বহাল তবিয়তে ‘বড় ভাইয়েরা’

73

গত কয়েক বছরে নগরীতে ভয়ঙ্কর হত্যাকান্ডসহ বিভিন্ন অপরাধের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের জবানবন্দিসহ নানাভাবে এলাকাভিত্তিক রাজনৈতিক লেবাসধারী কথিত বড় ভাইদের নাম আলোচিত হলেও মামলার তদন্তে পুলিশ তাদের শনাক্তই করতে পারেনি। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় এসব বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে বেকায়দায় রয়েছে পুলিশ। এমন বড় ভাইদের কয়েকজন অনুকূল সময়ে এসে আদালতে আত্মসমর্পণ করলেও অধিকাংশই রয়েছেন বহাল তবিয়তে।
এ ধরনের আলোচিত হত্যা মামলার তদন্ত তদারকির সাথে সম্পৃক্ত নগর পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে পূর্বদেশকে বলেন, ‘খুনের ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে কথিত কিছু বড় ভাইয়ের নাম এসেছে। তাদের বিরুদ্ধে নানা অপরাধের নেপথ্যে থেকে ইন্ধন দেয়ারও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু এসব বড় ভাইদের ওপর প্রভাবশালী রাজনীতিবিদদের আশীর্বাদ রয়েছে। তাই অন্য মামলার মত তাদের বিরুদ্ধে সহজে কোনও আইনি পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হচ্ছে না।’
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম শাখার সভাপতি আখতার কবির চৌধুরী এ বিষয়ে পূর্বদেশকে বলেন, ‘হত্যাকান্ড কিংবা যে কোনও অপরাধে দায়ের হওয়া মামলার তদন্তে ঘটনার নেপথ্যে থাকা ব্যক্তিরা শনাক্ত না হলে সমাজে অপরাধ বেড়ে যায়। আমরা দেখেছি, অনেক সময় নেপথ্যে থাকা অপরাধীদের সাথে রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের কানেকশন থাকে। রাজনৈতিক প্রভাবশালীরা নিজের স্বার্থে এলাকাভিত্তিক এ ধরনের অপরাধী বা কথিত বড় ভাইদেরকে পরোক্ষভাবে আশ্রয়-প্রশ্রয় দিয়ে থাকেন। তাই বড় ভাইদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলেও পুলিশ সেক্ষেত্রে অনেক সময় নীরব থাকে। কিন্তু, অপরাধ করেও পার পেয়ে যাওয়ার সুযোগ থাকলে সমাজে অপরাধ বেড়ে যায়। অপরাধীরা তাতে যেমন বেপরোয়া হয়ে উঠে তেমনি সাধারণ মানুষের মধ্যেও নিরাপত্তাহীনতা কাজ করে।’
তবে, নগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার আমেনা বেগম মনে করেন, অপরাধ করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনও সুযোগ নেই। অপরাধে জড়িত থাকলে কোনও না কোনও সময় সংশ্লিষ্ট অপরাধী ধরা পড়বেই। তখন রাজনৈতিক কিংবা অন্য কোনও প্রভাবই আসলে তেমন কাজ করে না। তাই অপরাধে জড়িত থাকার তথ্য-প্রমাণ যার বিরুদ্ধেই পাওয়া যাক্ না কেন, পুলিশ সময়ের ব্যবধানে অবশ্যই তাকে আইনের আওতায় নিয়ে আসবে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, গত বছর অর্থাৎ ২০১৮ সালের ২৬ জুন তুচ্ছ ঘটনার জের ধরে নগরীর আতুরার ডিপো এলাকায় বন্ধুর হাতে খুন হন অনিক নামে এক তরুণ। এ খুনের সাথে জড়িতদেরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়ার জন্য এক ওয়ার্ড কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন স্বজনরা। এর আগে একই বছরের ১৭ জুন নগরীর দামপাড়ায় খুন হন আবু জাফর অনিক নামে এক তরুণ। খুনে জড়িতদের কথিত ‘বড় ভাই’ হিসেবে ব্যাটারি গলি এলাকার যুবলীগ নামধারী মহিনউদ্দিন তুষার নামে একজনের নাম উঠে আসে। ঘটনার এক সপ্তাহ পর কলকাতা থেকে পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। তারও আগে ওই বছরের ২ মে পতেঙ্গায় নেভাল একাডেমির অদূরে ১৮ নম্বর ঘাট থেকে উদ্ধার করা হয় স্কুলছাত্রী তাসফিয়া আমিনের লাশ। এ ঘটনায় চার কিশোরসহ ছয়জনকে আসামি করে মামলা করেন তাসফিয়ার বাবা মো. আমিন। ওই মামলায় আসামি করা হয় মুরাদপুর এলাকার যুবলীগ নামধারী তাদের কথিত বড় ভাই যুবলীগ মো. ফিরোজকে। যিনি উচ্চ আদালত থেকে অন্তর্বর্তী জামিন নিয়ে গ্রেপ্তার এড়ানোর পর নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই বছরের শুরুতে ১৬ জানুয়ারি জামালখান এলাকায় খুন হন কলেজিয়েট স্কুলের ছাত্র আদনান ইসপার। এ ঘটনার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে কয়েকজন কিশোরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদে তারা রাজনৈতিক বড় ভাই হিসেবে চন্দনপুরা এলাকার ছাত্রলীগ নেতা এনাম হোসেন, বোরহান উদ্দিন ও মো. জিলহজের নাম উল্লেখ করে। এর মধ্যে এনাম হোসেন দীর্ঘদিন আত্মগোপনে থাকার পর সম্প্রতি আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওই বছরের ৬ অক্টোবর নগরীর সদরঘাটে খুন হন মহানগর ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক সুদীপ্ত বিশ্বাস। এ খুনের ঘটনায় গ্রেপ্তার হওয়াদের জবানবন্দিতে ওঠে আসে মাঈনউদ্দিন হানিফ ও আইনুল কাদের নিপু নামে দুই মধ্যম সারির অপরাধীর নাম। তারা লালখানবাজার এলাকার একজন রাজনৈতিক বড় ভাইয়ের প্রশ্রয়ে অপরাধ কর্মকান্ড সংঘটিত করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সেই বছরের ৯ আগস্ট ইমরানুল করিম ইমন নামে এক তরুণকে বাসায় নৃশংসভাবে খুন করার পর লাশ ড্রামে ভরে এসিড ঢেলে দেয়া হয়। এরপর ড্রামের মুখ কংকর-সিমেন্টের মিশ্রণে ঢালাই করে সেটি রাণীর দিঘিতে ফেলে দেয়া হয়। এ ঘটনায় কারাগারে আটক রয়েছেন যুবলীগ নামধারী সন্ত্রাসী অমিত মুহুরী। অভিযুক্ত এই সন্ত্রাসীর বিরুদ্ধে পুলিশের ওপর হামলাসহ নানা অভিযোগে অর্ধডজনেরও বেশি মামলা রয়েছে। যুবলীগ নেতা ও সিআরবি ডাবল মার্ডার মামলার আসামি হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের প্রশ্রয়ে অমিত ভয়ঙ্কর অপরাধীতে পরিণত হয় বলে অভিযোগ উঠে। বাবর অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেন।