বাঁচার জন্য ছটফট করেছিল মানুষগুলো

47

রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় ভবনে অবস্থিত মানুষের বাঁচার আকুতি স্পষ্ট। আগুন না ছড়ালেও উপরের দিকে কয়েকটি তলার অফিসে আসবাবপত্র, জুতা ছড়ানো। যা থেকে বোঝা যায় মানুষ বাঁচার জন্য ছটফট করছিলো।
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় ভবনটি পরিদর্শন শেষে আলাপকালে বিষয়গুলো জানান শামীম। তিনি ডার্ড গ্রুপের কর্মকর্তা, ভবনের ১২, ১৩, ১৬ ও ১৯ তলায় তাদের অফিস রয়েছে। এর আগে প্রতিটি ফ্লোরের প্রতিনিধিদের সঙ্গে নিয়ে ভবনটি পরিদর্শনে প্রবেশ করেন পুলিশ সদস্যরা।
শামীম বলেন, আমাদের অফিসের আসবাব আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও টাকা-পয়সা মূল্যবান জিনিসপত্র পেয়েছি। দেখতে দেখতে ২১ তলাতে গিয়ে রক্তের দাগ দেখেছি। উপরের দিকের অফিসগুলোর ভেতরে আগুন যায়নি, কিন্তু জিনিসপত্র ছড়ানো ছিটানো। পানির বোতল-জুতা এদিক-সেদিক ছড়িয়ে আছে। এ থেকে বোঝা যায় মানুষগুলো বাঁচার জন্য ছটফট করছিলো।
প্রত্যক্ষদর্শী আরো অনেকে জানান, ভবনটির ৭ম তলা থেকে ১১তলা পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিশেষ করে ৭ম তলা থেকে ১০ম তলা পর্যন্ত প্রায় সবকিছুই পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।
৮ম তলায় অবস্থিত সিএনএফ নামের একটি অফিসে চাকরি করতেন জিলানি। পুলিশের সঙ্গে ভবনের ভেতরে পরিদর্শন শেষে বের হয়ে তিনি বলেন, ৮ম তলার দক্ষিণ পাশে আমাদের অফিস। অফিসের আসবাবপত্র থেকে শুরু করে কিছুই পোড়ার বাকি নেই। কাঁচ ভেঙে নিচে ছাইয়ের সঙ্গে মিশে আছে, পা ফেলার উপায় নেই। সঙ্গে নিয়ে আসার মতো কিছুই পাইনি।
অগ্নিকান্ডের সময় অফিসে ছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের ভবনের নিচে আগুন লেগেছে। হঠাৎ করে ধোঁয়া উপরের দিকে উঠতে দেখে দ্রুত আমি ছাদে উঠে যাই। সে সময় অফিসে ২৫-৩০ জন কর্মী ছিলেন, তাদের অনেকেই হতাহত হয়েছেন। তবে এ মুহূর্তে নির্ধারিত করে নামগুলো বলতে পারছি না।
এদিকে, ভবনের বিভিন্ন অফিস থেকে উদ্ধার হওয়া টাকাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মালামাল মালিকদের কাছে হস্তান্তর করেছে পুলিশ।
পরিদর্শন দলে ছিলেন ডার্ড গ্রুপের নির্বাহী পরিচালক সাবেক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরাফাত হোসেন বলেন, আমাদের খুব একটা ক্ষতি হয়নি, শুধু বাইরের গ্লাসগুলো কালো হয়ে গেছে। একটি অফিসে পাওয়া ৫ লাখ টাকা, পাসপোর্ট, চেকবই পুলিশ আমাদের কাছে হস্তান্তর করেছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টা ৫৫ মিনিটের দিকে বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ অগ্নিকান্ডে ২৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে। অর্ধশতাধিক মানুষ দগ্ধ ও আহত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। খবর বাংলানিউজের
দম্পত্তি নিহতের ঘটনায় জলঢাকায় শোকের মাতম : রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডে দম্পতি নিহতের ঘটনায় নীলফামারীর জলঢাকার কৈমারী ইউনিয়নে মেয়ের বাড়ি বিন্যাকুড়ি গ্রামে চলছে শোকের মাতম। নিহত দম্পতি হলেন বিন্যাকুড়ি গ্রামের আশরাফ আলীর মেয়ে (সাত মাসের অন্তঃসত্তা) রুমকি বেগম (২৮) ও পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকার মিজানুর রহমানের ছেলে মাকসুদুর রহমান (৩১)। তারা দুইজনই ওই টাওয়ারে ট্রাভেল এজেন্সিতে কর্মরত ছিলেন। নিহত রুমকি তিন ভাই-বোনের মধ্যে সবার ছোট। দুর্ভাগ্যক্রমে পাঁচ মাস আগে রুমকির মাও মারা যান।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সকালে বিন্যাকুড়ি গ্রামে নিহতের পরিবারের কান্না ও আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। এমন মর্মান্তিক মৃত্যুতে এলাকায় নেমে এসেছে শোকের ছায়া।
