বসন্ত বাতাসে কুহুকুহু শোনা যায়

31

মুশফিক হোসাইন

গত কিস্তিতে কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের বিখ্যাত কবিতা দিয়ে শুরু করেছিলাম। কবি ফুল ফোটার অপেক্ষা না করে গাইছেন বসন্ত বন্দনা। তিনি সাম্যবাদের কবি। তিনি সমবণ্টনে বিশ্বাসী। আর তাই কামনা করেন ‘ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত’। বিশ্ব চরাচর বসন্তের অপেক্ষায় থাকে। কবি যাই কামনা করুক না কেন ; বাস্তবতা হলো বসন্তে ফুল ফুটতেই হবে। পাখিরা গান গাইবে, গাছে গাছে নব পল্লব প্রস্ফুটিত হবে। আউলা বাতাসে কুহু কুহু কোকিলের গান ভেসে বেড়াবে।
ফুল ফোটার সাথে প্রাণের বিকাশ হওয়ার সম্পর্ক। আর তাই প্রকৃতি বসন্তের অপেক্ষায় উন্মুখ থাকে। বসন্তের সাথে প্রকৃতির আত্মার সম্পর্ক। তাই দখিনা পবনে লাগে দোলা। ভুবনের ধুলিমাখা চরণে সেই দোলার শিহরণ জাগে। কোকিলের কুহু কুহু তান ও গাছে গাছে নব পল্লবের জাগরণ দেখে মানুষের মন ও আবেগে দোলা দেয়। গাছে গাছে মঞ্জুরিত বর্ণিল পুষ্প ফোটার সাথে মানবকুল নানা রঙে সাজার চেষ্টা করে। কিন্তু ২০২০ সালের মতো এবার ২০২১ সালেও মানব মনে বসন্তের আমেজ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কোভিট-১৯ মানুষের মন থেকে সকল আনন্দ উবে দিয়েছে। অতিমারির দাপটে সভ্য সমাজে হাহাকার। জ্ঞান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত বিশ্ব যেন থমকে আছে। গভীর সংকটে আবর্তিত। কিন্তু কেন ; তার উত্তর এখন সভ্য সমাজ দিতে পারি নি। একটি মাত্র ভাইরাস কেন মানব সমাজকে এতো আন্দোলিত করছে ? তার কারণ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন বিজ্ঞানিরা। বিশ্বে এর আগে নানা ধরনের মহামারী এসেছে। যার কারণে হাজার হাজার নয় লক্ষাধিক মানুষ মারা পড়েছে।
ইতিপূর্বে বিশ্বময় যে মহামারীগুলো আক্রমণ করেছিল, কোভিড তাকে ছাড়িয়ে যাবে। ব্ল্যাকডেথ (প্লেগ) গুটিবসন্ত, ম্যালেরিয়া, কলেরা, যক্ষা, স্প্যানিশ ফ্লু, এইডস, সার্স মার্স, নিপাহ ও ইবোলা ইত্যাদি অতিমারী অতীতে মানুষকে আক্রান্ত করেছে। ঐ সময় বিভিন্ন দেশে আক্রমণ হলেও সারা বিশ্বে একযোগে হয় নি। কিন্তু কোভিড-১৯ এখন সারা বিশ্বের দেশে দেশে ভয়াবহ আকারে একযোগে ছড়িয়ে পড়ছে। অনুন্নত এবং উন্নত সব দেশই আজ মহা সংকটে। ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই আজ হাসপাতালে। অক্সিজেনের তীব্র সংকট। এযাবত সারা বিশ্বে প্রায় ত্রিশ লক্ষাধিক মৃত্যু ও তের কোটির অধিক মানুষ কোভিড আক্রান্ত হয়েছে। বিজ্ঞানিরা এর প্রকৃত কারণ হয়ত খুঁজে বের করবেন। ততদিন আমাদের বেঁচে থাকা অনিশ্চিত। মৃত্যু প্রতিনিয়ত দরজায় হানা দিচ্ছে।
