বর্ষবরণ ও আমাদের ঐতিহ্য

68

অধ্যাপক আয়েশা পারভীন চৌধুরী

বৈশাখের আগমন আমাদের মাঝে বিরাজমান সকল দুঃখ দৈনতাকে দূর করে। সব জড়াজীর্ণকে পেছনে ফেলে নতুন আশায় স্বপ্ন বাঁধার আহবান জানান। জীবন চলার পথে সব বাধা বিপত্তিকে অতিক্রম করে জীবন জয়ের পথে শপথ নেওয়ার শিক্ষা দেয়। ক্লান্ত ও গ্লানিকে জয় করার শিক্ষা দেয় বৈশাখ। নিজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা সকল শক্তি ও প্রতিভাকে কাজে লাগিয়ে জীবনকে সাজানোর শিক্ষা আমাদের গ্রামীণ সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যকে গ্রাস করে চলছে আমাদেরই সৃষ্ট কথাকথিত আধুনিকতা। অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে দিন দিন আমাদের ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে। আমরা সবকিছুতে নেতিবাচক ধারণা পোষণ করি। সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠাতে সকলে একত্রে কাজ করতে দ্বিধাবোধ করি। আমাদের মধ্যে যে ক্ষমতা ও যোগ্যতা আছে তার সঠিক ব্যবহার করি না।
এদেশ আমার, এ ভূখন্ড আমার। এদেশে ও ভূ-খন্ডে বসবাসরত জনগণ আমার। আর এদেশের সকল স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির মালিকও আমরা। অথচ আমরা প্রতিনিয়ত বিভিন্ন অপ্রীতিকর ঘটনার সম্মুখীন হচ্ছি। বৈশাখের শুরুতে আগুন লাগার প্রবণতা বেড়ে যায়। কিন্তু গত বছর বেশ কয়েকটি বড় বড় দোকান-পাট, মার্কেট ও সুউচ্চ ভবনে আগুন লাগে। অনেক ক্ষয়-ক্ষতি ও প্রাণহানী হয়। আগুন লাগার ব্যাপারটি নিয়ে বিভ্রান্ত সৃষ্টি করে। প্রশ্ন উঠে- কেউ হয়তো ইচ্ছা করেই আগুন লাগিয়েছে। এ ধরনের মনমানসিকতাকে পরিহার করা উচিৎ। মাঝে মাঝে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে আসে- প্রতিশোধপরায়ণ হয়ে পুকুরে বিষ ঢেলে দিয়ে মাছ মেরে ফেলা, ফসল নষ্ট করা ইত্যাদি। আবার প্রতিদিনের সড়ক দুর্ঘটনায় অনেক প্রাণহানি হয়। বাঙালির প্রাণের উৎসব বৈশাখে আলপনা আঁকা একটি বিশেষ দিক। ঘরের আঙিনা থেকে পথে-প্রান্তরে আলপনা এঁকে রংয়ে রংয়ে সাজানো হয়। তাছাড়া অনেকে মুখে ও হাতে আলপনা এঁকে নিজেকে রাঙাতে পছন্দ করে। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আগত জন-সমাবেশের একটা বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে, আমাদের তরুণ সমাজ। তাদের উচ্ছ¡াস-উল্লাস-উদ্দীপনা আমাদের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে অনেক বেশি প্রভাবিত করে। এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানকে সফলতা দিতে এই তরুণ সমাজই অনেক দিন থেকে প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিশেষ করে চারুকলা অনুষদের শিক্ষার্থীরা এক মাস আগ থেকেই তাদের প্রস্তুতি নিতে থাকে। মঙ্গলশোভা যাত্রাকে বর্ণিল সাজে সাজাতে নিজেদের পোশাক-পরিষদের পাশাপাশি বিভিন্ন রং ও ঢংয়ের তৈল-তৈজস-মাটির-পাতার-বেতের-ইত্যাদি আনুষঙ্গিক জিনিস তৈরী করতে সকলের একটি সৃষ্টিময় মাস কাটে।