নিহত রুমকির খালু শফিকুল ইসলাম বলেন, সাড়ে তিন বছর আগে রুমকির বিয়ে হয়। গত চারদিন আগে মেয়ে ও জামাই গ্রামে বেড়াতে আসেন। আর তার চারদিন পর তার মৃত্যুর খবর শুনতে হলো।
মেজো ভাই ও বিন্যাকুড়ি উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক রওশন আলী রনি বলেন, গত ১৭ মার্চ মোবাইলফোনে কথা হয় রুমকির সঙ্গে। সে জানিয়েছিল ঈদুল ফিতরের ছুটিতে জামাই নিয়ে গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে আসবে। এই কথা বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়ে আর কিছুই বলতে পারেননি।
বড় ভাই রফিকুল ইসলাম রকি (৩৫) বোনকে হারিয়ে বাকরুদ্ধ। বাবা আশরাফ আলী বুকের ধন মেয়ে ও জামাইকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। তিনি কাঁদতে কাঁদতে বলেন, কিছুদিন আগে স্ত্রী হারানোর বেদনা ভুলতে পারিনি। এর পর মা হারা মেয়েটিও আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। আমি এতিম হয়ে গেলাম।
চাচাতো বোন জয়া বেগম (৪২) বলেন, রুমকির শিক্ষা জীবন ও বিবাহিত জীবন ঢাকায়। সে মাস্টার্স পাশ করে একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে ওই এফ আর টাওয়ারে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মিলে চাকরি করতেন। রুমকি ১০ তলায় আর ভগ্নিপতি মাকসুদার (বোনের জামাই) ১১ তলায় কর্মরত ছিলেন। শুনেছি জীবন বাঁচাতে ১১তলা থেকে লাফিয়ে পড়ে ঘটনাস্থলে মাকসুদার মৃত্যু হয়। আর রুমকি কালো ধোঁয়া ও গ্যাসে শ্বাস বন্ধ হয়ে মারা যায়।
রুমকির চাচা ও জলঢাকা উপজেলা পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সৈয়দ আলী বলেন, আমার ভাই আশরাফ তার একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে পাগল প্রায়। তিনি ঢাকায় গিয়ে তার মেয়ের মরদেহ বুঝে নেন এবং জামাই মাকসুদার বাড়ি ঢাকায় হওয়ায় তার মরদেহটি তার পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
জলঢাকা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সুজাউদৌলা বলেন, রুমকির নামাজে জানাজা শেষে তাকে পারিবারিক কবরস্থানে তার মায়ের পাশে দাফন করা হয়েছে।
শোকসন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানিয়েছেন স্থানীয় সংসদ সদস্য নীলফামারী-৩ আসনের মেজর (অব.) রানা মোহাম্মদ সোহেল।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা ৫৫ মিনিটের দিকে বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ অগ্নিকান্ডে ২৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে। অর্ধশতাধিক মানুষ দগ্ধ ও আহত হয়ে রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখা হলো না লিটনের : দ্বিতীয় সন্তানের মুখ দেখে যেতে পারলেন না খুলনার তেরখাদা উপজেলার কোদলা গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান লিটন (৩৩)। তার স্ত্রী তানিয়া বেগম দ্বিতীয়বারের মতো মা হতে যাচ্ছেন। আগামি ১০ এপ্রিল তার সন্তান প্রসবের দিন রয়েছে। কিন্তু অনাগত সন্তানের মুখ দেখার আগেই বনানীতে এফ আর টাওয়ারের আগুনে করুণ মৃত্যু হয়েছে লিটনের। ফলে তার দ্বিতীয় সন্তান বঞ্চিত হলো পিতৃস্নেহ থেকে। শুধু অনাগত সন্তানই নয় লিটনের ৫ বছরের ছেলে তানিমও হলো পিতৃহীন। স্বামীহারা হয়ে অল্প বয়সেই বিধবা হলেন স্ত্রী তানিয়া।
