বহুমাত্রিক অপরাধে জড়াচ্ছে রোহিঙ্গারা

22

তুষার দেব

গণহত্যার মুখে জীবন বাঁচাতে প্রতিবেশি মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা কোনোভাবেই ক্যাম্পের মধ্যে থাকতে চাচ্ছে না। উখিয়া-টেকনাফের শরণার্থী ক্যাম্প তো বটেই; এমনকি ভাসানচরে নির্মিত ক্যাম্পে স্থানান্তর করা রোহিঙ্গাদের অনেকেই সময়-সুযোগে সেখান থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার ক্যাম্পের ভেতরে ও বাইরে নানা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে সশস্ত্র সংঘাতসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে ক্যাম্পের থাকা আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) সহ অন্যান্য নিরাপত্তা সংস্থার ভূমিকা নিয়ে যেমন প্রশ্ন উঠছে, তেমনি রোহিঙ্গারা ক্রমেই দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের সরকারি বাহিনীর অব্যাহত হামলার মুখে প্রাণ বাঁচাতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসে আশ্রয় নেয় লাখ লাখ রোহিঙ্গা। এরপর থেকে রোহিঙ্গাদের দেখাশোনা করছে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশন। এর মধ্যে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ৩৪ টি ক্যাম্পে বর্তমানে ১২ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এর বাইরে ভাসানচরে স্থানান্তর করা হয়েছে কয়েক হাজার রোহিঙ্গা। শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে একজন করে ক্যাম্প ইনচার্জ হিসেবে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে। পাশাপাশি ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তিন ব্যাটালিয়ন আর্মড পুলিশ বা এপিবিএন সদস্যদের নিযুক্ত করা হয়। এতকিছুর পরেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে প্রায় প্রতিদিন শত শত রোহিঙ্গা নাগরিক ক্যাম্প থেকে বাইরে বেরিয়ে দেশের সাধারণ মানুষের সাথে মিশে যাচ্ছে। কেবলমাত্র গত দুইদিনেই টেকনাফ ও উখিয়া থানা পুলিশ ক্যাম্প থেকে বাইরে বেরিয়ে আসা ২৬৬ জন রোহিঙ্গাকে আটক করেছে।
কক্সবাজার রোহিঙ্গা প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রতিদিন শরণার্থী ক্যাম্প থেকে শত শত রোহিঙ্গা বাইরে বেরিয়ে এসে কক্সবাজার জেলার স্থানীয় লোকজনের সাথে মিশে যাচ্ছে। তাদের অনেকেই এখানে মাটি কাটার কাজ, প্যাডেল রিকসা, টমটম, সিএনজি অটোরিক্সা চালানো ও সাগরে মাছ ধরার ট্রলারের শ্রমিকের কাজ করছে। আবার অনেকে মাদক পাচার, ডাকাতি, ছিনতাই খুনোখুনির মত অপরাধেও জড়িয়ে পড়ছে। এটা উদ্বেগজনক ও নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনেকে আমাদের দেশের ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র পর্যন্ত বানিয়ে ফেলছে। এগুলোর নেপথ্যে কারা? রোহিঙ্গাদের যারা অপরাধে নানা অপরাধ কর্মকাÐে জড়িয়ে পড়ছে তাদের সুনির্দিষ্ট কোনো পরিচয়পত্র বা ফিঙ্গারপ্রিট নেই। তাই তাদের কেউ অপরাধে জড়ালে তাদেরকে শনাক্ত করাও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে একপ্রকার কঠিন। অথচ, তারা শরণার্থী ক্যাম্পের সমস্ত সুযোগ-সুবিধাও ভোগ করছে।
কক্সবাজার নাগরিক আন্দোলনের সদস্য সচিব এইচ এম নজরুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এপিবিএন সদস্যদের প্রধান দায়িত্ব তাদের ক্যাম্প থেকে বাইরে যাওয়া ঠেকানো। কিন্তু তারা কী আসলে সেটা করছে বা করতে পারছে? এপিবিএন সদস্যদের কড়া পাহাড়া ফাঁকি দিয়ে রোহিঙ্গারা কীভাবে ক্যাম্পের বাইরে আসে তা তদন্ত করে দেখা প্রয়োজন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার (এসপি) মো. হাসানুজ্জামানের দাবি, রোহিঙ্গারা যাতে ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে স্থানীয়দের সাথে মিশে যেতে না পারে, সেজন্য উখিয়া-টেকনাফে প্রতিদিন চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হচ্ছে। পুলিশের তল্লাশির কারণেই মার্চে শেষে এবং এপ্রিলের শুরুতে কক্সবাজার-টেকনাফ যথঅক্রমে ১৩০ ও ১৩৬ জন রোহিঙ্গা শরণার্থী আটক হয়েছে। পরে তাদের আইনি প্রক্রিয়া শেষ করে ট্রানজিট ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয়া হয়। পুলিশের এ ধরনের অভিযান অব্যাহত থাকবে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক মো. এমদাদুল ইসলাম পূর্বদেশকে বলেন, আসলে শরণার্থীদের লালন-পালন করাটাই অনেক বিদেশি সংস্থার জন্য ব্যবসা। রোহিঙ্গা সঙ্কটের সৃষ্টি যেহেতু মিয়ানমারে, কাই এর সমাধানও রয়েছে মিয়ানমারে। রাখাইন রাজ্যে তাদের মাতৃভূমিতে টেকসই ও মর্যাদাপূর্ণ প্রত্যাবাসনের মাধ্যমেই কেবল এ সঙ্কটের স্থায়ী সমাধান হতে পারে। এটাই এখনকার বাস্তবতা। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিগত চার বছরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারেনি। বিশ্বজুড়ে শরণার্থী সমস্যার উদ্ভব হলে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও বেসরকারি সংগঠনগুলোর কাছে চাকরি, বেতন-ভাতা, ব্যবসা বেশি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। তেমনি শরণার্থী সমস্যার সমাধানে তাদের নির্লিপ্ততাও সমধিক দৃশ্যমান। ফলে দেশের রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থাও যে মধ্যপ্রাচ্যের পশ্চিম তীরে সত্তর দশক ধরে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতিহীন ফিলিস্তিনিদের মত হবে না কিংবা এশিয়া অঞ্চলে আরেকটি ‘ফিলিস্তিন সঙ্কট’ দেখা দেবে না- সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না।