মানবজাতি প্রকৃতির প্রতি যে নির্মম আচরণ করছে, তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। প্রকৃতিকে তার নিজের নিয়মে চলতে দেয়া হয় না। নদীর কথাই বলি, মানুষ সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য খরস্রোতা নদীতে বাঁধ দেয়, বাঁধের ফলে নদী যেমন তার প্রবাহ হারায়, তেমনি নদীকেন্দ্রিক অসংখ্য জীব ও জীবন শঙ্কায় পতিত হয়। আবার চিরতরে বিশ্বচরাচর থেকে হারিয়ে যায়। উদাহরণ হিসাবে আমাদের কাপ্তাই বাঁধের কথা বলি। বাঁধের ফলে ৪০ লক্ষ পাহাড়ি জনগোষ্ঠী গৃহহীন হয়ে পড়ে। ৬৫৫ বর্গমিটার (২৫৩ বর্গমাইল) ভূমি পানিতে নিমর্জিত হয়। জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে ধ্বংস হয়। অসংখ্য কীটপতঙ্গ ও বন্যপ্রাণী জলের নিচে ডুবে মরে। কেউ কি তার হিসাব রেখেছে ? জীববৈচিত্রের উপর চরম আঘাত হানার জন্য কাপ্তাই বাঁধ দায়ী প্রকৃতি যে বিশাল সম্পদ হারিয়ে নীরবে কাঁদে।
একইভাবে মাটির তলদেশ থেকে গ্যাস, তেল, পানি, কয়লা, পাথর আহরণের জন্য খনন ও কূপ করে প্রাকৃতিক সম্পদ সীমাতিরিক্তভাবে উত্তোলন করা হয়েছে। ফলে সেখানে সৃষ্টি হয়েছে ফাঁকাবস্থা, যা পৃথিবীর ভূ-স্তরকে আন্দোলিত করছে। অন্যদিকে এই সকল জীবাশ্ম আহরণ করে মানুষ অর্থের লোভে কিংবা অতিমাত্রায় সুখ প্রত্যাশী হয়ে সীমাতিরিক্ত ব্যবহারে মগ্ন হয়ে আত্মপ্রসাদ অনুভব করছে। বাস্তবে কি তাই ? এসব জীবাশ্ম পুড়ে পৃথিবীর বায়ুমন্ডলে কার্বন ছড়িয়ে দিচ্ছে। ফলে কার্বনের প্রভাবে বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা বেড়েই চলছে। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে তা থেকে বাঁচার জন্য শীতাতপ যন্ত্রের প্রতি ঝুঁকছে। এই যন্ত্রও পরিবেশে উষ্ণতা ছড়ানোর জন্য সহায়ক। অন্য দিকে তাপমাত্রা বাড়ার কারণে বিশ্বের বনে বনে আগুন লাগার ঘটনা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। বিশ্ব জলবায়ু আজ আর আগের মতো নেই। উষ্ণতা বাড়ার ফলে উত্তর মেরুর বরফ ও হিমালয়ের বরফ গলছে। এতে করে অনেক দেশের উপকুলীয় অঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। চট্টগ্রামের ব্যবসা বাণিজ্যের হাবখ্যাত খাতুনগঞ্জ, চাক্তাইসহ নানান অঞ্চল ভরা কাটালে পানিতে সয়লাব হতে দেখা যায়। এতে করে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় কেনা খাদ্যশষ্য ও সম্পদ পানিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশ্বে বৃষ্টিপাতের তারতম্য লক্ষণীয়। বৃষ্টির মৌসুমে বৃষ্টি নেই, গরম মৌসুমে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতজনিত বন্যা ফসল ও সম্পদহানি যেমন করছে তেমনি অসংখ্য জীব ও জীবন তলিয়ে যাচ্ছে। বাস্তুতন্ত্র চরমভাবে আক্রান্ত হতে দেখা যাচ্ছে। ইউরোপের অনেক দেশে অতিরিক্ত বরফপাতের ঘটনা প্রায়শ ঘটছে। এগুলো কোন স্বাভাবিক ঘটনা নয়। প্রকৃতির এই অসংলগ্ন অবস্থার কারণে জীবজগতের খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ছে। খাদ্যশৃঙ্খল ভেঙে পড়ার সুযোগে অন্য কোন দুষ্ট ভাইরাস শৃঙ্খলে ঢুকে পড়ে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি করে। খাদ্যশৃঙ্খলের কোন একটি লুপ্ত হলে চরম বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। হালের অতিমারি কোভিড-১৯ সে ধরনের একটি দুষ্ট ভাইরাসÑ যা মানুষের জন্য আতঙ্ক হয়ে দেখা দিচ্ছে।
বিশ্বের দেশে দেশে এবং বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ প্রবাহিত। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এটি আফ্রিকান ভ্যারিয়েন্ট। বিশ্বে শনাক্তকৃত ব্রাজিল, ইউকে, ভারত, আমেরিকান ও আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট গুলোর মধ্যে ব্রাজিল, ও আফ্রিকার ভ্যারিয়েন্ট অতিশয় ক্ষতিকর ও মারাত্মক। ইতিমধ্যে তার থাবা বসিয়েছে বিশ্বের দেশে দেশে। এ কলাম লেখার সময় (৯-৪-২১) সর্বশেষ তথ্যে জানা একদিনে ভারতে আক্রান্ত হয়েছে লক্ষাধিক, ব্রাজিলেও লক্ষাধিক, ইরানে ২২ হাজার আর বাংলাদেশে ৭ হাজারের অধিক। মৃত্যু ব্রাজিলে সর্বোচ্চ প্রায় চার হাজারের বেশি। বাংলাদেশে প্রতিদিন আক্রান্ত ও মৃত্যু রেকর্ড গড়ছে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজনের আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংবাদ আসছে। প্রতিদিন এ তালিকা দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। মন মেজাজ ভীষণ ভারাক্রান্ত। ঘরে বন্দী জীবন। দেশে লকডাউন কোন ফল আনবে বলে মনে হয় না। সাধারণ মানুষেরা হাটে-বাজারে, বাসে, স্টেশনসহ বিভিন্ন স্থানে ভিড় করছে। সামাজিক দূরত্ব মানা ও মাস্ক পরার প্রবণতা নেই।
ভারত, আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রাজিল সহ বিভিন্ন দেশে এলাকা ভেদে কারফিউ জারি করা হয়েছে। বাংলাদেশের সরকার কঠোর লকডাউনের চিন্তাভাবনা করছেন। নির্মম পরিহাস এই যে দেশের মার্কেট ও শপিংমলের মালিক-কর্মচারীরা দোকানগৃহ খোলা রাখার জন্য মানববন্ধন ও মিছিল করার প্রেক্ষিতে সরকার মার্কেট ও শপিংমল খোলার অনুমতি দিয়েছে। সীমিতভাবে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় গণপরিবহন চালু করা হয়েছে। চলছে বইমেলা, অফিস-আদালত, সীমিতভাবে খোলা। তাহলে লকডাউন হলো কিভাবে ? বুঝে আসছে না কিছু। জানি না এর শেষ কোথায়। পতঙ্গের পাখা গজায় মরিবার তরে ? বাঙালি সেই পরিণতির দিকে যাচ্ছে ? আল্লাহপাকই ভাল জানেন এর পরিণতি কী। এ অধমের মাথায় আসে না। কারফিউ দিকে কি সরকার ভয় পাচ্ছে ? এ মহাবিপর্যয় হতে রক্ষার একমাত্র উপায় কঠোর নিয়ন্ত্রণ। অন্যথায় বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী।