গতকাল শুক্রবার দুপুরে লিটনের মরদেহ গ্রামের বাড়ি খুলনার তেরখাদায় পৌঁছালে স্ত্রী সন্তানসহ স্বজনদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারী হয়ে ওঠে। তার স্ত্রী স্বামীর শোকে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছেন। একইসঙ্গে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। বাদ জুমা জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে লিটনের দাফন সম্পন্ন হয়েছে।
ছাগলাদাহ ইউপি চেয়ারম্যান দ্বীন ইসলাম বলেন, স্বামীহারা হয়ে অল্প বয়সেই বিধবা হলেন লিটনের স্ত্রী তানিয়া। লিটনের মা-বাবা নেই। এক ছেলে ও স্ত্রী রয়েছে। স্ত্রী আবার সন্তানসম্ভবা। এই পরিবারটির একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি ছিলেন লিটন।
লিটনের ভাইয়ের ছেলে সুমন বলেন, বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর সেখান থেকে বের হতে না পেরে লিটন চাচা মারা যান। তিনি ওই টাওয়ারের একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন। তার মরদেহ বাড়িতে পৌঁছালে সবাই শোকস্তব্ধ হয়ে যান। তার স্ত্রী এমনিতেই অসুস্থ। তার ওপর লিটনের মরদেহ আসার পর আরও অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। লিটনের মৃত্যুতে এ পরিবারটি সহায়-সম্বল সবই হারালো।
গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা ৫৫ মিনিটের দিকে বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুনের সূত্রপাত হয়। এ অগ্নিকান্ডে ২৫ জনের প্রাণহানি হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন খুলনার তেরখাদা উপজেলার কোদলা গ্রামের বাসিন্দা মিজানুর রহমান লিটন।
‘মরে যাচ্ছি, তোরা ভালো থাকিস’ : ‘আমার অফিসে আগুন লেগেছে। আমিতো বের হতে পারছিনা। আমি মনে হয় আর বাঁচবো না। সবাই অফিস থেকে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি কোনো উপায় না পেয়ে অফিসের চেয়ারে বসে আছি। তোরা সবাই ভালো থাকিস। আর সবাইকে আমার জন্য দোয়া করতে বলিস’।
রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে আগুন লাগার পর সেখান থেকে বের হতে না পেরে জীবনের অন্তিম মূহুর্তে মোবাইলে ছোট ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশকে কথাগুলো বলেন তার বড় ভাই মঞ্জুরুল রহমান।
নিহত মঞ্জুরুল রহমান শারীরিক প্রতিবন্ধী ছিলেন। তিনি নওগাঁ সদর উপজেলার বোয়ালিয়া পূর্বপাড়া গ্রামে মৃত মুনছুর রহমানের ছেলে। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। ঢাকার বেসরকারি কাশেম গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রি লিমিটেডে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে চাকরি করতেন তিনি।
ছোট ভাই মেহফুজ জুবায়ের পলাশ বলেন, ঘটনার দিন বড় ভাই মঞ্জুর রহমান বনানীর এফ আর টাওয়ারের ২১ তলায় কোম্পানির প্রধান কার্যালয়ে ছিলেন। ওই সময় যে যার মতো অফিস ছেড়ে চলে গেলও আমার ভাই বের হতে পারেননি। সে সময় তিনি সহকর্মীদের বলেন ‘আল্লাহ হেফাজত করলে বাঁচবো, নয়তো নয়। আপনারা চলে যান আল্লাহ ভরসা’। এরপর থেকে আর ভাইকে মোবাইলে পাওয়া যায়নি।
মঞ্জুর রহমানের আরেক ছোট ভাই শিমুল জানান, মঞ্জুর রহমান পরিবার নিয়ে ঢাকার ইব্রাহিমপুরে থাকতেন। তার এক ছেলে ও এক মেয়ে রয়েছে। চাকরিরত অবস্থায় ২০০০ সালে অফিসের সামনের রাস্তায় এক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি পঙ্গু হন। এরপর থেকে ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারতেন না। এক প্রকার পঙ্গু জীবনযাপন করতেন। কিন্তু তারপরও কোম্পানি ভাইকে চাকরি থেকে বাদ দেয়নি। অফিসে যখন আগুন লাগে সবাই বাঁচার জন্য ছুটাছুটি করছিল কিন্তু ভাই পঙ্গু হওয়ায় কিছু করার উপায় ছিল না। অফিসে বসেই মোবাইল ফোনে বড়ভাই পলাশের সঙ্গে কথা বলছিল। আর দোয়া চেয়েছিলেন।