পয়লা বৈশাখের অনেক আগে থেকে ইলিশ মাছ নিয়ে নানা তর্কবিতর্ক চলতে থাকে। এক সময় ইলিশ মাছ সকলের নাগালের ভিতর ছিল। কম-বেশি সবাই সপ্তাহে মাসে বাংলাদেশের এই জাতীয় মাছটি খেতে পারতো। কিন্তু বর্তমানে ইলিশ শুধুমাত্র বিলাসিতা চিহ্নিত মাছে পরিণত হয়েছে। বিশেষ বিশেষ মানুষের বিশেষ বিশেষ আনন্দ-আয়োজনে ইলিশ মাছ রান্না করা হয়। সাধারণ জনগণ খুব কালে-ভদ্রে এই মাছ খেতে পারে। আর বৈশাখের আগমন বার্তার সাথে সাথে ইলিশ মাছের কদর আরো বহু গুণে বেড়ে যায়। তাই পান্তা-ইলিশের বিপক্ষে নানা প্রচারণা চলতে থাকে। গ্রাম-প্রধান বাংলাদেশের সবখানে পান্তা-ভাত খাওয়া হয়। সাথে থাকে নানান পদের তরকারী ও ভর্তা। আর বৈশাখে এই পান্তা ভাতকে কেন্দ্র করে যে হারে প্রচারণা চলতেই থাকে, ইলিশ খেতে হবে- এমন ধারণা নিয়ে যারা বর্ষবরণ করতে প্রস্তুত তারা হয়ত তারই পাশে বসবাসকারী প্রতিবেশীর সাধ-সামর্থ্যরে কথা ভাবে না। তাই বর্ষ বরণের আমেজটাও কিছুটা কমে যায়। বিভিন্ন পিঠাপুলি তৈরী করে গ্রামাঞ্চলের মানুষরা বৈশাখকে স্বাগত জানায়। আন্তরিকতা ও হৃদ্যতার ছোয়ায় একে অন্যকে হাতের তৈরী এই পিঠাপুলি দিয়ে আপ্যায়ন করে থাকে। কিন্তু শহরাঞ্চলে তেমন দেখা যায় না। বিভিন্ন স্থানে পিঠা উৎসব হয়। কিন্তু যান্ত্রিক জীবনে ঘরে ঘরে পিঠাপুলি বানানো হয় না। সি.আর.বি তে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে একটি ব্যানার সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে সি.এম.পি এর ব্যানার বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আগত সকলের মনে এক ধরনের প্রতিবাদের ঝড় তোলে। এই নুসরাত আমাদেরই সন্তান। বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে আগত তরুণ প্রজন্মের একটি বিরাট অংশ হচ্ছে নারী।
আমরা জানি, যুগ যুগ ধরে বর্ষবরণ আয়োজনে নারী অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। আমাদের নানী-দাদী-চাচী-খালা-মা ও আমরা নারীরা পরিবারের সদস্যদের বর্ষবরণকে আরো আকর্ষণীয় করে তুলি। গ্রাম-বাংলার, আনাচে-কানাছে নারীরা বর্ষবরণের আয়োজনের সাথে কম-বেশি সম্পৃক্ত। অথচ বর্ষবরণের দিনে নুসরাত হত্যার প্রতিবাদে প্রতিটি শহরে মৌন মিছিল, মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করা হয়। এখানে উল্লেখ্য বর্ষবরণের আগে থেকেই নিরাপত্তার বিষয়টি প্রাধান্য দিয়ে নানা প্রচার-প্রচারণা চলে। অবাধ স্বাধীনতায় উপভোগ করার এই বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি নিরাপত্তার চাদরে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। তবুও অঘটন ঘটে। তাই নুসরাত, অনু সোহাগী ও নাম না জানা কোন না কোনো মা-বোন একসময় হারিয়ে যায়। এমন বাংলাদেশ দেখতে ইচ্ছে হয় না যেখানে নারীরা