কে বাঁচবে – কে মরবে কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারে না। ‘মরিতে চাহিনা এ সুন্দর ভুবনে, এ প্রত্যাশায় মানুষ বাঁচে। আগের ঢেউ এ প্রবীণরা বেশি আক্রান্ত হলেও এবারের দ্বিতীয় ঢেউ এ তরুণরা অপেক্ষাকৃত বেশি আক্রান্ত হচ্ছে। মানবসমাজকে প্রকৃতি থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। প্রকৃতি সুশৃঙ্খলভাবে কাজ করে। বিধিবদ্ধ নিয়মে চলে। মানব জাতিকে তা অনুসরণ করতে হবে। বেঁচে থাকার জন্য তেলেপোকা এবং কচ্ছপ যেভাবে পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে হাজার বছর টিকে আছে। তেমনি মানুষও পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে- অন্যথায় অন্যান্য প্রাণীদের মতো মানবজাতি বিলুপ্ত হওয়া অস্বাভাবিক নয়।
গত কিস্তিতে আমেরিকার ইয়েলোস্টন ন্যাশানালপার্কের একটি গল্প বলেছিলাম। আজ জানাই লাল চীনের একটি গল্প। ‘১৯৫৮ সালে চীনে গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ডের সময় কৃষির ফলন বাড়াতে চেয়ারম্যান মাও হাতে নিয়েছিলেন নানান কর্মসূচি। তার মধ্যে একটি ছিল ‘ইঁদুর মশা মাছি ও চড়ুই পাখি নিধন’। যা ফোর পেস্টস ক্যাম্পেইন নামে পরিচিত। ঐ সময় লাখে লাখে চড়ুইপাখি উড়ে এসে ধান খেয়ে ফেলে এই অভিযোগে লাখখানেক চড়ুইপাখি মেরে ফেলা হলো। ঠিক পরের বছর চড়ুইপাখি না থাকায় পঙ্গপাল ও পতঙ্গের আক্রমণ শুরু হলো। বিস্তীর্ণ শস্যক্ষেতজুড়ে পোকার আক্রমণে বেদিশা হয়ে পড়ল প্রশাসন। ধানের কাক্সিক্ষত ফল তো হলোই না বরং গ্রামাঞ্চলে শুরু হলো তীব্র খাদ্য সংকট। পরে ১৯৬০ সালে মাওয়ের নির্দেশে চড়ুইপাখি নিধন বন্ধ হলো এবং রাশিয়া থেকে লক্ষাধিক চড়ুই আমদানি করতে হলো।
এই গল্প থেকে আমরা কী শিক্ষা পাই। মানব জাতির জন্য এ গল্প একটি শিক্ষা দিল, তা হলো বিশ্বের সকল সৃষ্টির প্রয়োজনীয়তা আছে। মহান আল্লাহ বিনা প্রয়োজনে কিছুই সৃষ্টি করেন নি। অতএব মানব জাতিকে পৃথিবীর সকলর সৃষ্টির সাথে সহাবস্থানে থেকে বিধিবদ্ধ নিয়মনীতির মধ্যে জীবনকে পরিচালিত করতে হবে। মহান আল্লাহপাক সীমা লঙ্ঘন করাকে পছন্দ করেন না। তেমনি প্রকৃতি ও সীমা লঙ্ঘন করাকে পছন্দ করে না। এই পৃথিবীর সকল জীবের বাঁচার অধিকার আছে। শুধুমাত্র বুদ্ধিমান মানবজাতির তার স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য অন্যদের দখল, দমন করে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য উঠে পড়ে লেগে থাকে। প্রকৃতিকে প্রাকৃতিক নিয়মে বেড়ে ওঠার জন্য মানব সমাজকে সংবেদনশীল হতে হবে। সকল জীব-জগতের অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। তাদের খাদ্য, বাসস্থান এবং প্রজননে সাহায্য করতে হবে। ধূর্ত ও হিং¯্র প্রাণী নেকড়ে থেকে ক্ষুদ্র চড়ুই কেউই ফেলনা নয়। এসত্য যতক্ষণ না মানব সমাজ উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মহামারী থেকে মুক্তি অসম্ভব। আসুন বসন্ত বাতাসে কোকিলের কুহু কুহু ডাক শুনি। ফুল ফুটাতে বৃক্ষের পরিচর্যা করি। মৌমাছি ফুলে ফুলে গুণঞ্জন তুলে পরাগায়নে ব্যস্ত থাকুক।
লেখক: কবি, নিসর্গী ও ব্যাংক নির্বাহী (অব.)