তিনি আরও জানান, ভাইয়ের মরদেহ গ্রামের বাড়িতে আনা হয়নি। স্ত্রী ও ছেলের ইচ্ছেই শুক্রবার (গতকাল) জুম্মার নামাজের পর ঢাকার মিরপুর সাড়ে ১১ নম্বরে একটি মসজিদের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
বনানীর অগ্নিকান্ডে চাঁদপুরের ৩ জন নিহত : বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় চাঁদপুরের তিনজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন জেলার ফরিদগঞ্জ উপজেলার গুপ্টি ইউনিয়নের শ্রীকালিয়া গ্রামের মুন্সিবাড়ীর মকবুল আহমেদের ছেলে আব্দুল্লাহ আল ফারুক তমাল, মতলব দক্ষিণ উপজেলার খাদেরগাও ইউনিয়নের নাগদা গ্রামের বেনু প্রাধানিয়ার ছেলে রেজাউল করিম রাজু, কচুয়া উপজেলার ৩নং বিতারা ইউনিয়নের বাইছাড়া গ্রামের হাবিবুর রহমানের ছেলে আতাউর রহমান চঞ্চল।
তমাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী ছিলেন। গত বৃহস্পতিবার আগুনে দগ্ধ হওয়ার পর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয় বলে জানিয়েছেন তার বন্ধু মিনহাজ উদ্দিন।
মিনহাজ জানান, তমাল ঢাবির ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী। তিনি ইইউ আর বিডি সলিউশন-এ সেলস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। আগুনে তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে।
তমালের চাচাতে ভাই ফরিদগঞ্জের শ্রিকালিয়া গ্রামের সালাহউদ্দিন জানান, তমালরা স্ব-পরিবারে ঢাকার সারুলিয়ায় থাকতেন। তার দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। তিন ভাইয়ের মধ্যে তমাল দ্বিতীয়। তার বাবা অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক ছিলেন।
অগ্নিদগ্ধ হয়ে নিহত মতলব দক্ষিণ উপজেলার নাগদা গ্রামের রেজাউল করিম রাজু ওই ভবনের পঞ্চম তলার আসিফ ইন্টারন্যাশনালের নির্বাহী পরিচালক ছিলেন। ওই ভবনের পঞ্চম তলার পুরো প্লটটি তিনি কিনে ব্যবসা করতেন। রাজু এক ভাই তিন বোনের মধ্যে দ্বিতীয়। রাজু স্ত্রী ও দুই কন্যা সন্তান নিয়ে বনানীতে থাকেন। বাবা বেনু প্রধানীয়া চট্টগ্রামের একজন ব্যবসায়ী।
রাজুর চাচা শ্বশুরের ছেলে ট্রাভেলস ব্যবসায়ী হাজী জসিম উদ্দিন বলেন, কুর্মিটোলা হাসপাতাল থেকে বৃহস্পতিবার রাতে আমরা তার মরদেহ শনাক্ত করে গ্রহণ করেছি। তাকে কোথায় দাফন করা হবে তা নিশ্চিত করে বলতে পারছি না। রাজু জেলার হাজীগঞ্জ উপজেলার কালচোঁ দক্ষিণ ইউনিয়নের ওড়পুর গ্রামে বিবাহ করে।
রামপুর বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক এসএম মানিক জানান, রাজু একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। তারা কেউই এলাকাতে থাকতেন না। রাজুর বাবা চট্টগ্রামের একজন বড় ব্যবসায়ী।
অপরদিকে, নিহত আতাউর রহমান চঞ্চলের চাচাতো ভাই দনিয়া বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের ইংরেজি বিভাগের চেয়ারম্যান মুন্সী নূরুল আলম বেলাল বলেন, চঞ্চল কয়েকদিন আগে বনানীতে অফিস স্থানান্তর করেন। ঘটনার সময় চঞ্চল শেষবারের মতো তার ছেলে ইঞ্জিনিয়ার ইফরানুর রহমানকে ফোন করে বলেন আমি ছাদে আছি। কিন্তু পরবর্তীতে তার ছেলেসহ অন্যান্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে তাকে ভবনের ছাদসহ কোথাও খুঁজে না পেয়ে হাসপাতালে যোগাযোগ করে। রাত ৩ টার দিকে সিএমএসএস হাসপাতাল থেকে তার মরদেহ শনাক্ত করে শুক্রবার লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে বাড়িতে নিয়ে আসি।