সবসময় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে। আর একজন বাবা-ভাই তাদের প্রাণপ্রিয় মা-বোনের চিন্তায় সব সময় আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটাতে থাকে। আমাদের হালখাতা ও মঙ্গলশোভা যাত্রার সাথে আমাদের নারীরা-ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ-নারীদের সৃষ্টিশীল মনমানসিকতা তার পরিবারের অন্য সদস্যদের আনন্দ আয়োজনে অনেক প্রভাব ফেলে। পুরুষের সাজগোজের চেয়েও নারীদের সাজগোজ মঙ্গলশোভা যাত্রাকে আকর্ষণীয় করে তোলে। বছরের এই প্রথম দিন পরিবার ও সংসারের প্রতিটি ক্ষেত্রে একজন নারী তার আপন মহিমায় সুবাস ছড়াতে থাকে। বর্ষবরণের একটি বিশেষ আকর্ষণ হচ্ছে মুখোশ। নানা আকার-আকৃতির ও বিচিত্র রংয়ের মুখোশ পরে মেলায় আগত মানুষ হেঁটে বেড়ায়। তাছাড়া অনেকেই এই ধরনের মুখোশ তৈরী ও বেচা-কেনা করে এই একটি দিনে বেশ আর্থিকভাবে লাভবান হয়। তাছাড়া বিভিন্ন শব্দের বাঁশি-ভেপোগুলোর শব্দ কানে আসে। তবুও ভাল লাগে। এই একটি দিনে এই ধরনের শব্দগুলোকে কেউ শব্দ-দূষণে আখ্যায়িত করে না। বরং চলাচলের পথে বাঁশি-ভেপো আওয়াজগুলো আনন্দকে আরো বেশি ত্বরান্বিত করে। আমাদের দেশের স্কুল-কলেজ পর্যায়ের পাবলিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার দিন মিষ্টির দোকানগুলোতে বেশ ভিড় হয়। ছেলে-মেয়েদের ভাল রেজাল্ট জানানোর জন্য আত্মীয়-স্বজনের বাসায় মিষ্টি পাঠানো হয়। আমাদের দুইটি প্রধান ধর্মীয় উৎসবে তেমন মিষ্টির ব্যবহার হয় না। কিন্তু পয়লা বৈশাখের সময় মিষ্টির দোকানগুলোও বেশ ব্যস্ত হয়। সবাই মিষ্টি মুখ করে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় যাতে সারা বছর দিনগুলো সুখের কাটে।
মঙ্গলশোভা যাত্রা ও হালখাতা চালু আমাদের বৈশাখীরীতি। কিন্তু চট্টগ্রামের আর একটি ঐতিহ্যবাহী বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- জব্বারের বলী খেলা। প্রতি বছর বৈশাখে আড়ম্বর ও জাঁক-জমকপূর্ণ পরিবেশে জব্বারের বলী খেলার আয়োজন করা হয়। এই বলী খেলায় অংশ গ্রহণ করার জন্যে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বলীরা চট্টগ্রামে আসে। আর এই বলী খেলাকে কেন্দ্র করে যে মেলা হয় সেই মেলাটি বৈশাখী মেলার সাথে যুক্ত হয়ে ব্যাপকতা লাভ করে। মোরগ লড়াই, বৈশাখী মেলার আরো একটি সুন্দর আকর্ষণ। তরতাজা ও বলিষ্ঠ মোরগ নিয়ে মানুষ মেলায় জমায়েত হয়। যদিও লড়াই শব্দটি জড়িত তবুও এই লড়াইটি বৈশাখীর আনন্দে একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এখানে উল্লেখ, এই দুইটি খেলার মাঝে লুকিয়ে আছে আমাদের প্রতিবাদী মনোভাব। প্রতীকী এই লড়াইগুলো অতীতের সকল অন্যায়-অত্যাচার-জুুলুম-হানাহানির প্রতিবাদ স্বরূপ। এখনো আমাদেরকে উৎসাহ দিয়ে থাকে শুধুমাত্র দেশের গন্ডির ভেতর নয়, প্রবাসে অবস্থানকারী বাঙালি ভাই-বোনরাও পয়লা বৈশাখে জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।
