বর্ষায় চট্টগ্রাম শহরের জলাবদ্ধতা এবং চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ

24

প্রফেসর ড. নারায়ন বৈদ্য

একদিন ক্লাসে ভূগোল টিচার হঠাৎ করে একটি প্রশ্ন করেছিলেন। তিনি ক্লাসে ঢুকে চক, ডাস্টার টেবিলের ওপর রেখে সরাসরি ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশে একটি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন। বললেন, কোন নদীকে চীনের দুঃখ বলা হয়? সেদিনের কথা স্পষ্ট মনে আছে। আমরা কেউ এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিনি। অথচ ভূগোল বই এর একটি পৃষ্ঠায় ছ্টো করে কথাটি লিখা ছিল। আমরা কেউ তা লক্ষ্য করিনি বা গুরুত্ব দিইনি। সেদিন স্যার বেত্রাঘাত করে এ প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন। বেত্রাঘাত খেয়ে স্যারের মুখে যে উত্তর শুনেছি তা আজও মনে রেখেছি। হোয়াং হো নদীকে চীনের দুঃখ বলা হয়। কিন্তু কেন এ নদীকে চীনের দুঃখ বলা হয় তার বিস্তারিত বিশ্লেষণ সেদিন পাইনি। কারণ তা ছিল সিলেবাস বহির্ভুত। কিন্তু বড় হয়ে এর বিস্তারিত ব্যাখ্যা পেয়েছি। বর্ষা মৌসুমে চীনের ব্যাপক অঞ্চলে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। কিন্তু এ জলরাশি বহন করে চীনসাগরে নিয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট ক্ষমতা হোয়াং হো নদীর নেই। ফলে প্রতি বৎসর নদীর দুই কূল প্লাবিত হয়ে বিস্তীর্ণ এলাকা ডুবে যায়। এতে বাড়িঘর, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এমন কি দালান কোটা পর্যন্ত জল¯্রােতে ভেসে যায়। দীর্ঘ দিন চীন সরকার এর কোন বিহীত ব্যবস্থা করতে পারেনি বলে হোয়াং হো নদীকে চীনের দুঃখ বলা হয়।
চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ শত বৎসর পূর্বে এ অঞ্চলে যখন জনবসতি আস্তে আস্তে গড়ে উঠে তখন এ অঞ্চলের মানুষের প্রধান জীবিকা ছিল কৃষি ও মৎস্য। বিশেষ করে খাল-বিল, নদী-নালা, ডোবা ছিল এ অঞ্চলে পরিপূর্ণ। ফলে কৃষি কাজ করে সহজেই জীবিকা নির্বাহ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু কৃষি জমি অপর্যাপ্তর কারণে বা জমি চাষের উপযুক্ত পর্যাপ্ত জমি ছিল না বলে মানুষ মৎস্য ধরে তা বিক্রয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে শুরু করে। পর্যায়ক্রমে এ পেশা বংশানুক্রমে চলে বলে তা একটি গোষ্ঠী বা সম্প্রদায়ে রূপান্তর হয়। এ সম্প্রদায় বা জলপুত্র সম্প্রদায় জীবিকা অন্বেষনের সুবিধার্থে বৃহৎ জলাশয় বা বৃহৎ মৎস্য আহরণ এলাকা বা নদী অথবা সমুদ্রের তীরবর্তী অঞ্চলে বসবাস করতে শুরু করে। তাছাড়া এ অঞ্চলে পাহাড় বা টিলা বেশি থাকার কারণে চাষ উপযোগী জমির পরিমাণ ছিল কম। মানুষের ভিন্ন ভিন্ন পেশার কারণে মানুষের নিকট বিনিময় করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয। যিনি মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করেন তিনি মাছ বিক্রয় করে চাউল কিনবেন, আর যিনি ধান চাষ করে, তিনি চাউল বিক্রয় করে মাছ কিনবেন। ফলে উদ্ভব হয় বিনিময় প্রথা। বিনিময় প্রথায় কিছু কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দেয়। যেমন- যিনি মাছ বিক্রয় করবেন তাঁর নিকট চাউল নাও লাগতে পারে। আবার যিনি চাউল বিক্রয় করবেন তাঁর নিকট মাছ নাও লাগতে পারে। এরূপ অসামঞ্জস্যতা দূর করার জন্য মুদ্রার আবির্ভাব হয়। মুদ্রা প্রচলনের ভেতর দিয়ে অভাবের অসামঞ্জস্যতা দূর হয়ে যায়। যখনই মুদ্রার মাধ্যমে বিনিময় শুরু হয় তখনই মুনাফা করার আশা পেয়ে বসে কিছু মানুষকে। এসব ব্যক্তিরা বিভিন্ন পণ্য দোকানে সাজিয়ে বেশি দামে বা মুনাফা করে বিক্রয় করতে শুরু করে। ফলে উদ্ভব হয় বাণিজ্যের ১৭৫৭ সালের পরবর্তী ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
কর্তৃক বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌল্লাকে পরাজিত করে ছলে-বলে-কৌশলে সমগ্র ভারতবর্ষকে দখল করে নেয়। এ কোম্পানির প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাণিজ্য করা। চট্টগ্রাম অঞ্চলেও বাণিজ্য তখন আস্তে আস্তে শুরু হয়। তাছাড়া চট্টগ্রাম অঞ্চল সমুদ্র তীরবর্তী হওয়ায় কারণে এ অঞ্চলে সমুদ্র বন্দরে গড়ে উঠে। ফলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বাণিজ্য করায় সুবিধা আরো বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে রয়েছে ছোট ছোট অসংখ্য খালও নদী। এসব খাল, নদী, নালাগুলো একদিকে ছিল মৎস্য আহরণের কেন্দ্রবিন্দু আর অপরদিকে ছিল বাণিজ্য করার পথ। তখনকার সময়ে তেমন রাস্তাঘাট ছিল না। তাই দূরদূরান্তে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, বাণিজ্যের কেন্দ্রবিন্দু চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ থেকে চলে যেত এসব নদী পথে। একসময় খাতুনগঞ্জ, কোরবানিগঞ্জ, আছদগঞ্জ থেকে মালামাল খরিদ করে ব্যবসায়ীরা চাক্তাই খাল দিয়েই প্রতিদিন শত শত নৌকাযোগে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটে যেত। এখন নৌযান চলাচল দূরের কথা, কালো কুচকুচে পানিতে ¯্রােত দেখা যায় না। নাব্যতা হারিয়ে এটি পরিণত হয়েছে আবর্জনার ভাগাড়ে। চাক্তাই খালের সঙ্গে ডজনখানেক ছোট খাল ও ছড়া সংযুক্ত ছিল। সেগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে গেছে। চট্টগ্রামে খাল, উপখাল, শাখা-প্রশাখাগুলোর মোট দৈর্ঘ্য ছিল ১৮২ দশমিক ২৫ কিলোমিটার। অনাদিকাল থেকে এসব খালের দখল প্রক্রিয়া চলতে থাকে। চট্টগ্রাম শহরে বিশেষ করে চাক্তাই খাল, হিজরা খাল, মির্জা খাল, মহেশখাল, জামাল খান এলাকার খাল ছড়াগুলো দখল হয়েছে বেশি। এ কারণে পাঁচ বছর পূর্বে শুরু হওয়া মেগা প্রকল্পগুলোর কাজ চালিয়ে নেয়া কঠিন হয়ে পড়েছে। খাল দখল প্রতিরোধের জন্য বর্তমান সরকার খালের দুই পাড়ে সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়িত হলে খালের দুই পাড়ে দখল প্রবণতা কমে যাবে। চাক্তাই খালের মোহনার দিকে চাক্তাই বাণিজ্যিক এলাকায়, রাজাখালীতে এখন দুই পাড়ে সড়ক হয়েছে। এতে করে যোগাযোগ সুবিধা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং যানজট কমতে শুরু করেছে। সবচেয়ে বেশি সুবিধা হয়েছে সড়ক ডিঙ্গিয়ে খাল দখলের প্রতিযোগিতা হ্রাস পেয়েছে। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ২০১৭ সাল থেকে সেনাবাহিনীর মাধ্যমে এ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছে। ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতায় এখনও পর্যন্ত ১৮টি খালের সংস্কার কাজ এগোচ্ছে না। এখালগুলো হচ্ছে- চাক্তাই খাল, মির্জা খাল, মহেশ খাল, চশমা খাল, রাজাখালী খাল-১, রাজাখালী খাল-৩, হিজড়া খাল, জামালখান খাল, চাক্তাই ডাইভারশন খাল, নোয়াখাল, ডোমখালী খাল, বামন শাহী খাল, শীতল ঝরণা খাল, নয়ার হাট খাল, গয়নাছড়া খাল, মহেশখালী খাল এবং খন্দকিয়া খাল। এসব খালের সম্প্রসারণ কিংবা পুনঃখনন ছাড়া পানি নিষ্কাষনের পথ সুগম হবে না। ফলে জলাবদ্ধতাও নিরসন হবে না। কাজেই আসন্ন বর্ষা মৌসুমে চট্টগ্রামবাসীর দুঃখ-দুর্দশাও কাটবে বলে মনে হয় না।
১৪২৮ বাংলা সনের শেষ মাস চৈত্র এরপরে শুরু হবে নতুন বছর। নতুন বছরের প্রথম মাস বৈশাখ পেরিয়ে জ্যৈষ্ঠের পরেই শুরু হবে আষাঢ় মাস। ঘন বরষায় যখন গগনে মেঘ গর্জে বৃষ্টি শুরু হবে তখন চাক্তাই, খাতুনগঞ্জ, রাজাখালী, বাকলিয়া, চকবাজার, কাপাসগোলা, মুরাদপুর, প্রবর্তক মোড়, বহদ্দারহাট, শুলকবহর, নাসিরাবাদ, সাগরিকা, কাট্টলী, হালিশহর এবং পতেঙ্গাসহ চট্টগ্রাম মহানগরের প্রায় ৩০ শতাংশ এলাকা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি হলেই জলমগ্ন হয়ে যাবে। এর মধ্যে কিছু কিছু এলাকায় দীর্ঘস্থায়ী হয় জলাবদ্ধতা। বিশেষ করে জোয়ারের সময় যদি বৃদ্ধি হয় তাহলে মহেশখাল দিয়ে পানি নামতে পারে না। তাতে আগ্রাবাদ, হালিশহর এলাকায় জলবদ্ধতা হয় দীর্ঘস্থায়ী। চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ মহেশখালের ওপর বাঁধ বেঁধে দিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তেমন উপকারে আসেনি ড্রেজিংয়ের অভাবে। তাছাড়া এ খালের দুইপাশেও উচ্ছেদ করা যায়নি। চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ যে ৩৬টি খাল সংস্কারের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দিয়েছে তার মধ্যে ৭টির কাজ শেষ হয়েছে। ১১টি কাজ শেষ হওয়ার পথে বাকি ১৮টি খালের সংস্কার কাজ মুখথুবড়ে পড়ে আছে ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতার কারণে। ভূমি অধিগ্রহণের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছিল ৭২৭ কোটি ৮৮ লাখ ৩১ হাজার টাকা। পাশাপাশি বিভিন্ন স্থাপনার ক্ষতিপূরণের জন্য বাড়তি ১৭ কোটি টাকা রাখা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অধিগ্রহণের জন্য জমির ক্ষতিপূরণের মূল্য বাড়িয়ে ২ হাজার ৬০০ কোটি টাকা প্রস্তাব করা হয়। সেই প্রস্তাব এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। আর এ অপেক্ষা অবশ্যই ১৪২৯ বাংলার আষাঢ় মাসের মধ্যে পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীন। অতএব, চট্টগ্রামবাসী আগত বর্ষায় জলাবদ্ধতার শিকার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।

লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক- বিসিজি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