চঞ্চলের স্ত্রী, এক ছেলে ও এক মেয়েসহ বহু গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। নিহতের মেয়ে তাসনিয়া রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত।
বিতারা ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের সদস্য (মেম্বার) আবদুল বারেক প্রধান বলেন, চঞ্চল বাংলাদেশ বিমানের সাবেক কর্মী ছিলেন। সেখানে অবসরপ্রাপ্ত হওয়ার পর অগ্নিকাণে।ড ক্ষতিগ্রস্ত ভবনের একটি ট্রাভেলসে চাকরিতে যোগ দেন। আগুনে তার শরীর ৯০ ভাগ পুড়ে গেছে।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার দুপুর ১২ টা ৫৫ মিনিটে বনানীর ১৭ নম্বর রোডের এফ আর টাওয়ারের আট ও নয়তলায় অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ২৫টি ইউনিট দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা চেষ্টা চালিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনে। এ অগ্নিকান্ডের ঘটনায় শ্রীলঙ্কান নাগরিকসহ ২৫ জন নিহত হয়েছেন। ইতোমধ্যে ২৪ জনের মরদেহ তাদের স্বজনের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এদিকে, এ অগ্নিকান্ডের যথাযথ কারণ অনুসন্ধানের জন্য ইনস্টিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশের (আইইবি) আট সদস্য বিশিষ্ট ‘অগ্নিকান্ডের যথাযথ কারণ অনুসন্ধান ও সুপারিশমালা প্রণয়ন’ কমিটি গঠন করা হয়েছে।
পলির দাফন সম্পন্ন : রাজধানীর বনানীর এফ আর টাওয়ারে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় নিহত ফ্লোরিডা খানম পলির দাফন সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল শুক্রবার দুপুর ১ টার দিকে তার মরদেহ ঢাকা থেকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। এরপর বিকেল সাড়ে ৩ টায় জগন্নাথপুর জামে মসজিদ প্রাঙ্গনে পলির জানাযা শেষে তার বাবা-মার কবরের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
নিহত ফ্লোরিডা খানম পলি শিবগঞ্জ উপজেলার পাঁকা ইউনিয়নের ইউসুফ উসমান মনুর স্ত্রী এবং পৌর এলাকার মৃত আফজাল হোসেনের তৃতীয় মেয়ে। নিহত পলির স্বামী একটি বেসরকারি কোম্পানিতে ও তিনি স্ক্যানওয়েল লজিস্ট্রিক লিমিটেডের বিভাগীয় প্রধান ছিলেন। তার বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এক সন্তান ফয়সাল ও স্বামী নিয়ে ঢাকার মিরপুরে বিয়ের পর থেকেই স্থায়ীভাবে থাকতেন।
নিহতের বড় বোনের মেয়ে ডা. ফাহিমা শামিম খুসবু বলেন, খালার অফিসে আগুন লাগার খবর পাই। এরপর দুপুর দেড়টা পর্যন্ত খালার সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারি। পরবর্তীতে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে আমি খালার মোবাইলে একটি ম্যাসেজ করে আমার মোবাইল নম্বর দিয়ে রাখি। পরবর্তীতে খালার মরদেহ সিএমএইচ হাসপাতালে নেওয়া হলে সেখানকার ডাক্তার ওই ম্যাসেজ দেখে আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে মরদেহ শনাক্ত করে নিয়ে যেতে বলেন। পরে খালু খালার মরদেহ শনাক্ত করে গ্রামের বাড়িতে রওনা হয়। খবর বাংলানিউজের
এদিকে, নিহতের মরদেহ দুপুর ১ টার দিকে শিবগঞ্জে মায়ের বাড়িতে পৌঁছালে কান্নায় পুরো এলাকা ভারি হয়ে যায়। স্থানীয়দের পাশাপাশি নিহতের স্বামী ক্ষোভের সঙ্গে জানান, আমরা ঢাকাকে আর লাশের নগরী হিসেবে দেখতে চাইনা। আমরা চাই আইনের কঠোর প্রয়োগের মাধ্যমে একটি বসবাস উপযোগী ঢাকা।