকেও কোনোরূপ গাফিলতি ছিল না।’
সন্দ্বীপ প্রকল্পে ৮টি প্যাকেজের মধ্যে ৯.৮০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষামূলক কাজের তফসিল অনুযায়ী বিভিন্ন আকৃতির ১০ লক্ষ ৬৯ হাজার ৮৩০টি ব্লকের সংস্থান আছে। এরমধ্যে চার লক্ষ চার হাজার ৫৭৪টি সিসি ব্লক নির্মিত হয়েছে। প্রকল্পের বিভিন্ন প্যাকেজে দফায় দফায় টাস্কফোর্স কর্তৃক ব্লক গণনা করা হয়েছে। গণনাকালে মোট ৮৬টি ব্লকের চাপন শক্তি বুয়েট হতে পরীক্ষা করা হয়েছে। মোট ৮৬টি ব্লকের মধ্যে ৪৯টির ফলাফল ৯.০০ হতে তদুর্ধ, ১৮টির ফলাফল ৭.২ হতে ৯.০০ এবং ১৯টির ফলাফল ৭.২ হতে কম। আটটি প্যাকেজের মধ্যে একটি প্যাকেজের অনুকূলে প্রাথমিকভাবে ১৯৬১টি এবং চূড়ান্তভাবে ১৪৪৮টি ব্লক বাতিল করা হয়েছে।
সন্দ্বীপ প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা প্রকৌশলী অপু দে পূর্বদেশকে বলেন,‘সন্দ্বীপে জোয়ারের কারণে কাজ করা যায় না। মালামাল পরিবহনে সমস্যা, লোকাল কারণে কিছুটা সমস্যা হয়েছে। ঠিকাদারের গাফিলতিও আছে। যে শ্রমিকরা কাজ করেছে তারা কিছুদিন পর পালিয়ে যায়। মিঠা পানির অভাবে লবণাক্ত পানি দিয়ে কাজ করতে হয়েছে। যেখানে ব্লক বানানো হয়েছে সেখানেই নানারকম সমস্যা।’
খাগড়াছড়িতে সীমান্ত নদী প্রকল্পে ১৯টি প্যাকেজের মধ্যে ৮টি প্যাকেজের ক্ষেত্রে নির্ধারিত বøকের চাপন শক্তি কাক্সিক্ষত মানে পৌঁছায়নি। এরমধ্যে দুটি প্যাকেজের ২য় গণনায় ও বাকি ছয়টি প্যাকেটের প্রথম গণনায়, বাকি সকল প্যাকেজের ব্লক সন্তোষজনক মান অর্জন করে। সাইটে দীর্ঘদিন কাজ বন্ধ থাকার পরে অনেকগুলো প্যাকেজে একইভাবে নির্মাণকাজ শুরু হয়। প্রকল্পের ৫৫ কিলোমিটার নদীর দৈর্ঘ্যরে মধ্যে ১৯টি প্যাকেজের কাজ তদারকি করতে বিভিন্ন অবস্থানে দীর্ঘ পাহাড়ি পথ অতিক্রম করতে হয়। যে কারণে ব্লক নির্মাণে অসুবিধায় পড়তে হয়েছে ঠিকাদারদের।