বাঁশখালীতে গুলিতে ৫ শ্রমিক নিহত

55

বাঁশখালীর গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিকদের সাথে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন পাঁচ শ্রমিক। গতকাল শনিবার সকালে বকেয়া বেতন পরিশোধ, কর্মঘণ্টা কমানোর দাবিতে শ্রমিকরা অসন্তোষ প্রকাশ করলে এ ঘটনা ঘটে। এতে কমপক্ষে ২১ জন পুলিশ ও শ্রমিক আহতাবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসা নিয়েছেন। শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষের ঘটনায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এছাড়াও শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে নেয়ার পাশাপাশি নিহত শ্রমিকদের প্রতি পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়ার ঘোষণা দেন জেলা প্রশাসক।
এ ঘটনায় নিহতরা হলেন আহমদ রেজা (১৮), মোহাম্মদ শুভ (২৪), রনি হোসেন (২২), মোহাম্মদ রাহাত (২২) এবং মো. রায়হান (১৯)। এরমধ্যে চারজন বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। নিহত আহমদ রেজার বাড়ি গন্ডামারায়। বাকিরা অন্যান্য জেলা থেকে গিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রে শ্রমিক হিসেবে কাজ করছিল।
এদিকে ঘটনার পরপরই জেলা প্রশাসক মো. মমিনুর রহমান, পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন, পুলিশ সুপার এসএম রশিদুল হকসহ প্রশাসন ও পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। দুপুরের পর শ্রমিক অসন্তোষ নিরসনে ঘটনাস্থলে উপস্থিত উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও শ্রমিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন। বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে এ বৈঠক শেষ হয়।
বৈঠক শেষে জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা বৈঠকে বসে শ্রমিকদের দাবি-দাওয়া মেনে নিয়েছি। ঘটনার তদন্তে চার সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। ঘটনার সাথে স্থানীয় কারো ইন্ধন থাকলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। নিহত শ্রমিকদের প্রতি পরিবারকে তিন লক্ষ টাকা ও আহতদের ৫০ হাজার টাকা করে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।’
পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিকদের সঙ্গে কর্তৃপক্ষের বিরোধ চলছিল। সকালে ১২ দফা দাবিতে শ্রমিকরা বিক্ষোভের চেষ্টা করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনার তদন্তে পুলিশের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’
বাঁশখালী উপজেলা সদর জলদী থেকে দশ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে গন্ডামারায় নির্মাণাধীন কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট। ২০ হাজার কোটি টাকার এ প্রকল্প নির্মাণ করছে দেশের খ্যাতনামা শিল্পগ্রূপ এস. আলম এবং চীনের সেপকো থ্রি ইলেকট্রিক পাওয়ার কনস্ট্রাকশন কোম্পানি ও এইচটিজি ডেভেলপমেন্ট গ্রূপ। এ প্রকল্পে কর্মরত আছেন প্রায় ৬০০ চীনা প্রকৌশলী ও পাঁচ হাজারের অধিক শ্রমিক। শ্রমিকদের মধ্যে স্থানীয় শ্রমিক আছে প্রায় পাঁচ শতাধিক। ইতোমধ্যে প্রকল্পের অবকাঠামো নির্মাণ কাজ অধিকাংশই সম্পন্ন হয়েছে। বয়লারসহ বেশ কিছু স্থাপনা দৃশ্যমান হয়েছে।
শ্রমিকরা জানান, ঈদের আগে বেতন ভাতাদি পরিশোধ নিয়ে তাদের দাবি দাওয়া ছিল। রমজান মাস চলে আসায় ইফতার ও সেহরীর সময় বিবেচনা করে কর্মঘণ্টা কমানোর দাবিও তুলে ধরা হয়েছিল। কিন্তু কোন দাবি প্রকল্প কর্তৃপক্ষ মেনে নেয়নি। সকালে পাঁচজন শ্রমিককে ডেকে নিয়ে দাবি না মানার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেয়া হলেই শ্রমিকরা উত্তেজিত হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ লেগে যায়। পুলিশ গুলি ও টিয়ারগ্যাস ছুঁড়লে অনেকেই গুলিবিদ্ধ হয়। তখন শ্রমিকরা চারদিক দিয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। প্রকল্প এলাকায় রাখা কিছু যানবাহনে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। শুরু হয় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।
সাজ্জাদ হোসেন নামে এক শ্রমিক বলেন, ‘৫০ টাকা থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত পেশা অনুসারে ঘণ্টা প্রতি বেতন পেতো শ্রমিকরা। যা মাস শেষে হিসেব করে দেয়া হতো। কিন্তু অনেকের বেতন বাকি রাখা হয়েছে। বেতন চাইলে শ্রমিকদের বকাঝকা করা হতো। এরমধ্যে রমজান চলে আসলে ১০ ঘণ্টা থেকে দুই ঘণ্টা কমিয়ে আটঘণ্টা এবং শুক্রবারে চার ঘণ্টা ডিউটি করার কথা জানানো হয়। কিন্তু তারা কথা না রেখে আমাদের উপর গুলি চালিয়েছে।’