২০২০ এর ৮ মার্চ থেকে বাংলাদেশে করোনা ভাইরাসের প্রাদুর্ভাব দেখা যায়। ২০২০, ১৭ মার্চ থেকে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২৬ মার্চের পর থেকে লকডাউন ও সীমিত পরিসরে জীবন যাত্রা শুরু হয়। সেই ২০২০ মার্চ থেকে সব ধরনের শপিংমল, বিপণী বিতান ও বাহারী জিনিসের দোকান পাট সব বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ২০২০ মার্চ থেকে ২০২০ এপ্রিল পর্যন্ত আমাদের জাতীয় ধর্মীয় ও সামাজিক অনেক বড় অনুষ্ঠান আয়োজন খুব সীমিত পরিসরে হয়। স্থাস্থ্যঝুঁকির কথা চিন্তা করে এখন প্রায় সব মিটিং ভার্চুয়ালী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। ২০২০ সালের এপ্রিল বাংলা নববর্ষের অনুষ্ঠানসূচিতে কোন উল্লেখযোগ্য আয়োজন ছিল না। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলে বাংলা নববর্ষের দিন স্বীয় উদ্ব্যোগে ও সীমিত পরিসরে ১ বৈশাখ পালন করে। চিরাচরিত নিয়মে ও আনন্দ উচ্ছ্বাসে বাংলা নববর্ষকে বরণ করা হয়। প্রতি বছর ফাল্গুনের শুরু থেকে নববর্ষকে বরণ করার প্রস্তুতি চলতে থাকে। অথচ ২০২০ সালে ফাল্গুন মাসে ফাল্গুনী আয়োজনও তেমন চোখে পড়ে নাই। ধর্মীয় সব অনুষ্ঠান আয়োজনও খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে হয়। মানুষের প্রাণশক্তিই মানুষকে সবকিছু করতে সাহায্য করে। বর্ষবরণের আনন্দে জীবন বিপন্ন করা থেকে নিজেই সচেষ্ট ছিল। নতুন আনন্দ ও উচ্ছ্বাসে নববর্ষ বরণের যে আগ্রহ থাকে গত বছর সেই আগ্রহও কম ছিল।
করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতার প্রভাবে এই দিনটির সকল আনন্দ ও উচ্ছ্বাস বিলীন হয়ে যায়। চারিদিকে মৃত্যুর সংবাদ শুনতে শুনতে মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করতে থাকে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে পয়লা বৈশাখ উদযাপন করা হয়। পাশাপাশি দুইটি দেশের এই উদযাপনের আঙ্গিক একই। যদিও ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে এই দুইটি দেশের মানুষের দৃষ্টিভঙ্গী আলাদা, তবে বৈশাখীর আগমন বার্তা দু’দেশে একই প্রভাব ফেলে, বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যাপক প্রসারের ফলে ক্ষণে ক্ষণে ঘটনাগুলো আমরা সহজেই জানতে পারি। দেশের ভিতর আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, নিকট ও দূরের সবাই নিজেদের আনন্দগুলো ভাগাভাগি করে নেই। আবার প্রবাসে অবস্থানরত সকল বাঙালি এই বৈশাখে দেশি ঐতিহ্যে সেজে বিদেশের মাটিতে বাঙালি সংস্কৃতি তুলে ধরে। এই বৈশাখী উৎসব অনন্তকাল সকল-আনন্দ-বেদনা-সুখ-দুঃখ-প্রাপ্তি-প্রত্যাশার প্রতীক হয়ে থাকবে।
লেখক; কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ
ডা. ফজলুল-হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম