বর্ষার বিস্তারের মধ্যেই সাগরে লঘুচাপ

36

বাংলা বর্ষপঞ্জির দিনক্ষণের হিসাবে আষাঢ় মাস আসার আগেই এবার দেশজুড়ে বিস্তার লাভ করেছে বর্ষারোহী দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু। বর্ষণসিক্ত মৌসুমি বায়ুর বিস্তারের মধ্যেই উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে লঘুচাপ। এর প্রভাবে দেশজুড়ে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বৃদ্ধির পাশাপাশি চট্টগ্রাম, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের উপক‚লীয় অঞ্চলের কোথাও কোথাও ভারী বর্ষণ হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।
দেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. আব্দুর রহমান খান এমন আভাস দিয়ে পূর্বদেশকে বলেন, ইতিমধ্যে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু সারা দেশে বিস্তার লাভ করেছে। উত্তর-পশ্চিম বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন উপক‚লীয় এলাকায় একটি লঘুচাপ সৃষ্টি হয়েছে। মৌসুমি বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরের অন্যত্র মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করছে। এ কারণে সবমিলিয়ে আগামী কয়েকদিন সার্বিকভাবে দেশে বৃষ্টিপাতের প্রবণতা বাড়বে। এর মধ্যে উপক‚লীয় এলাকাগুলোর কোথাও কোথাও ভারী বৃষ্টিপাতও হতে পারে।
অধিদপ্তরের ঝড় সতর্কীকরণ কেন্দ্রের ওয়েবসাইটে গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা থেকে পরবর্তী চব্বিশ ঘণ্টার জন্য প্রচারিত পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজশাহী, খুলনা, বরিশাল ও চট্টগ্রাম বিভাগের অনেক জায়গায় এবং রংপুর, ময়মনসিংহ, ঢাকা ও সিলেট বিভাগের কিছু কিছু জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত হতে পারে। সেই সাথে সারাদেশের কোথাও কোথাও মাঝারি ধরনের ভারী থেকে ভারী বর্ষণ ও বিক্ষিপ্তভাবে শিলাবৃষ্টি হতে পারে। এই সময়ের পরবর্তী দু’দিন বা আটচল্লিশ ঘণ্টার শেষের দিকের আবহাওয়ার অবস্থায় বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টিপাত বাড়তে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে শুক্রবার সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত পূর্ববর্তী চব্বিশ ঘণ্টায় ময়মনসিংহ বিভাগের নেত্রকোণায় দেশের সর্বোচ্চ ৯৮ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে দেশের সীমান্তবর্তী সমুদ্র উপক‚লীয় অঞ্চল টেকনাফে।
এর আগে মাসের শুরুতে অনুষ্ঠিত বৈঠক শেষে জুন মাসের দীর্ঘমেয়াদী আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছিল, এ মাসে বঙ্গোপসাগরে দুটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে। এর মধ্যে একটি নি¤œচাপ অথবা গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। এছাড়া উত্তর-মধ্যাঞ্চলে দুই থেকে তিন দিন মাঝারি অথবা তীব্র বজ্রঝড় ও দেশের অন্যান্য জায়গায় তিন থেকে চারদিন হালকা অথবা মাঝারি বজ্রঝড় হতে পারে। সেই সঙ্গে দেশের কোথাও কোথাও ভারী থেকে অতি-ভারী বর্ষণ হতে পারে। এ মাসে একটি মৃদু (৩৬ থেকে ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস) অথবা মাঝারি (৩৮ থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস) ধরনের তাপপ্রবাহ বয়ে যেতে পারে। অধিদপ্তরের বৃষ্টিপাত সম্পর্কিত পরিসংখ্যানে জুন মাসে ঢাকা বিভাগে ৩৫৬ মিলিমিটার, ময়মনসিংহে ৪৩২ মিলিমিটার, চট্টগ্রামে ৭৮৯ মিলিমিটার, সিলেটে ৬৩৪ মিলিমিটার, রংপুরে ৩৮৯ মিলিমিটার, খুলনায় ২৯৬ মিলিমিটার এবং বরিশালে ৪৮৩ মিলিমিটারকে ‘স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত’ হিসেবে ধরা হয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, বছর তিনেক আগে অর্থাৎ বিগত ১৪২৫ বঙ্গাব্দের বৈশাখেই ‘শ্রাবণধারায়’ আগাম বর্ষার একধরণের ইঙ্গিত পাওয়া গিয়েছিল। সেই বছর মধ্য বৈশাখ পর্যন্ত দেশে যে পরিমাণ বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে, তা বিগত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। তবে এবার কালবৈশাখী মৌসুমে প্রত্যাশিত স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। মৌসুমজুড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলই সবচেয়ে বেশি অনাবৃষ্টির কবলে পড়েছে। বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ মাসে কয়েক দফায় দেশের অধিকাংশ অঞ্চলে মৃদু থেকে মাঝারি মাত্রার তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। সার্বিকভাবে বিক্ষিপ্ত ঝড় ও শিলাবৃষ্টির চাইতে চলতি কালবৈশাখী মৌসুমে দাবদাহেই পুড়তে হয়েছে বেশিরভাগ এলাকার মানুষকে। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুসারে, আষাঢ়-শ্রাবণকেই বর্ষাকাল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে, ভাদ্র মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত বর্ষার রেশ থেকে যায়। অর্থাৎ জুনের শেষ থেকে আগস্টের শেষ সপ্তাহ পর্যন্তই বর্ষা মৌসুম ধরা হয়।
আবহাওয়াবিদদের সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, একটানা কয়েকবছর দেশে বর্ষাঋতুর দৈর্ঘ্য অনেকটা কমে এসেছিল। আর আগাম বন্যা ঠাঁই নিতে শুরু করেছিল ইতিহাসের পাতায়। কিন্তু, ২০১৭ সালে বাঁক বদল ঘটিয়ে স্ব-মহিমায় আবিভর্‚ত হয় বর্ষাকাল। ওইবছর দেশে বন্যায় শতাধিক মানুষের মৃত্যু ঘটে। সীমাহীন দুর্ভোগ পোহাতে হয় অর্ধ কোটিরও বেশি বন্যাদুর্গত মানুষকে। বিশেষ করে হাওরাঞ্চলের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। হাওরের বাঁধ ভেঙ্গে বন্যার পানিতে ফসল তলিয়ে যায়। এছাড়া, বন্যাকবলিত অন্তত ৩২টি জেলার বাড়িঘর ও ফসলাদি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। দেশের নদনদীর পানির ৯৩ শতাংশই আসে উজানের দেশগুলো অর্থাৎ নেপাল, ভারত এবং কিছুটা ভুটান থেকে। ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা এবং মেঘনা অববাহিকায় বৃষ্টিপাতের ওপরই বাংলাদেশে বন্যা হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করে। উজানের পাশাপাশি দেশে অতিবৃষ্টি হলে জুনের শেষ দিক থেকে ক্রমাগতভাবে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পায়। আর নদীর পানি বিপদসীমা অতিক্রম করলেই দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) অধীনে দেশের তিনটি নদী অববাহিকার ৩৪৩ টি পানি সমতল পর্যবেক্ষণ পয়েণ্ট রয়েছে। এর মধ্যে প্রধান প্রধান নদ-নদীর ৯০টি পয়েণ্ট থেকে ৫৪টি পয়েণ্টে পানির উচ্চতা পর্যবেক্ষণ করে বন্যার পূর্বাভাস দেয়া হয়।
প্রসঙ্গত, পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংরক্ষিত তথ্যভান্ডারে উল্লেখ রয়েছে, দেশে ১৯৮৮ সালে প্রধান প্রধান নদ-নদীর পানি বিপদসীমার ১১২ সেণ্টিমিটার এবং ১৯৯৮ সালে বিপদসীমার ৮৭ সেণ্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বন্যার সৃষ্টি করেছিল। এর মধ্যে ১৯৮৮ সালের বন্যায় দেশের ৬১ শতাংশ এবং ১৯৯৮ সালের বন্যায় ৬৮ শতাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে গেলেও এরপর আর এমন ভয়াবহ পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়নি। তবে, ২০১৭ সালে হাওরে আগাম বন্যা ও উত্তরাঞ্চলে দুই দফা বন্যায় ব্যাপক ফসলহানি ঘটে।