গাড়িতে দেয়া হয় আগুন : সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ শুরু হলেও সকাল সাড়ে ১০টার দিকে গাড়িতে আগুন দেয়া হয়। আগুন নিয়ন্ত্রণে ঘটনাস্থলে যাওয়া বাঁশখালী ফায়ার সার্ভিসের টিম লিডার লিটন বৈঞ্চব বলেন, প্রকল্পে ব্যবহৃত সাতটি বড় সিমেন্ট মিক্সার ট্রাক, একটি নোহা মাইক্রোবাস ও দুটি মোটরসাইকেলে আগুন দেওয়া হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে আটটি বড় সিমেন্ট মিক্সার ট্রাক। প্রথমেই এসে আমরা শ্রমিকদের বাধার মুখে পড়ি। আমাদের শক্তি পুলিশ ও পানি। দুটোর সাপোর্ট পেতেই দেরি হয়েছে। পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে।’
বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে আবারো প্রকল্প এলাকায় আগুন ধরিয়ে দেয় কে বা কারা। আগুনের লেলিহান শিখা পুরো আকাশকে কালো করে তুলে। এতে এলাকায় আবারো আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। তাৎক্ষণিক গাড়ি চালকরা গিয়ে গাড়িগুলো সরিয়ে নিলেও ততক্ষণে আগুনের পরিধি বাড়ে। পরে ফায়ার সার্ভিস গিয়ে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে।
স্থানীয়দের উস্কানিকেই দোষারোপ : বাঁশখালীর কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের জায়গা ক্রয় ও নির্মাণ শুরুর প্রাক্কালে স্থানীয়দের বাধা প্রদান করলে পুলিশ-জনতার দুটি সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যান পাঁচজন। ২০১৬ সালে এ ঘটনার পর স্থানীয় একটি পক্ষ প্রকল্পবিরোধী ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছিল স্থানীয় চেয়ারম্যান বিএনপি নেতা লেয়াকত আলী। পরবর্তীতে এই লেয়াকত আলী প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আস্থাভাজনে পরিণত হন। এ প্রকল্পে স্থানীয় যে শ্রমিকরা কর্মরত আছেন সেগুলো বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জামায়াত অনুসারী। এ প্রকল্প থেকে সকল রাজনৈতিক দলের নেতারা সুবিধা আদায় করেন। গতকালের ঘটনায় স্থানীয় একটি অংশের উস্কানি থাকার কথা বারবার উচ্চারিত হয়ে আসছিল। ঘটনার পরপরই শ্রমিকদের ফেলে যাওয়া আসবাবপত্র ব্যাপক লুটপাট চালায় স্থানীয়রা।
দুটি পৃথক তদন্ত কমিটি : চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন ও পুলিশের পক্ষ থেকে পৃথক দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পুলিশের পক্ষ থেকে গঠিত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রধান করা হয়েছে অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেনকে। এছাড়াও পুলিশ সুপার নেছার আহমেদ এবং অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবির হোসেনকে সদস্য করা হয়েছে। আগামী সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে এ কমিটিকে।
জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তারকে প্রধান করে চার সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির অন্য সদস্যরা বলেন, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার কবির আহমেদ, কলকারখানা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের লেবার পরিদর্শক মাসুদ রানা, বিদ্যুৎ বিভাগ চট্টগ্রামের সহকারী প্রধান প্রকৌশলী অভিজিৎ কুরি। কমিটিকে আগামী তিন কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
হাসপাতালে চিকিৎসাধীন যারা : এ ঘটনায় কমপক্ষে ৩০ জন আহত হলেও বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন ২১ জন। এরমধ্যে যাদের নাম পাওয়া গেছে তারা হলেন হাবিবুল্লাহ (২১), মো. রাহাত (৩০), মিজান (২২), মো. মুরাদ (২৫), মো. শাকিল (২৩), মো. কামরুল (২৬), মাসুম আহমদ (২৪), আমিনুল হক (২৫), মো. দিদার (২৩), ওমর (২০), অভি (২২)। এছাড়াও গন্ডামারা পুলিশ ফাঁড়ির তিন সদস্য ইয়াসির (২৪), আব্দুল কবির (২৬) ও আসাদুজ্জামান (২৩) আহতবস্থায় চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
বাঁশখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত চিকিৎসক জানান, ‘এ হাসপাতালে চারজন নিহত ব্যক্তিসহ ১৬ জনকে আনা হয়েছিল। এরমধ্যে ১২ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে চমেক হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ১২ জনের মধ্যে সাতজন গুলিবিদ্ধ ও বাকি পাঁচজন গ্যাসে আহত হয়েছেন। পুলিশের যে সদস্যরা আহত হয়েছেন তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশ থেঁতলে গেছে। পরে অনেকেই সরাসরি চমেক হাসপাতালে চলে গেছেন।’
চমেক হাসপাতাল ও বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে দেখা যায়, একের পর এক গুলিবিদ্ধরা আসছেন হাসপাতালের জরুরী বিভাগে। পরিস্থিতি সামাল দিতে চিকিৎসকদেরও হিমশিম খেতে হয়। হাসপাতালের মেঝেতে পড়ে ছিল ছোপছোপ রক্ত। অধিকাংশ আহতকে স্থানীয় ও আত্মীয় স্বজনরা ধরাধরি করে হাসাপাতালে ঢুকাচ্ছেন। আহতের আর্ত্মচিৎকারে পরিবেশ ভারি হয়ে উঠে। নিহতের স্বজনদের আর্তনাদও ষ্পর্শ করে সকলকে। বিভীষিকাময় অবস্থা হাসপাতাল এলাকায়। অ্যাম্বুলেন্স ও সিএনজি টেক্সির মুহুর্মুহু শব্দে যেন পুরো হাসপাতাল এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বাঁশখালী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে উপস্থিত উত্তেজিত শ্রমিকরা পুলিশের হামলার ঘটনায় ক্ষোভ ঝারেন।